নিজস্ব প্রতিনিধি, আগরতলা, ৭ জুন৷৷ ত্রিপুরা বিধানসভায় ফুটছে ঘাসফুল৷ সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী বিধানসভা

অধিবেশনের আগেই তৃণমূল কংগ্রেসের বিধায়কও বিধানসভায় স্বীকৃতি পেতে চলেছেন৷ অবশেষে গত কয়েকমাসের রাজনৈতিক টানাপোড়েনের আপাতত যবনিকা হয়েছে মঙ্গলবার৷ কংগ্রেস ছেড়ে ছয় বিধায়ক আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দিলেন তৃণমূলে৷ এদিন সকালে ত্রিপুরা বিধানসভার অধ্যক্ষ রমেন্দ্র চন্দ্র দেবনাথের কাছে তৃণমূলে যোগ দেওয়ার ছয় বিধায়কের স্বাক্ষরপত্র তুলে দিলেন সুদীপ রায় বর্মন৷ সেই সাথে বিদ্রোহী বিধায়করা রচনা করলেন নয়া ইতিহাস৷
সোমবার বিধায়ক পদ থেকে জীতেন্দ্র সরকার পদত্যাগ করতেই আর ঝঁুকি নিতে চাননি সুদীপ রায় বর্মন৷ তড়িঘড়ি তৃণমূল সর্ব ভারতীয় সহ সভাপতিকে বার্তা পাঠান মঙ্গলবারই ৬ বিধায়ক অধ্যক্ষের কাছে তৃণমূলে যোগ দেওয়ার স্বাক্ষরপত্র তুলে দেবেন৷ সেই মোতাবেক এদিন সকালের বিমানে আগরতলায় আসেন মুকুল রায় এবং রাজ্য অতিথিশালায় বৈঠক করেন সুদীপ রায় বর্মনদের সাথে৷ এর পরই বিধানসভায় গিয়ে অধ্যক্ষের হাতে তৃণমূলে যোগ দেওয়ার স্বাক্ষরপত্র তুলে দেন বর্মন ব্রিগেড৷ অধ্যক্ষ তাঁদের স্বাক্ষরপত্র গ্রহণ করলেও এখনই বিধানসভায় তৃণমূলের বিধায়ক হিসেবে সুদীপ রায় বর্মনদের মর্যাদার বিষয়ে সম্মতি জানাননি৷ এদিন অধ্যক্ষ জানিয়েছেন, সুদীপ রায় বর্মন সহ আশীষ কুমার সাহা, দিবাচন্দ্র রাঙ্খল, বিশ্ববন্ধু সেন, প্রণজিৎ সিংহরায় এবং দিলীপ সরকারের তৃণমূলে যোগ দেওয়ার স্বাক্ষরপত্র পেয়েছেন৷ তবে, তাঁদের প্রত্যেককেই আলাদাভাবে নোটিশ পাঠিয়ে তৃণমূলে যোগদানের ক্ষেত্রে সম্মতি রয়েছে কিনা তা জানতে চাওয়া হবে৷

অধ্যক্ষ বলেন, আইন মোতাবেক যা যা করণীয় তাই তিনি করবেন৷ প্রত্যেকের কাছ থেকে আলাদাভাবে সম্মতি জানার পরই ছয় বিধায়ককে বিধানসভায় তৃণমূলের সদস্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হবে৷ এক্ষেত্রে কেউ যদি অসম্মতি প্রকাশ করেন তাহলে তাঁরা দল বিরোধী আইনের আওতায় পড়বেন৷ ফলে, আরও কয়েকদিন জটিলতা থেকেই যাচ্ছে৷ এদিন, অধ্যক্ষের কাছে উপস্থিত হয়েছিলেন বিধায়ক সুদীপ রায় বর্মন, আশীষ কুমার সাহা, বিশ্ববন্ধু সেন এবং দিবাচন্দ্র রাঙ্খল৷ বিধায়ক দিলীপ সরকার এবং প্রণজিৎ সিংহরায় তাঁদের সাথে ছিলেন না৷ ফলে, টেলিফোনে অধ্যক্ষকে তাঁদের সম্মতি বার্তা শুনিয়েছেন বিধায়ক সুদীপ রায় বর্মন৷ এদিকে, প্রদেশ তৃণমূল কংগ্রেস চেয়ারম্যান রতন চক্রবর্তী এদিন অধ্যক্ষের কাছে দলের তরফে ৬ বিধায়ককে অন্তর্ভূক্তির সম্মতিপত্র তুলে দিয়েছেন৷ সম্মতি পত্রে শ্রীচক্রবর্তী জানিয়েছেন, কংগ্রেসের ৬ বিধায়ক সম্প্রতি তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় চেয়ারম্যান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে দাবী জানিয়েছিলেন যে তাঁরা তৃণমূল কংগ্রেসে যোগদান করতে আগ্রহী৷ সেই মোতাবেক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে দলের তরফে রতন চক্রবর্তী ঐ ৬ বিধায়ককে দলে নেওয়ার সম্মতিপত্র অধ্যক্ষের কাছে তুলে দেন৷
