ইউসুফ কমিশনের রিপোর্ট নিয়ে উত্তপ্ত বিধানসভা, দুইবার মুলতুবি, ‘বিমল হত্যায় মুখ্যমন্ত্রীর হাত’- বিরোধী নেতার অভিযোগের প্রমাণে চ্যালেঞ্জ সিপিএমের

SUDIPBIJANনিজস্ব প্রতিনিধি, আগরতলা ২৮ মার্চ৷৷ প্রয়াত স্বাস্থ্যমন্ত্রী বিমল সিনহা হত্যা সংক্রান্ত ঘটনার ইউসুফ কমিশনের রিপোর্ট নিয়ে আজ বিধানসভায় বিরোধীরা ঝড় বইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন৷ অন্তত দু’বার অধ্যক্ষকে বিধানসভা অধিবেশন মুলতুবি করতে হয়৷ এদিনের অধিবেশনের শুরুতেই ইউসুফ কমিশনের রিপোর্ট নিয়ে আলোচনার জন্য মুলতুবি প্রস্তাব আনেন বিরোধী দলনেতা সুদীপ রায় বর্মণ৷ এই প্রস্তাব অধ্যক্ষ রমেন্দ্র চন্দ্র দেবনাথ অগ্রাহ্য করলেই হৈ চৈ এর সূত্রপাত হয়৷ পরে, বিধানসভায় লবিতে বিরোধী দলনেতা শ্রীবর্মণ বিমল সিনহা হত্যার সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকারের হাত আছে বলে মন্তব্য করেন৷ তিনি এর জন্য সিবিআই তদন্তের দাবি করেন৷ এদিন সন্ধ্যায় সিপিএম রাজ্য কার্যালয়ে তড়িঘড়ি ডাকা এক সাংবাদিক সম্মেলনে বিমল সিনহা হত্যার সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকারের হাত আছে বলে অভিযোগের তীব্র বিরোধিতা ও নিন্দা জানায়৷ সিপিএম রাজ্য সম্পাদক বিজন ধর ও দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য গৌতম দাশ সুদীপ বর্মণের বক্তব্যকে চ্যালেঞ্জ জানান৷ তাঁরা দাবি করেন, এই অভিযোগের প্রমাণ দিন, নতুবা বিধায়ক পদ থেকে সুদীপ বর্মণ ইস্তফা দিন৷
উল্লেখ্য, ইউসুফ কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশের পর রাজ্য রাজনীতিতে জোড় প্রতিক্রিয়া হয়েছে৷ এই রিপোর্ট নিয়ে সোমবার বিধানসভায় বিরোধীদের আনা মুলতুবি প্রস্তাব খারিজ করে দিয়ে অধ্যক্ষ স্বল্পকালীন আলোচনার নোটিশ আনার জন্য বলেন৷ বিরোধীরা তাতে এদিনই আলোচনার জন্য দাবি জানান৷ কিন্তু অধ্যক্ষ তাতে সম্মত না হওয়ায় বিরোধীরা ওয়েলে নেমে গিয়ে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন৷ মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে স্লোগানও দিতে থাকেন৷ হৈ হট্টগোলের মাঝে অধ্যক্ষ ১৫ মিনিটের জন্য সভা মুলতুবি ঘোষণা করেন৷ পুনরায় সভা শুরু হলে বিরোধীরা তাদের দাবিতেই সোচ্চার হন৷ কিন্তু অধ্যক্ষও নিজের সিদ্ধান্তে অনঢ় থাকেন এবং সভার পরবর্তী কার্যসূচী শুরু করেন৷ এরই মাঝে বিরোধীরা ফের ওয়েলে নেমে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী এবং রাজ্য সরকার বিরোধী স্লোগান দিতে থাকেন৷ সভা আবারও উত্তপ্ত হয়ে ওঠলে অধ্যক্ষ প্রথমার্ধ সমাপ্তের নির্ধারিত সময়ের আগেই মুলতুবি ঘোষণা করেন৷
