নিজস্ব প্রতিনিধি, আগরতলা, ২২ আগষ্ট৷৷ চাঁদ ছুঁয়ে দেখার অভিযান শুরু হয়েছিল আমাদের প্রিয় শহর আগরতলা থেকেই৷ সেই ছোট্ট বয়সে৷ নিষ্ঠা, একাগ্রতা, কঠোর পরিশ্রমে তিনি পৌঁছেও গিয়েছিলেন চাঁদের কক্ষপথে৷ চাঁদ এবার অধরা থেকে গেছে সামান্য অংকের ভাগাভাগিতে৷ রিওতে পদক না পেলেও তাঁর লড়াই স্থান করে নিয়েছে আপাময় ভারতবাসীর মনিকোঠায়৷ সবার সঙ্গে আপ্লুত আমরাও৷ দীপা আজ ফিরেছেন নিজের শহর আগরতলায়৷ আবেগে উচ্ছ্বাসে উন্মাদনায় আজ ঘরের মেয়েকে স্বাগত জানিয়েছেন ত্রিপুরাবাসী৷ সঙ্গে প্রশিক্ষক বিশ্বেশ্বর নন্দীকে৷
দীপা কর্মকার এবং তাঁর প্রশিক্ষক বিশ্বেশ্বর নন্দীকে সংবর্ধনার আয়োজন করা হয় স্বামী বিবেকানন্দ ময়দানে৷ চড়া রোদ আর উত্তাপকে অপেক্ষা করেই ছাত্র-ছাত্রী, যুবক-প্রবীণরা সমবেত হয়েছিলেন ময়দানে৷ সাড়ে এগারোটায় সংবর্ধনা শুরুর আগেই সুকল কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের পোষাকে, ছাতায় রঙিন ময়দানের গ্যালারী৷ মাইকে ঘোষণা হচ্ছিল বিমানবন্দর থেকে কতটা এগিয়েছে দীপার কনভয়৷ সারা রাস্তায় অপেক্ষমান জনতার শুভেচ্ছা, অভিনন্দনের মধ্য দিয়ে কনভয় বিবেকানন্দ ময়দানে ঢুকতেই উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়েন অপেক্ষমান জনতার শুভেচ্ছা, অভিনন্দনের মধ্য দিয়ে কনভয় বিবেকানন্দ ময়দানে ঢুকতেই উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়েন অপেক্ষমান ক্রীড়াপ্রেমী মানুষ৷ গুরু শিষ্য গাড়িতেই হাত নাড়িয়ে মাঠ প্রদক্ষিণ করছিলেন৷ গ্যালারিতে তখন বাঁধ ভাঙ্গা উচ্ছ্বাস৷ সবাই ছবি তুলতে চায়৷ পারলে একটি বার ছুঁয়ে দেখতে চায় সোনার মেয়েকে৷
মাঠের মাঝে ছোট্ট মঞ্চে একে একে দীপা ও তাঁর কোচকে পুষ্প স্তবক দিয়ে অভিনন্দন জানান বিভিন্ন ক্রীড়া সংগঠন এবং সংস্থার প্রতিনিধিরা৷ অনুষ্ঠানের মাঝেই গুটি গুটি পায়ে আরেকটু এগিয়ে যেতে চাইছেন অনেকেই৷ আরেকটু কাছ থেকে দেখার জন্য৷ কোলে ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে এক মাও সামিল হয়েছেন এগিয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতায়৷ দীপার কনভয় মাঠে প্রবেশ করার আগেই সংবর্ধনার মূল মঞ্চ সামিল হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার এবং অন্যান্য অতিথিগণ৷
মঞ্চে মানপত্র এবং স্মারক উপহার দিয়ে দীপা কর্মকার এবং বিশ্বেশ্বর নন্দীকে রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে সম্মানিত করা হয়৷ তাদের শুভেচ্ছা অভিনন্দন জানানোর পাশাপাশি ভারতের দুই পদক জয়ী পি ভি সিন্ধু এবং সাক্ষী মালিককে তাদের শুভেচ্ছা সাফল্যের জন্য অভিনন্দন জানান মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার৷ তিনি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন রাজ্যের প্রখ্যাত জিমন্যাস্টিক্স কোচ প্রয়াত দলীপ সিংকে৷ মূলত তার হাত ধরেই ত্রিপুরা থেকে ভরত দেববর্মা, মন্টু দেবনাথ, কল্পনা দেবনাথ, বিশ্বেশ্বর নন্দীদের মতো ভারত বিখ্যাত জিমন্যাস্টরা উঠে এসেছেন৷ তিনি বলেন, দীপা কর্মকার আকস্মিকভাবে উঠে এসেছেন তা নয়৷ তিনি ধাপে ধাপে নিজেকে তৈরী করেছেন৷ সাফল্য পেয়েছেন৷ মুখ্যমন্ত্রী বিশেষ ভাবে অভিনন্দন জানান দীপা কর্মকারের বাবা মাকে৷ শুধু পড়াশুনায় আবদ্ধ না রেখে তাকে খেলার জগতে নিয়ে আসার জন্য৷