গত কয়েকমাস ধরেই সুদীপ রায় বর্মনরা কংগ্রেসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে তৃণমূলে যোগদানের মনস্থির করেছিলেন৷ কিন্তু, দলত্যাগ বিরোধী আইনের হাত থেকে বাঁচতে সাত বিধায়ককে এক পাল্লায় তুলতে পারছিলেন না সুদীপ রায় বর্মন৷ সম্প্রতি তৃণমূলের সর্বভারতীয় সহ সভাপতি তথা সাংসদ মুকুল রায় রাজ্য সফরে এসে সুদীপ রায় বর্মনদের সাথে বৈঠক করেন৷ ঐ বৈঠকে সুদীপ রায় বর্মনের পাশাপাশি আশীষ কুমার সাহা, বিশ্ববন্ধু সেন, দিবাচন্দ্র রাঙ্খল, জীতেন্দ্র সরকার এবং প্রণজিৎ সিংহরায় ছিলেন৷ মুকুল রায় বাধারঘাট কেন্দ্রের বিধায়ক দিলীপ সরকারের বাসভবনে গিয়েও তাঁর সাথে তৃণমূলে যোগদানের বিষয়ে আলোচনা করেন৷ অবশেষে গত রবিবার দিলীপ সরকার তৃণমূলে যোগ দিতে রাজী আছেন বলে সম্মতি জানান৷ কিন্তু, সোমবার হঠাৎ জীতেন্দ্র সরকার কংগ্রেসের বিধায়ক পদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং সিপিএমে যোগ দেন৷ তাতে রাজ্য বিধানভায় কংগ্রেসের আসন সংখ্যা দাঁড়ায় ৯৷ জীতেন্দ্র সরকার পদত্যাগ করায় সুবিধা পান সুদীপ বর্মনরা৷ কারণ দলত্যাগ বিরোধী আইন মোতাবেক দুই তৃতীয়াংশ বিধায়ক একসাথে দলত্যাগ করলে তারা ঐ আইনের আওতায় পড়বেন না৷ ফলে, ৯ জন বিধায়কের মধ্যে ৬ জন এক পাল্লায় উঠে যাওয়ায় সুদীপ বর্মন কাল বিলম্ব না করে মঙ্গলবারই অধ্যক্ষের কাছে তৃণমূলে যোগ দেওয়ার স্বাক্ষরপত্র তুলে দিয়েছেন৷
সোমবারই বিধায়ক বিশ্ববন্ধু সেনকে ছয় বছরের জন্য বরখাস্ত করেন পিসিসি সভাপতি তথা বিধায়ক বীরজিৎ সিনহা৷ সেই মোতাবেক অধ্যক্ষের কাছে চিঠিও পাঠিয়ে দেন৷ এই বিষয়ে সুদীপ রায় বর্মনের বক্তব্য দলীয় সংবিধান সম্পর্কে ন্যুনতম ধারণা না থাকার কারণেই পিসিসি সভাপতি বিধায়ক বিশ্ববন্ধু সেনকে বরখাস্ত করার হঠকারী সিদ্ধান্ত নেন৷ তাঁর দাবি, কোন বিধায়ককে বরখাস্ত করার এক্তিয়ার পিসিসি সভাপতির নেই৷ সেই অনুযায়ী বিধায়ক বিশ্ববন্ধু সেন পিসিসি সভাপতিকে দলীয় সংবিধান উল্লেখ করে উত্তর পাঠিয়ে দিয়েছেন৷ সুদীপবাবুর দাবি, কংগ্রেসের সংবিধানে উল্লেখ রয়েছে কোন বিধায়ককে বরখাস্ত করার ক্ষেত্রে পিসিসি সভাপতির এক্তিয়ার নেই৷ কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির কাছে দলবিরোধী কাজ করেছেন কারণ দেখিয়ে বরখাস্ত করার প্রস্তাব পাঠাতে পারবেন পিসিসি সভাপতি৷ শুধু তাই নয়, যাকে বরখাস্ত করা হবে তার উদ্দেশ্যে কারণ দর্শানো নোটিশও জারি করতে হবে৷ অথচ দেখা গিয়েছে বিধায়ক বিশ্ববন্ধু সেনকে তাঁর বক্তব্য পেশ করার কোন সুযোগ না দিয়েই তাঁকে বরখাস্ত করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন৷ সুদীপ বর্মনের দাবি, ৬ বিধায়ক যাতে একসাথে যাতে কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দিতে না পারেন সেই লক্ষ্যে পিসিসি সভাপতি কৌশল নিয়েছেন৷ কিন্তু, এতকিছু করেও ৬ বিধায়ককে তৃণমূলে যেতে আটকাতে পারেননি পিসিসি সভাপতি৷