এরপর বিরোধী দলনেতা বিধানসভায় নিজ অফিস কক্ষে সাংবাদিক সম্মেলনে প্রয়াত স্বাস্থ্যমন্ত্রী বিমল সিনহা হত্যার সাথে মুখ্যমন্ত্রীর মদত রয়েছে বলে দাবি করেন৷ তিনি জোর গলায় বলেন, বিমল সিনহা হত্যার সাথে মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকারের প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ মদত রয়েছে৷ কারণ, বিমল সিনহা মুখ্যমন্ত্রীর গদির অন্যতম দাবিদার ছিলেন৷ সেই ভয়েই তাঁকে ষড়যন্ত্র করে উগ্রপন্থীদের হাত দিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে৷ এজন্যই এই হত্যা মামলায় সিবিআই তদন্ত দেওয়া হয়নি৷ এমনকি ইউসুফ কমিশনকেও সহযোগিতা করা হয়নি৷
এই দাবির স্বপক্ষে তাঁর যুক্তি, যেদিন বিমল সিনহাকে হত্যা করা হয়েছিল সেদিনই কংগ্রেসের তরফে সিবিআই তদন্তের দাবি জানানো হয়েছিল৷ কিন্তু রাজ্য সরকার তখন সিবিআই তদন্তের দাবিতে কর্ণপাত করেনি৷ পরবর্তী সময়ে সিআইডি তদন্ত এবং এসআইটি গঠন করা হয়৷ শেষে ইউসুফ কমিশনও গঠিত হয়৷ কিন্তু ইউসুফ কমিশন তার রিপোর্টে স্পষ্ট উল্লেখ করেছে রাজ্য সরকার এই হত্যা মামলার তদন্তে কমিশনকে সম্পূর্ণ অসহযোগিতা করেছে৷ এমনকি প্রয়াত স্বাস্থ্যমন্ত্রী বিমল সিনহার স্ত্রী বিজয়লক্ষ্মী সিনহা ভয়ে মুখ খুলেনি, সেকথাও রিপোর্টে উল্লেখ রয়েছে৷
এদিন বিরোধী দলনেতা ইউসুফ কমিশন রিপোর্ট প্রকাশ নিয়ে রাজ্য সরকারের অনীহার প্রসঙ্গ তুলে ধরে বলেন, ৩১ জানুয়ারি ২০০০ সালে কমিশন রিপোর্ট পেশ করে৷ কিন্তু এরপর বহুবার বিভিন্নভাবে রিপোর্ট প্রকাশের দাবি জানানো সত্ত্বেও রাজ্য সরকার নানা তালবাহানা করে৷ অথচ কমিশনের তদন্ত আইন মোতাবেক রিপোর্ট প্রকাশের ছয় মাসের মধ্যে তা সংসদে কিংবা বিধানসভায় পেশ করার নিয়ম রয়েছে৷ যেমনটা হয়েছিল মুম্বাই দাঙ্গা নিয়ে শ্রীকৃষ্ণ কমিশনের রিপোর্ট নিয়ে৷ কমিশন মুম্বাই দাঙ্গার রিপোর্ট কেন্দ্রীয় সররকারের কাছে পেশ করলে তখন বামেরাই সংসদে এই রিপোর্ট প্রকাশ করার জন্য সোচ্চার হয়েছিলেন৷ বামেদের দাবিতে তদানীন্তন কেন্দ্রীয় সরকার সংসদে সেই রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল৷ অথচ রাজ্যে বিমল সিনহা হত্যা মামলায় ইউসুফ কমিশনের রিপোর্ট পেশ করার দীর্ঘ ১৬ বছর পর উচ্চ আদালতের নির্দেশে তা প্রকাশ করতে বাধ্য হয় রাজ্য সরকার৷
কিন্তু এই রিপোর্টে দেখা গেছে, কমিশন তদন্ত করতে গিয়ে রাজ্য সরকারের অসহযোগিতার বিষয়টি উল্লেখ করেছে৷ সিআইডি রিপোর্টের বাইরে আর কোন কিছুই ইউসুফ কমিশনকে দেওয়া হয়নি৷ কমিশন রিপোর্টে এও উল্লেখ করেছে এসআইটি কোন রিপোর্ট দেয়নি৷ এজন্যও হয়ত এই হত্যা মামলায় সিবিআই তদন্ত দেওয়া হয়নি বলে সন্দেহ প্রকাশ করেন বিরোধী দলনেতা৷ তাঁর বক্তব্য, সিপিএমের সাথে বৈরীদের যোগাযোগ রয়েছে তা সিবিআই তদন্তে বেরিয়ে আসতে পারে৷ এমনকি বিমল সিনহা হত্যা মামলায় মূল ষড়যন্ত্রকারী কে সেই রহস্যও উন্মোচন হতে পারে, সেই আশঙ্কাতেই হয়ত সিবিআইয়ে অনীহা ছিল রাজ্য সরকারের৷
