রবীন্দ্র কিশোর সিনহা
বিশ্বব্যাপী মহামারী করোনার জেরে সমগ্র পৃথিবীর হাত – পা ফুলে উঠেছে। ভয় ও আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এরই মধ্যে ভারতের জন্য একটা সুযোগ তৈরি হচ্ছে। সারা বিশ্বের উৎপাদনের কেন্দ্র হতে পারে ভারত।সেই সুযোগ এখন ভারতের সামনে রয়েছে। আন্তজার্তিক মঞ্চে চিনের বিরুদ্ধে একটা নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়েছে।সেটিকে আর্থিক দিক দিয়ে কাজে লাগানো উচিত ভারতের।এই সুযোগকে কোনও ভাবেই হাতছাড়া করা উচিত নয়।এই সময় দেশের নীতিনির্ধারকদের উচিত বিদেশী বিনিয়োগকারিদের ভারতে বিনিয়োগ করার জন্য আকৃষ্ট করা। কিন্তু এটা কি সম্ভব? আসলে পৃথিবীতে অসম্ভব কিছু নেই। তবে এর জন্য ভারতের সরকারী বিভাগগুলির অন্দরে দুর্নীতি ও লাল ফিতে সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার জন্য উঠে পড়ে লাগতে হবে।এই বিষয়ে সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। অকর্মণ্য সরকারী আমলাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।বিনিয়োগের বিধিগুলি সরল ও নমনীয় করতে হবে। বিদেশী বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে যথাযথ সম্মানের দিয়ে আচরণ করতে হবে। যারা আমাদের দেশে বিনিয়োগের অভিপ্রায় নিয়ে মূলধন নিয়ে আসবে তাদের সমস্ত সমস্ত সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে।যে আমলা ভাল কাজ করছে তাদের উৎসাহ দিতে হবে।
চিনের সঙ্গে তার বাণিজ্যিক সম্পর্ক সীমিত করার ঘোষণা ইতিমধ্যেই করে দিয়েছে জাপান সরকার। চিনে যে সকল মার্কিন বাণিজ্যিক সংস্থা বিনিয়োগ করেছিল তারাও এখন একই পথে হাঁটছে।জাপানের সঙ্গে ভারতের অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে।ভারতে বিপুল বিনিয়োগ করেছে জাপান।ভগবান বুদ্ধের দেশ হওয়ায় জাপান খুব শ্রদ্ধার সঙ্গে ভারতকে দেখে।জাপান ভারতে বুলেট ট্রেন প্রকল্প শুরু করছে।জাপান এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য ভারতের সঙ্গে যে চুক্তি করেছে তা প্রমাণ করে যে জাপান ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসাবে ভারতকে শ্রদ্ধা করেছে। এটি অবশ্যই সাধারণ ঘটনা নয়। গোটা বিশ্বে যে নতুন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তাতে ভারতকে প্রস্তুত হতে হবে।চিন থেকে যে বিনিয়োগ জাপান অনত্র সরিয়ে নিচ্ছে, তা যাতে ভারতে আসে সেটা নিশ্চিত করতে হবে।কমপক্ষে একটি বড় অংশের বিনিয়োগ ভারতে আনা প্রযোজন। ভারত যদি নিজেকে উন্নত করে তবে জাপান, ভিয়েতনাম, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া থেকে বিনিয়োগ আসবে এ দেশে। এই দেশগুলির বিনিয়োগকারীদের উন্নত পরিবেশ দিতে হবে। আমরা কি তাদের সর্বোত্তম পরিবেশ দিতে পারি? কিছু মনে করবেন না, এই ক্ষেত্রে আমরা এখনও অবধি আমরা দুর্বল, তা প্রমাণিত।
চিনে করোনা সংক্রমণ তৈরি হওয়ার আগেই দক্ষিণ কোরিয়ার কোম্পানীগুলি সে দেশ থেকে নিজেদের যাবতীয় কর্মকাণ্ড গুটিয়ে নিয়ে ভিয়েতনামের দিকে চলে গেল।বিদেশী বিনিয়োগকারীদের ভারতে উত্ত্যক্ত করার চেষ্টা করা হয়। সেই কারণেই এই সকল বিনিয়োগ ভারতে আসে না। দুর্নীতিগ্রস্থ আমলাতন্ত্র এবং জটিল নিয়মের জেরে বিনিয়োগকারীরা ভারত ছেড়ে ভিয়েতনামের দিকে পাড়ি জমাচ্ছে।বর্তমানে দক্ষিণ কোরিয়া ৭০০০ বেশি কোম্পানি ভিয়েতনামে বিনিয়োগ করেছে। এতগুলি কোম্পানি এদেশে বিনিয়োগ করলে ভারতের ভাগ্য উজ্জ্বল হয়ে যেত।কয়েক কোটি যুবকের কর্মসংস্থান হত। তবে আমরা এই দুর্দান্ত সুযোগটি হাতছাড়া করেছি।হ্যাঁ, এটি সত্য যে প্রায় ৭০০ টি দক্ষিণ কোরিয়ান সংস্থা ভারতে বিনিয়োগ করেছে।তবে এখানে সাত হাজার আর ৭০০ মধ্যে পার্থক্য রয়েছে।