আগরতলা, ২৩ মার্চ (হি.স.)৷৷ নেশামুক্ত ত্রিপুরা গড়ার লক্ষ্যে এনডিপিএস আইনকে আরও কঠোর করার বিষয়ে কেন্দ্রের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে ত্রিপুরা সরকার৷ আজ মঙ্গলবার রাজ্য বিধানসভাকে আশ্বস্ত করলেন মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেব৷ কারণ নেশাদ্রব্যের ব্যবহার বৃদ্ধি খুবই উদ্বেগজনক, চিন্তা ব্যক্ত করে বলেন তিনি৷ তবে, ত্রিপুরায় সরকার পরিবর্তন হওয়ার পর গত তিন বছরে বেআইনি নেশা কারবারে অনেকটা লাগাম টানা সম্ভব হয়েছে, দাবি করেন মুখ্যমন্ত্রী৷ তাঁর কথায়, ২০১৮ সালে নেশা কারবারের সাথে যুক্ত ৬৬০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং ৪৩৩টি মামলা নিয়েছে পুলিশ৷ যা পূর্বতন সরকারের আমলে গৃহীত উদ্যোগের তুলনায় অনেক বেশি৷
আজ ত্রিপুরা বিধানসভায় বাজেট অধিবেশনের তৃতীয় দিনে বিধায়ক সুদীপ রায়বর্মণের নেশামুক্ত ত্রিপুরা গড়ার লক্ষ্যে এনডিপিএস আইন আরও কঠোর করার জন্য ত্রিপুরা সরকারের তরফ থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রকের দৃষ্টি আকর্ষণের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে উল্লেখ পর্বে উত্থাপিত নোটিশের জবাবে মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেব বিবৃতি দেন৷
এদিন তিনি বলেন, ২০১৮ সালে ত্রিপুরায় নতুন সরকার গঠিত হওয়ার পর বিভিন্ন নেশা সামগ্রী যেমন গাঁজা, ফেন্সিডিল, ট্যাবলেট, হেরোইন ইত্যাদির ব্যাপক ব্যবহারে রাজ্যের জনমানসে, বিশেষত যুবসমাজে এর ক্ষতিকর প্রভাব লক্ষ্য করে ‘‘নেশা মুক্ত ত্রিপুরা’ গঠন করার লক্ষ্য নেওয়া হয়েছিল৷ এরই ভিত্তিতে ত্রিপুরায় বিভিন্ন বেআইনি নেশা বিরোধী অভিযান তীব্র করা হয়েছিল৷ তাতে ত্রিপুরায় বিরাট পরিমাণ বেআইনি গাঁজা, ফেন্সিডিল, ট্যাবলেট, হেরোইন ইত্যাদি নেশাদ্রব্য বাজেয়াপ্ত এবং সংশ্লিষ্ট মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তি, সহযোগী, নেশাদ্রব্য চালানকারিদের গ্রেফতার করা হয়েছে৷ এছাড়া নেশাজাতীয় দ্রব্যের উৎপাদনের ক্ষেত্রেও বাধা তৈরি করা হয়েছে, বলেন তিনি৷
তিনি জানান, বিভিন্ন নেশাসামগ্রীর এই অবৈধ কারবার মূলত রাজ্যের সীমান্তবর্তী এলাকায় প্রবল, তার অনেক প্রমাণ মিলেছে৷ ওই সব নেশাসামগ্রী সুকল, কলেজের ছাত্রছাত্রীসহ সমাজের সব অংশের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে সমাজে এক অস্থির পরিবেশ তৈরি করার চেষ্টা হয়েছে৷ কিন্তু প্রকৃত নেশা কারবারিরা সব সময়ই আইনের ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে৷ তিনি বলেন, শুধুমাত্র নেশাসামগ্রী এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নেওয়ার কাজে যুক্তদের আটক করে বিচার ব্যবস্থার আওতায় আনা হয়েছে৷ তাই ত্রিপুরা সরকার গুরুত্ব সহকারে এনডিপিএস আইন ১৯৮৫ এবং পিআইটি এনডিপিএস আইন ১৯৮৮-এর সঠিক প্রয়োগ শুরু হয় এবং এর ফলেই বেআইনি নেশাজাতীয় দ্রব্য পাচারকারী, সহযোগী এবং যারা সাধারনত পর্দার আড়ালে থেকে নেশা কারবার নিয়ন্ত্রণ করে তাদের চিহ্ণিত করা এবং উপযুক্ত ধারা মোতাবেক তাদের গ্রেফতার ও আটক করা বর্তমানে সম্ভব হচ্ছে৷
মুখ্যমন্ত্রী দাবি করেন, নেশামুক্ত ত্রিপুরা গড়ার লক্ষ্যে রাজ্য পুলিশ নারকোটিক্স কন্েন্টাল ব্যুরোর সাহায্য নিয়ে এবং তাদের সহযোগে এই সময়ের মধ্যে নেশা কারবারি যারা গাঁজা, ফেন্সিডিল, ট্যবলেট, হেরোইন ইত্যাদি বেআইনি সামগ্রী নিয়ে কাজ করে তাদের বিরুদ্ধে বহু সফল অভিযান চালাতে সক্ষম হয়েছে৷ তাছাড়াও আরেকটি কেন্দ্রীয় এজেন্সি ডিরেক্টরেট অব রেভিনিউ ইন্টেলিজেন্স (ডিআরআই) রাজ্যে বেআইনি নেশাজাতীয় দ্রব্য পাচারের বিরুদ্ধে কাজ করে থাকে৷ তিনি বলেন, ডিআরআই-এর সঙ্গে রাজ্য পুলিশের যৌথ উদ্যোগে বেআইনি নেশা জাতীয় দ্রব্যের বিরুদ্ধে সফল অভিযান সংগঠিত করা গেছে৷