তিনি বলেন, দীপা কর্মকারের সাফল্য আমাদের আগামী প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে৷ মুখ্যমন্ত্রী আশা প্রকাশ করেন এই সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে রাজ্যের ক্রীড়া প্রশিক্ষকরা নবীনদের গড়ে তুলবেন৷ পুরস্কারই শেষ কথা নয়, একথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মঞ্চ থেকেই ঘোষণা করেন দীপা কর্মকারকে যুব বিষয়ক ও ক্রীড়া দপ্তরের সহ অধিকর্ত পদে এবং বিশ্বেশ্বর নন্দীকে উপ-অধিকর্তা পদে পদোন্নতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে৷ সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী তপন চক্রবর্তী দীপা কর্মকার অফুরন্ত প্রেরণার উৎস বলে অভিহিত করেন৷ তিনি ঘোষণা করেন, দীপা কর্মকারের সাফল্যকে সম্মান জানাতে আগামীকাল সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে৷ বন মন্ত্রী নরেশ জমাতিয়া জানালেন, দীপা আমাদের গর্বিত করেছে৷ আমাদের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিয়েছে৷ অনুষ্ঠানে সভাপতি যুব বিষয়ক ও ক্রীড়া মন্ত্রী সহিদ চৌধুরী বলেন, দীপার সাফল্যে রাজ্যবাসী দেশবাসী গর্বিত৷ আগামী দিনে আমরা তার আরও বড় সাফল্যের প্রতীক্ষায় প্রত্যাশায় থাকব৷ রাজ্য সরকার চায় আমাদের রাজ্যে দীপার মতো খেলোয়াড় আরও উঠে আসুক৷ আগরতলার মেয়র ড প্রফুল্লজিৎ সিনহাও তাদের অভিনন্দন জানান৷ দীপা কর্মকার এবং বিশ্বেশ্বর নন্দীকে তাদের সাফল্যের জন্য উষ্ণ অভিনন্দন জানান সাংসদ শংকর প্রসাদ দত্ত, মুখ্য সচিব ওয়াই পি সিং৷ সবার সঙ্গেই মঞ্চে বসে ছিলেন দীপার প্রশিক্ষক বিশ্বেশ্বর নন্দী, মা গৌরী কর্মকার, বাব দুলাল কর্মকার, তার প্রথম প্রশিক্ষক সোমা নন্দী৷ জনসমক্ষেই দুলাল বাবু জানালেন দীপা এখন আর তাদের মেয়ে নন৷ সে এখন ভারতের মেয়ে৷ কোচ বিশ্বেশ্বর নন্দী অঙ্গীকার করলেন আরও অনেক দীপা কর্মকার তৈরী করতে তিনি বদ্ধপরিকর৷ আবেগপ্লুত দীপা জানালেন আপ্রাণ চেষ্টা করবেন টোকিও অলিম্পিক থেকে ভারতের জন্য পদক আনতে৷ দীপা কর্মকার বেটি পড়াও বেটি বাঁচাওৃর সাথে যুক্ত করলেন বেটি খেলাও৷
দীপার সঙ্গে আমরাও যে প্রদুনোভায় একাত্ম হয়ে গেছি আজ স্বামী বিবেকানন্দ ময়দান তার সাক্ষী৷ একজন ক্রীড়াবিদের কাছে অলিম্পিক পদক মানে চাঁদ ধরারই সামিল৷ রিওতে চাঁদ ধরতে না পারলেও ভল্টে চার নম্বরে পৌঁছে লড়াই শেষ করেন দীপা৷ পরবর্তী লক্ষ্য চার বছর পর টোকিও অলিম্পিক৷ শুধু আমরাই নই ভারতবাসী তাকিয়ে আছে দীপার দিকে৷ তিনিতো শুধু প্রদুনোভার শিল্পীই নন, এই শিল্পের ধারক বাহকও৷
