নিজস্ব প্রতিনিধি, আগরতলা, ২০ মার্চ৷৷ করোনা ভাইরাসের সতর্কতা হিসেবে বিধানসভার বাজেট অধিবেশনের সময় কমানোর দাবি উঠেছে৷ শুক্রবার বিধানসভার ট্রেজারি বেঞ্চের সদস্য রতন চক্রবর্তী করোনা ভাইরাসের ভয়াবহতার বর্ণনা দিয়ে অধিবেশনের সময় কমানোর আবেদন জানান৷ তাঁর এই প্রস্তাবে সম্মতি দেন ট্রেজারি বেঞ্চের অপর দুই সদস্য ডা. অতুল দেববর্মা এবং ডা. দিলীপ দাস৷ সম্মতি দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার ত্রিপুরায় করোনা ভাইরাস নিয়ে পরিস্থিতির বিস্তারিত বর্ণনা দেন৷ মুখ্যমন্ত্রীর দাবি, ত্রিপুরায় এখনও আতঙ্কের কোনও প্রয়োজন নেই৷ তবে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে৷
এদিন বিধানসভার ট্রেজারি বেঞ্চের সদস্য রতন চক্রবর্তী, ডা. অতুল দেববর্মা এবং ডা. দিলীপ দাস করোনা ভাইরাস সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেন৷ এই ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাঁচতে প্রয়োজনীয় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে বিধানসভা অধিবেশনের সময় কমানোর দাবি তুলেন তাঁরা৷ তাঁদের বক্তব্য, সতর্কতা অবলম্বন করা খুবই জরুরি৷ কারণ, এখন ভারত করোনা ভাইরাস স্টেজ ২ পর্যায়ে রয়েছে৷ কিন্তু, ওই ভাইরাস সামাজিকভাবে ছড়িয়ে পড়লে এর ভয়াবহতা থেকে রেহাই পাওয়া অসম্ভব৷
ডা. অতুল দেববর্মা এবং ডা. দিলীপ দাসের বক্তব্য, করোনা ভাইরাস সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা না হলে মানুষ অজ্ঞানে ওই রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়বেন৷ সে-ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন অত্যন্ত জরুরি বলে দাবি করেন তাঁরা৷
এদিকে, বিধানসভার অধিবেশনের সময়কাল কমানোর বিষয়ে অধ্যক্ষের সম্মতি চাওয়া হলে তিনি মুখ্যমন্ত্রীর সম্মতি রয়েছে কিনা জানতে চান৷ মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেব তখন করোনা ভাইরাসের বর্তমান পরিস্থিতির বর্ণনা দেন এবং বিজনেস অ্যাডভাইজারি কমিটির বৈঠক ডেকে বিধানসভা অধিবেশনের সময় কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য সম্মতি দেন৷
এদিন মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ত্রিপুরায় দুটি ইন্টেন্সিফাই স্ক্রিনিং পয়েন্ট কার্যকর করা হয়েছে৷ এমবিবি বিমানবন্দর এবং আখাউরা চেকপোস্ট৷ তাঁর কথায়, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের নির্দেশ আনুযায়ী রাজ্যের অন্য চেকপোস্টগুলি বন্ধ রয়েছে৷ সাথে দুই সীমান্ত হাটও বন্ধ রাখা হয়েছে৷ তিনি বলেন, ধর্মনগর, আগরতলা, উদয়পুর শহরে রেল স্টেশনগুলিতে হেল্পডেস্ক এবং স্ক্রিনিং পয়েন্ট খোলা হয়েছে৷ সাথে সচেতনতামূলক কর্মসূচিও গ্রহণ করা হয়েছে৷ এছাড়া, বড় বাস স্ট্যান্ডগুলিতেও হেল্পডেস্ক খোলা হয়েছে এবং সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে৷
তাঁর দাবি, ১৭০ জন মেডিক্যাল অফিসারকে পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য এই ভাইরাস সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে৷ পাশাপাশি, আইসোলেশনের জন্য আগরতলা সরকারি মেডিক্যাল কলেজ অ্যান্ড জিবিপি হাসপাতাল এবং ত্রিপুরা মেডিক্যাল কলেজকে চিহ্ণিত করা হয়েছে৷ ওই হাসপাতালগুলিতে ১১টি করে শয্যা রয়েছে৷ সেখানেই রোগীর চিকিৎসা করা হবে, জানান মুখ্যমন্ত্রী৷
