নিজস্ব প্রতিনিধি, আগরতলা, ২৬ এপ্রিল৷৷ শিশু নিরাপত্তা নিয়ে যখন তোলপাড় গোটা বিশ্ব, এরই মাঝে তথ্য উঠে এসেছে ভারতে শিশু শ্রমিক সর্বাধিক৷ ইউনিসেফের রিপোর্ট মোতাবেক, সারা বিশ্বে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা ১৬ কোটি৷ সে জায়গায় কেবল ভারতেই শিশু শ্রমিক প্রায় সাড়ে ১১ কোটি৷ এনিয়ে বুধবার আগরতলায় ‘শিশু সুরক্ষা ও আমাদের দায়িত্ব’ শীর্ষক কর্মশালায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন রাজ্য মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন মনিকা দত্ত রায়৷ তাঁর মতে, যতদিন পর্যন্ত মানুষ সচেতন হচ্ছেন না, ততদিন শিশুদের সঠিক নিরাপত্তা সম্ভব নয়৷ এর জন্য কেবল আইনকে দোষারূপ করলে চলবে না৷ দায়িত্ব নিতে হবে সবাইকে৷
[vsw id=”TTrcR3VX3cw” source=”youtube” width=”425″ height=”344″ autoplay=”yes”]শিশুদের অধিকার ভুলুন্ঠিত হওয়ার এক করুণ চিত্র তুলে ধরে শ্রীমতি দত্তরায় জানান, প্রতিবছর দেশে ২৫ শতাংশ শিশু মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে৷ জন্মের পর পঞ্জিকরণ হচ্ছে না ৩৫ শতাংশ শিশুর৷ ৪৪ শতাংশ শিশুর সম্পূর্ণ টিকাকরণ হচ্ছে না৷ প্রতি ১৬ জনে ১ জন শিশু জন্মের এক বছরের মধ্যে মারা যাচ্ছে এবং প্রতি ১১ জনে ১ জন শিশু জন্মের পাঁচ বছরের মধ্যে মারা যাচ্ছে৷ দেশ এগিয়ে গেলেও, ৪০ শতাংশ শিশু এখনো অপুষ্টিতে ভুগছেন৷ ১৯ শতাংশ শিশুর বিদ্যালয় ছুট হচ্ছে এবং ১৮ শতাংশ মেয়ে ১৮ বছর হওয়ার আগেই তাদের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে৷ যে বিষয়টি তিনি সবচেয়ে উদ্বেগের বলে মন্তব্য করেন, তা হল প্রতি আড়াই ঘন্টায় এদেশে যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে৷ যা গোটা বিশ্বের তুলনায় শীর্ষস্থানে রয়েছে ভারত৷ তিনি জানান, এই তথ্য সেন্ট্রাল ব্যুরো অব স্টেটিসটিক্স থেকে মিলেছে৷ তাতেই প্রমাণিত হয়েছে গোটা দেশে শিশুদের অধিকার রক্ষার প্রশ্ণে নজিরবিহিন ব্যর্থতার বিষয়টি৷
এদিন এই কর্মশালায় উঠে এসেছে শিশুদের নিরাপত্তার প্রশ্ণে সুপ্রীম কোর্ট এবং হাইকোর্টগুলি তীক্ষ্ন নজরদারী রাখছে৷ কর্মশালায় স্বাগত ভাষণে জেলা শিশু সুরক্ষা সমিতি উপ-অধিকর্তা পি বি দত্ত জানিয়েছেন, জুভেইনাল আইন চলতি বছরের ২ জানুয়ারী পুণরায় সংশোধন করা হয়েছে৷ এই আইন সংশোধিত হয়ে এতটাই কঠিন হয়েছে যে শিশুদের অধিকার রক্ষায় বিভিন্ন স্তরে যারা দায়িত্বে রয়েছেন তাঁদের উপর সুপ্রীম কোর্ট এবং হাইকোর্টগুলি নজরদারী রাখছে৷ প্রতি তিন মাসে শিশুদের অধিকার রক্ষায় নিয়োজিতদের কাছ থেকে রিপোর্ট তলব করা হচ্ছে৷ ফলে, শিশুদের অধিকারের প্রশ্ণে কোন ধরনের গাফিলতি করার কোন সুযোগ নেই বলে তিনি জানিয়েছেন৷