মুখ্যমন্ত্রী বলেন, এনডিপিএস আইন ১৯৮৫ এবং পিআইটি এনডিপিএস আইন ১৯৮৮ হল বিশেষ আইন এবং এই আইনের ধারাগুলির সঠিক প্রয়োগে তদন্তকারী অফিসারদের উপযুক্ত ট্রেনিং দেওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় এজেন্সির সহায়তায় ফিল্ড লেভেল অফিসার এবং সুপারভাইজারি লেভেলের অফিসারদের ত্রিপুরায় এবং ত্রিপুরার বাইরে উপযুক্ত ট্রেনিঙের ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ তাঁর দাবি, নেশা জাতীয় সমস্ত দ্রব্য নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় সরকারও সার্বিক পদক্ষেপ নিয়েছে৷ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রতিনিধি, বিভিন্ন কেন্দ্রীয় বাহিনীর প্রতিনিধি, পার্শবর্তী দেশসমূহ যথা বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ এবং রাষ্ট্রপুঞ্জের কর্মকর্তার উপস্থিতিতে সেমিনার এবং ট্রেনিং প্রোগ্রাম করা হয়েছে৷ তাতে নেশা বিরোধী কার্যক্রমে সুফল পাওয়া গেছে৷
বিপ্লব দেব বলেন, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে নারকোটিক্স কন্েন্টাল ব্যুরো কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি এবং সমগ্র উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে আগরতলায় একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত করেছে৷ ওই সেমিনারে নেশা কারবারিদের বিরুদ্ধে পিআইটি এনডিপিএস আইন ১৯৮৮-এর ৩ নম্বর ধারা প্রয়োগে এবং নেশা পাচারের সঙ্গে যুক্তদের কাছ থেকে সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণে ত্রিপুরা পুলিশের পদক্ষেপের প্রশংসা করা হয়েছে৷
মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যে পাল্টা স্পষ্টিকরণ চেয়ে বিধায়ক সুদীপ রায়বর্মণ বলেন, এনডিপিএস আইন ১৯৮৫-এর ২১(এ) এবং ২৭ ধারা ও পিআইটি এনডিপিএস আইন ১৯৮৮-এর ১১ ধারা সংশোধন খুব জরুরি৷ কারণ, আইন কঠোর না হওয়ায় অপরাধীরা জামিন পেয়ে যাচ্ছে এবং বেআইনি ব্যবসা জারি রেখেছে৷
সুদীপবাবুর কথায়, এনডিপিএস আইন ১৯৮৫-এর ২১(এ) এবং ২৭ ধারা জামিন অযোগ্য এবং পিআইটি এনডিপিএস আইন ১৯৮৮-এর ১১ ধারায় ২ বছরের কারাবাসের সাজার ব্যবস্থা হোক৷ এক্ষেত্রে কেন্দ্রের কাছে প্রস্তাব পাঠিয়ে আইন সংশোধনের প্রয়োজন৷ তাঁর বক্তব্য, জামিনযোগ্য ধারায় মামলা হওয়ায় নেশাকারবারিরা সহজে পার পেয়ে যায়৷ সাথে তিনি যোগ করেন, যুব সমাজকে ধবংসের পথ থেকে উদ্ধারে সারা ত্রিপুরায় নেশামুক্তি কেন্দ্র স্থাপনের বিশেষ প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে৷
তার জবাবে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ত্রিপুরায় সরকার পরিবর্তন হওয়ার পর থেকে বেড়েছে মামলার হার৷ সাথে বেড়েছে গ্রেফতারের সংখ্যাও৷ তাঁর দাবি, ২০১৭ সালে বেআইনি নেশা কারবারের ৮৩টি মামলা হয়েছিল এবং ৬৫ জনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছিল৷ সেই তুলনায় ২০১৮ সালে ৪৩৩টি মামলা হয়েছে এবং ৬৬০ জনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে৷
এদিন মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ত্রিপুরায় নেশাসামগ্রী প্রতিবেশী রাজ্য এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্র থেকে ঢুকছে৷ এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ হিসেবে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সম্প্রতি উত্তরপূর্ব কাউন্সিলের বৈঠকে বিস্তারিত বক্তব্য পেশ করেছেন৷ শুধু তা-ই নয়, ২০২২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে পূবর্োত্তরকে নেশা মুক্ত করার লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি৷ তিনি আজ বিধানসভায় আশ্বাস দেন, আইন আরও কঠোর করার বিষয়টি কেন্দ্রের দৃষ্টিতে নেওয়া হবে৷ এছাড়া ত্রিপুরায় আরও একটি নেশামুক্তি কেন্দ্র স্থাপনে সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সমাজ কল্যাণ মন্ত্রী ঘোষণা করেছেন৷