অধ্যক্ষের কাছে স্বাক্ষরপত্র জমা দিয়ে বেরিয়ে আসার পর সাংবাদিকদের মুখোমুখী হয়ে সুদীপ রায় বর্মন বলেন, কংগ্রেস-সিপিএমের অনৈতিক জোটের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হওয়ায় গত কয়েকমাস ধরে তাঁদেরকে হেনস্থা করার চক্রান্ত চলছিল৷ বহু বাধা বিপত্তি এসেছে তাঁদের সামনে৷ জীতেন্দ্র সরকারকে বিধায়ক পদ থেকে পদত্যাগের মাধ্যমে নোংরা খেলাও হয়েছে৷ কিন্তু, সংবিধানের ১০ ধারা মোতাবেক মঙ্গলবার অধ্যক্ষের কাছে ত্রিপুরা বিধানসভায় তৃণমূলের সদস্য হিসেবে মর্যাদা পাওয়ার ৬ বিধায়কের স্বাক্ষরিত আবেদনপত্র তুলে দেওয়া হয়েছে৷ এদিন থেকে আমরা ৬ বিধায়ক তৃণমূল বিধায়ক হিসেবে পরিচিত হবেন বলে জানিয়েছেন সুদীপ রায় বর্মন৷
এদিকে, জীতেন্দ্র সরকারকেও কটাক্ষ করতে ছাড়েননি সুদীপ রায় বর্মন৷ তিনি বলেন, দুইদিন আগেও আমাদের সাথেই ছিলেন জীতেন্দ্রবাবু৷ ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে তিনি ভেবেছেন সিপিএমে গেলে তাঁর ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হবে৷ কিন্তু, এই সিপিএম-ই বিধানসভায় জীতেন্দ্র সরকারের বিরুদ্ধে কুৎসা রটিয়েছে৷ তাঁকে দুর্নীতির মধ্যমণি বলে বিধানসভার ভিতরে এবং বাইরে অপমান করেছে৷ এই জীতেন্দ্র সরকারকেই বিধানসভার ভেতরে চোর বলা হয়েছে৷ কিন্তু, আজ সমস্ত কিছু ভুলে গিয়ে তিনি সেই সিপিএমেই যোগ দিয়েছেন৷ অবশ্য এর পেছনে সুদীপ রায় বর্মনের দাবি, আতঙ্কিত হয়ে জীতেন্দ্র সরকারকে পদত্যাগ করানো হয়েছে৷ তিনি স্পষ্ট জানান, ৬ বিধায়ক একসাথে কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দেওয়ায় এতটাই আতঙ্কিত যে সব দল মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে৷ এদিন তিনি পরিস্কার জানিয়ে দেন, পশ্চিমবঙ্গে আঁতাত হয়েছে, খুব শীঘ্রই এ রাজ্যেও কংগ্রেস সিপিএম আঁতাত করতে চলেছে৷
এদিকে, এদিন দুপুরে আগরতলা প্রেস ক্লাবে এক সাংবাদিক সম্মেলনে তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সহ সভাপতি মুকুল রায় দাবি করে বলেন, এরাজ্যে তৃণমূলের দ্বিতীয় ইনিংস শুরু হয়েছে৷ ২০১৮ তে ত্রিপুরা বিধানসভা নির্বাচনে এরাজ্যকে বামফ্রন্টের অপশাসন থেকে মুক্ত করতে আজ থেকেই তৃণমূলের কাজ শুরু করার ডাক দেন তিনি৷ তবে, রাজ্যে একক শক্তি বৃদ্ধির কথা বললেও নির্বাচন আসলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে জোটের বিষয়টি ভেবে দেখা হবে বলে জানিয়েছেন তিনি৷
তবে, তৃণমূলের বিধায়ক হিসাবে ত্রিপুরা বিধানসভায় স্বীকৃতি পেলেও ২০১৮ বিধানসভা নির্বাচন পর্যন্ত বিরোধী দলনেতার পদটি শূণ্য থাকবে৷ অধ্যক্ষ রমেন্দ্র চন্দ্র দেবনাথ জানিয়েছেন, বিরোধী দলনেতার স্বীকৃতি পাওয়ার ক্ষেত্রে ত্রিপুরা বিধানসভায় বিরোধী দলের সদস্য সংখ্যা ন্যুনতম দশ হওয়া প্রয়োজন৷ সেক্ষেত্রে কংগ্রেস ও তৃণমূল কোন দলেরই সদস্য সংখ্যা দশ হচ্ছে না৷ সেক্ষেত্রে আগামী বিধানসভা নির্বাচন পর্যন্ত বিরোধী দলনেতার পদটি খালিই থেকে যাবে৷ এদিকে, তৃণমূলের পরিষদীয় দলনেতা হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হবে সুদীপ রায় বর্মনকে৷ আর এই বিষয়টি খুব শীঘ্রই আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সহ সভাপতি মুকুল রায়৷