তবে, যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি উদ্বেগের, তা হল মানুষকে এখনো পুরো দমে সচেতন করে তোলা সম্ভব হয়ে উঠেনি৷ বহু চেষ্টা করেও শিশুদের উপর অমানবিক নির্যাতন, হিংসা, যৌন নির্যাতন এমনকি শিশু পাচার রোধ করা সম্ভব হয়ে উঠছে না৷ এনিয়ে উদ্বেগ ও উৎকন্ঠা প্রকাশ করে রাজ্য মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন বলেন, দেশে শিশুদের মধ্যে বিশেষ করে কন্যা শিশুরা চরম অবহেলা এবং নির্যাতনের শিকার৷ আজকের যুগেও কন্যা শিশুরা মাতৃ গর্ভেও সুরক্ষিত নয়৷ আধুনিক চিকিৎসার সহায়তায় কন্যা ভ্রুণ হত্যা করা হচ্ছে৷ একটি তথ্য তুলে ধরে শ্রীমতি দত্তরায় বলেন, ভারতে গড়ে ১০০০ পুরুষের মধ্যে মহিলার সংখ্যা ৯২৪ জন৷ ত্রিপুরায় অবশ্য পরিস্থিতি জাতীয় গড়ের তুলনায় কিছুটা ভাল৷ এরাজ্যে গড়ে ১০০০ জন পুরুষের মধ্যে মহিলার সংখ্যা ৯৫৩ জন৷ তা সত্বেও নারীদের হার বিপদসীমার উপরে নয়৷ এখনো যত্রতত্র, জঙ্গলে বা মন্দিরের দরজায় বহু মায়েরা কন্যা সন্তানদের ফেলে রেখে পালিয়ে যান৷ একবিংশ শতাব্দিতেও বহু কুন্তি রয়েছেন যারা সামাজিক, পারিবারিক পরিস্থিতির শিকার হয়ে কন্যা সন্তানদের অন্ধকার পৃথিবীতে ফেলে রেখে চলে যান৷ এবিষয়ে অবিভক্ত পশ্চিম ত্রিপুরা জেলার শিশু কল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যান বিশিষ্ট শিশু চিকিৎসক ডাঃ বিকাশ রায় বলেন, সম্প্রতি বাচ্চাদের হোমে ভর্তি করার প্রবণতা বাড়ছে৷ পারিবারিক হিংসার শিকার মায়েরা তাদের সন্তানদের হোমে পাঠিয়ে নিস্তার পেতে চাইছেন৷ এক্ষেত্রে শুধু প্রশাসনের পক্ষে সমস্ত দিক সামাল দেওয়া সম্ভব নয়৷ দায়িত্ব নিতে হবে সমাজকে৷ যদি কোন বাড়িতে পারিবারিক হিংসার খবর পাওয়া যায়, তাহলে যদি প্রতিবেশীরা নীরব দর্শক হয়ে থাকেন তাহলে এই মারাত্মক সমস্যা থেকে পরিত্রাণ সম্ভব নয় মন্তব্য করেন ডাঃ রায়৷
এদিনের কর্মশালায় দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার উপরও আঙ্গুল উঠেছে৷ রাজ্য মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন তথ্য তুলে ধরে স্পষ্ট জানিয়েছেন, গোটা দেশে এখনো ৬০ শতাংশ কন্যা সন্তানের জন্য বিদ্যালয়ের দরজা খুলেনি৷ তিনি সুর চড়িয়ে বলেন, একদিকে সারা দেশে শিক্ষা বিপ্লবের ডাক দেওয়া হচ্ছে৷ অন্যদিকে, কন্যা সন্তানদের এক বিরাট অংশ শিক্ষার আলো থেকে আজও বঞ্চিত৷ ফলে, শিশু বিবাহও আটকানো সম্ভব হচ্ছে না৷ তিনি জানান, রাজস্তান সহ বেশ কিছু রাজ্যে এখনো ৬-৮ বছরের কন্যা সন্তানদের বিয়ে দেওয়া হচ্ছে৷ এরাজ্যেও এধরনের ঘটনা ঘটছে৷ যেখানে খবর পাওয়া যায়, সেখানে প্রশাসনের সহায়তায় বাল্যবিবাহ আটকে দেওয়া হয়৷ কিন্তু এমন অনেক সময় বাল্যবিবাহের খবর সময় মতো পাওয়া যায় না৷
এদিনের কর্মশালায়, অন্যান্যরা বক্তারাও শিশুদের অধিকার রক্ষায় সকলের সচেতনতার উপরই জোর দিয়েছেন৷ তাঁদের মতে, সচেতনতার মাধ্যমেই শিশুদের অধিকার রক্ষা এবং নিরাপত্তা প্রদান সম্ভব৷ আওয়াজ উঠেছে শিশু শ্রম বন্ধ করার জন্যও৷ তাঁদের স্পষ্ট বক্তব্য, যে বয়সে ছেলেমেয়েদের পড়াশুনা করা দরকার, সে সময়ে তাদের দিয়ে কাজ করানো কোনভাবেই চলবে না৷ তার জন্য সকলের সহযোগিতার আবেদন রাখা হয়েছে৷
2016-04-28