এদিকে, রাজ্যের উচ্চশিক্ষা দপ্তর এবং বিদ্যালয় শিক্ষা দপ্তর থেকে আজ জানানো হয়েছে যে, আমাদের রাজ্যের তথা ভারতবর্ষের সোনার মেয়ে অর্জুন পুরস্কারপ্রাপ্ত ও রিও অলিম্পিয়ান, ২০১৬, দীপা কর্মকার ও তাঁর আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন কোচ ি বশ্বেশ্বর নন্দীর সম্মান জানিয়ে রাজ্য সরকার আগামী ২৩ আগষ্ট, ২০১৬, রাজ্যের সমস্ত কলেজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারী অনুদান প্রাপ্ত এবং বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরকারী ছুটি ঘোষণা করেছে৷
উচ্চশিক্ষা দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে, ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন সেমিষ্টারের পূর্বনির্দ্ধারিত কোন পরীক্ষা থাকলে তা নির্র্দ্ধরিত সূচী অনুযায়ী অনুষ্ঠিত হবে৷
এদিকে, জিম্যানস্ট দীপা কর্মকার রাজীব গান্ধী খেলরত্ন ও প্রশিক্ষক বিশ্বেশ্বর নন্দী দ্রোণাচার্য পুরস্কারের মনোনীত হওয়ায় মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার তাঁদের আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়েছেন৷ শুভেচ্ছা বার্তায় মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ত্রিপুরার জিমন্যাস্ট দীপা কর্মকার রাজীব গান্ধী খেলরত্ন ও তাঁর প্রশিক্ষক বিশ্বেশ্বর নন্দী দ্রোণাচার্য পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছেন৷ আজ কেন্দ্রীয় সরকার এই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে৷ এটা প্রত্যাশিত ছিল৷ যোগ্যতার নিরিখেই এই দু’জনকে যথার্থ সম্মানে ভূষিত করা হল৷ ত্রিপুরার ক্ষেত্রে এই পুরস্কারের সংবাদ নিঃসন্দেহে আনন্দের ও গৌরবের৷ এই দুই পুরস্কার জাতীয় ক্রীড়াক্ষেত্রে ত্রিপুরার সম্মান আরও বাড়িয়ে দিল৷ দীপা কর্মকার ও বিশ্বেশ্বর নন্দীর এই পুরস্কার প্রাপ্তি অভীষ্ট লক্ষে পৌঁছুতে তাঁদের নিঃসন্দেহে আরও প্রেরণা যোগাবে৷ রাজ্যের নবীন ও আগামী প্রজন্মের ক্রীড়াবিদদের খেলাধূলার অঙ্গণে সাফল্য লাভের ক্ষেত্রেও উৎসাহিত করবে এই পুরস্কার৷
অন্যদিকে, ভারতের ক্রীড়ামহল এক নজিরবহীন ঘটনার সাক্ষী হতে চলেছে৷ এই প্রথম একইসঙ্গে চার-চারজন ক্রীড়াবিদ এক সঙ্গে পেতে চলেছেন রাজীব খেলরত্ন পুরস্কার৷ আগামীবছর ২৬ জানুয়ারি প্রজাতন্ত্র দিবসে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের হাত থেকে খেলরত্ন পুরস্কার নেবেন অলিম্পিক ব্রোঞ্জ পদকজয়ী কুস্তিগির সাক্ষী মালিক, রূপো পদক জয়ী ব্যাডমিন্টন তারকা পিভি সিন্ধু, রিও-তে ইতিহাস সৃষ্টিকারী বাঙালী জিমন্যাস্ট দীপা কর্মকার এবং তারকা শযটার জিতু রাই এই চারজনই এবার অলিম্পিকে নজর কেড়েছেন৷ এদিকে অর্জুন পুরস্কার পেতে চলেছেন অজিঙ্কা রাহানে, ফুটবলার সুব্রত পাল ও অ্যাথলিট ললিতা বাবর, শিবা থাপা, অপূর্ব চান্ডেলাসহ মোট ১৫ জনকে৷ এছাড়া দ্রোণাচার্য পুরস্কারে ভূষিত হচ্ছেন দীপা কর্মকারের কোচ বিশ্বেশ্বর নন্দীসহ পাঁচ কোচ৷ এই পাঁচ কোচদের মধ্যে রয়েছেন অ্যাথলেটিক্সে নাগপুরি রমেশ, বক্সিংয়ের সাগর মাল ধয়াল, ক্রিকেটে রাজকুমার শর্মা, সাঁতারের জীবনকৃতি পাচ্ছেন প্রদীপ কুমার ও কুস্তির লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্টে পাচ্ছেন মহাবীর সিং৷
2016-08-23