ভারতে কোরিয়ান সংস্থাগুলির বিনিয়োগ পর্যবেক্ষণ করেছেন এমন অনেক বিশেষজ্ঞ আমাকে বলেছিলেন যে গত চার-পাঁচ বছরে ভারতীয় প্রশাসন চিনে বিনিয়োগ করা জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়াকে এ দেশে বিনিয়োগ করাতে ব্যর্থ হয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ার সংস্থাগুলি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতে বিনিয়োগ করতে বেশি আগ্রহী। ভারতে দক্ষিণ কোরিয়ার দূতাবাসের রাজনৈতিক বিষয়ক আধিকারিক ইউ চ্যাং-হো বলেছেন, মূলত দুটি কারণে দক্ষিণ কোরিয়ার সংস্থাগুলিকে চীন ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল।প্রথমত, চিনা সংস্থা কোরিয়ান সংস্থাগুলির প্রযুক্তি নকল করে নিচ্ছিল।দ্বিতীয়ত, কোরিয়ান সংস্থাগুলিতে শ্রমিকদের পেছনে খরচ বেড়েই চলেছিল।
কিন্তু এখনও ভারতের হাত থেকে সমস্ত সুযোগ বেরিয়ে যায়নি। প্রচেষ্টা যদি সুদৃঢ় হয় তবে নিশ্চই ফের জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় দেশগুলির থেকে বড় বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ করতে পারব। ভারত গত তিরিশ বছরে তথ্যপ্রযুক্তি ও উৎপাদন শিল্পে একটি বড় শক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে। যদি আমরা উৎপাদন ক্ষেত্রের কথা বলি তবে মহারাষ্ট্রের চকান, কর্ণাটকের হোসপেট, হরিয়ানার মনেসর, উত্তর প্রদেশের গ্রেটার নয়ডা, হিমাচলের বাড্ডি মত শহরগুলি উৎপাদন শিল্পে কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। এর মূল কারণ হচ্ছে এই সকল রাজ্যগুলো যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে।এর মধ্যে কর মুকুব থেকে শুরু করে ভালো সড়ক ও রেল পরিবহন ব্যবস্থা।
গ্রেটার নয়েডায়, বৈদ্যুতিন পণ্য এবং অটোমোবাইল ক্ষেত্রে উৎপাদন ভাল পরিমাণে হচ্ছে।এখানে দক্ষিণ কোরিয়ার এলজি ইলেক্ট্রনিক্স, মোসার বেয়র, ইয়ামাহা, নিউ হল্যান্ড ট্রাক্টর, ভিডিওকন ইন্টারন্যাশনাল, শ্রী রাম হণ্ডা পাওয়ার ইকুইপমেন্ট ও হোন্ডা সিয়েল গাড়ি তৈরি হচ্ছে। এগুলি তাদের নিজ ক্ষেত্রে শীর্ষস্থানীয় কোম্পানি।
এখন, যদি আপনি হরিয়ানার প্রধান শিল্প নগরী মানেসারের কথা বলেন, তবে মানেসরে অটো এবং অটো যন্ত্রাংশ অনেকগুলি ইউনিট তৈরি করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে মারুতি সুজুকি, হোন্ডা মোটরসাইকেল ও স্কুটার ইন্ডিয়া লিমিটেড। এগুলোতে দেশের হাজার হাজার লোক কাজ করে। আপনি মানেসারকে উত্তর ভারতের শ্রীপেরুম্বুদুর হিসাবে বিবেচনা করতে পারেন। তামিলনাড়ুর শ্রীপেরুম্বুদুরে, অটো সেক্টর থেকে কমপক্ষে ১২ টি বড় কোম্পানি উৎপাদন করে চলেছে। এবার মহারাষ্ট্রের চকানের একটি উদাহরণ নেওয়া যাক। চকান মুম্বই থেকে ১৬০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এটিতে বাজাজ অটো এবং টাটা মোটরগুলির ইউনিট রয়েছে। আপনি বুঝতে পারেন যে এই দুটি বড় সংস্থার ইউনিট আসার পরে, চকান নিজেই একটি বিশেষ উৎপাদন কেন্দ্রের রূপ নিয়েছে। মহিন্দ্রও এখানে নিজস্ব ইউনিট স্থাপন করতে চলেছে। ভক্সওয়াগেনও এখানে এসে পৌঁছেছে। এটি অটো সেক্টরের একটি বড়ো সংস্থাও।
আসলে, এই উদাহরণগুলি দেওয়ার পিছনে উদ্দেশ্যটি হল যে কোনও দেশ বা রাজ্যে বিনিয়োগকারী তখনই আসে যখন তিনি বিভিন্ন ধরণের সুযোগ সুবিধা পান।দেশী এবং বিদেশী বিনিয়োগ উপরোক্ত হাবগুলিতে আসছে কারণ এই রাজ্যগুলি বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি পরিবেশ তৈরি করেছে।ভারত কি করোনা পরিস্থিতিতে বৈদেশিক বিনিয়োগ নিজের দিকে আকর্ষণ করতে পারবে? অবশ্যই এটি করতে হবে।এটা অবশ্যই হচ্ছে। মনে রাখবেন বিদেশী বিনিয়োগকারীরা ছাড়া কোনও দেশই দ্রুত অগ্রগতির পথে হাঁটতে পারে না।
(লেখক বরিষ্ঠ সম্পাদক ও রাজ্যসভার প্রাক্তন সাংসদ)