মুখ্যমন্ত্রীর দাবিদার বলেই হয়ত বিমল সিনহা খুন হয়েছেন, সে বিষয়ে যুক্তি দিয়ে বিরোধী দলনেতা বলেন, প্রয়াত স্বাস্থ্যমন্ত্রী মারা যাওয়ার কয়েকদিন আগে আগরতলায় একটি পত্রিকা অফিসে দেখা হলে তিনি জানিয়েছিলেন ১৮ জন সিপিএম বিধায়কের সমর্থন সত্ত্বেও মুখ্যমন্ত্রী হতে পারেননি৷ হয়ত বা আর কখনো মুখ্যমন্ত্রী হওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব হবে না৷ বিরোধী দলনেতা এই তথ্য তুলে ধরে বিমল সিনহা হত্যা মামলায় সিবিআই তদন্ত দিলে হয়তবা সমস্ত রহস্য উন্মোচিত হত, এনিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন৷
বিরোধী দলনেতার সমস্ত অভিযোগ খন্ডন করে এদিন সন্ধ্যায় সাংবাদিক সম্মেলনে সিপিএম রাজ্য সম্পাদক বিজন ধর মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে আনা সমস্ত অভিযোগ মিথ্যা এবং ভিত্তিহীন বলে দাবি করেন৷ তাঁর দাবি, বিরোধী দলনেতা মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক কুৎসা রটাচ্ছেন৷ এর প্রতিবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, নানা ঘটনায় কংগ্রেস এবং বিরোধীরা জনমনে বিভ্রান্তি তৈরি করার জন্য মুখ্যমন্ত্রীকে লক্ষ্য করে নানা অভিযোগে অভিযুক্ত করেন৷ এরকমই যদি সুনির্দিষ্ট তথ্য তাদের কাছে রয়েছে, তাহলে তারা কমিশনের মুখাপেক্ষী কেন হলেন না৷ তখন কেন এসমস্ত তথ্য তুলে ধরলেন না৷ তিনি বিরোধী দলনেতার উদ্দেশ্যে চ্যালেঞ্জ ছঁুড়ে দিয়ে বলেন, এ সংক্রান্ত প্রমাণ থাকলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে পেশ করুন৷ যদি প্রমাণ দিতে ব্যর্থ হন তাহলে পদত্যাগ করুন৷
এদিন, শ্রীধর দাবি করে বলেন, প্রয়াত স্বাস্থ্যমন্ত্রী বিমল সিনহা ও তাঁর ভাই বিদ্যুৎ সিনহার হত্যাকান্ডে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী জড়িত এমন কোন তথ্যই ইউসুফ কমিশনের রিপোর্টে নেই৷ অথচ বিরোধীরা মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে কুৎসা রটিয়ে উস্কানি দেওয়ার চেষ্টা করছেন৷ এদিন তিনি অভিযোগ করে বলেন, রাজ্যের শান্তি সম্প্রীতি ও উন্নয়ন দুর্বল করার জন্য এবং বামফ্রন্টকে দুর্বল করার লক্ষ্যে রাজনীতি চালিয়ে যাচ্ছে বিরোধীরা৷ ঘরে বাইরে জনগণ তাদের প্রত্যাখান করেছে৷ মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে মিথ্যা কল্পিত অভিযোগ তাদের কফিনে গুরুত্বপূর্ণ প্যারেক মারতে সাহায্য করেছে৷ এদিন, সিপিএম কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য গৌতম দাশও একই সুরে বিরোধীদের কটাক্ষ করেন৷ তিনি বলেন, মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অত্যন্ত উস্কানিমূলক মন্তব্য করেছেন বিরোধী দলনেতা৷ প্রয়াত স্বাস্থ্যমন্ত্রী মুখ্যমন্ত্রী হওয়া নিয়ে যে গল্প সাজানো হয়েছে এই ধরনের সংসৃকতি সিপিএমে নেই৷ তিনি দাবি করে বলেন, কংগ্রেস নেতিবাচক রাজনীতিতে মত্ত হয়ে উঠেছে৷ তিনিও মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে আনা সমস্ত অভিযোগের সত্যতা প্রমাণের চ্যালেঞ্জ ছঁুড়ে দেন বিরোধী কংগ্রেসের দিকে৷ সত্যতা প্রমাণ করতে না পারলে বিধায়ক পদ থেকে ইস্তফা দেওয়ার দাবি তিনিও জানিয়েছেন৷