মুখ্যমন্ত্রী বলেন, সন্দেহজনক ব্যক্তিকে কোয়ারেন্টাইনে পৃথকভাবে রাখার জন্য ইতিমধ্যে ত্রিপুরায় ৪-টি স্থান চিহ্ণিত করা হয়েছে৷ এনটিআই ভবন, আগরতলা, দক্ষিণ ত্রিপুরার দেবদারু প্রাথমিক স্বাস্থ্যক্যেন্দ্রর নতুন নির্মিত ভবন, খোয়াই জেলায় চম্পাহাওয়ার প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের নতুন নির্মিত ভবন এবং উত্তর ত্রিপুরার রাজনগর প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের নবনির্মিত ভবনকে কোয়ারেন্টাইনের জন্য চিহ্ণিত করা হয়েছে৷ তাঁর দাবি, এই রোগের বিস্তারকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ত্রিপুরা সরকার ১০ মার্চ এবং ১৩ মার্চ বিশেষ বিজ্ঞপ্তি জারি করেছিল৷ তাতে জনসমাগম এড়াতে বলা হয়েছে৷ সাথে তিনি যোগ করেন, ১৩ মার্চ ত্রিপুরা সরকার মহামারি রোগ আইন ১৮৯৭ সম্পর্কিত একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে৷ তাতে স্বাস্থ্যকর্মী ও অন্যান্যদের নির্দিষ্ট দায়িত্বের কথা উল্লেখ করা হয়েছে৷ চিকিৎসাজনিত ক্ষেত্র ছাড়া স্বাস্থ্যকর্মীদের ছুটি বন্ধ করার জন্য স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ দফতর থেকে নির্দেশ জারি করা হয়েছে, জানান তিনি৷ তাঁর আরও দাবি, শিক্ষা দফতরের বিজ্ঞপ্তি অনুসারে সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেমন সুকল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি বন্ধ রয়েছে৷
এদিকে, রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের পক্ষ থেকে ৬ লক্ষ লিফলেট জনসচেতনতার জন্য ঘরে ঘরে পৌঁছানো হচ্ছে বলে জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী৷ তাঁর কথায়, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য ত্রিপুরা সরকার প্রত্যেক জেলাশাসকদের ১৪৪ ধারা প্রয়োগ করার জন্য নির্দেশ দিয়েছে৷ তাতে জনসাধারণের মধ্যে এই ভাইরাস সংক্রামন আটকানো সম্ভব হবে বলে মনে করেন তিনি৷ তাঁর দাবি, করোনা মোকাবিলার জন্য ৫০টি ইনফ্রারেড থামর্োমিটার, ২০০০ পিপিই, ৫০,০০০ তিনস্তর বিশিষ্ট মাস্ক এবং ৩০০০ এন ৯৫ মাস্ক, প্রয়োজনীয় সামগ্রীর ব্যবস্থা করতে ভারত সরকারের কাছে আবেদন জানানো হয়েছে৷
অন্যদিকে, করোনা ভাইরাস নিয়ে জিবি এবং আইজিএম হাসপাতালে ভেন্টিলেটরের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চান ট্রেজারি বেঞ্চের সদস্য প্রাক্তন স্বাস্থ্যমন্ত্রী সুদীপ রায়বর্মণ৷ তাঁর বক্তব্য, করোনা ভাইরাসের সমস্ত পরিস্থিতি মোকাবিলায় ত্রিপুরা সরকারকে সব রকমভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে৷ এক্ষেত্রে কোনও কিছুর ঘাটতি থাকলে তা যুদ্ধকালীন তৎপরতায় সংগ্রহ করতে হবে৷ এ-বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, আজ বিধানসভা অধিবেশন শেষে মুখ্যসচিব ও অন্যান্য সচিবদের নিয়ে করোনা ভাইরাসের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে পর্যালোচনা করবেন এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন৷
ত্রিপুরায় করোনা ভাইরাসে সংক্রমিত সন্দেহে এখন পর্যন্ত ৯৪ জন নজরদারিতে ছিলেন৷ তাঁদের মধ্যে পর্যবেক্ষণের সময়কাল শেষ করেছেন ২৪ জন৷ বাকি ৭০ জন এখনও নজরদারিতে রয়েছেন৷ শুক্রবার ত্রিপুরা বিধানসভার বাজেট অধিবেশনে এই তথ্য দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেব৷ তাঁর কথায়, করোনা সংক্রমণ সন্দেহে নজরদারিতে রাখা একজনও ত্রিপুরায় স্থায়ীভাবে বসবাস করেন না৷ তাঁরা করোনা আক্রান্ত দেশ ভ্রমণ করেছিলেন৷ তাই তাঁদের পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হচ্ছে৷ তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নজরদারিতে রয়েছেন যাঁরা তাঁরা বাংলাদেশ থেকে ত্রিপুরায় এসেছেন৷
মুখ্যমন্ত্রী বলেন, পশ্চিম ত্রিপুরা জেলায় এখন পর্যন্ত ৪৪ জন করোনা ভাইরাস সংক্রমিত সন্দেহে নজরদারিতে ছিলেন৷ তাঁদের মধ্যে পর্যবেক্ষণের সময়কাল শেষ করেছেন ২৩ জন, বাকি নজরদারিতে রয়েছেন ২১ জন৷ অবশ্য, তাঁদের মধ্যে ৩ জনকে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে, তাঁদের রক্তের নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে৷ কিন্তু কোনও সংক্রমিত রোগী পাওয়া যায়নি৷ তিনি বলেন, একইভাবে গোমতি জেলায় ১৯ জনকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে৷ তাঁদের এখনও পর্যবেক্ষণের সময় সমাপ্ত হয়নি৷ তবে, তাঁদের কাউকেই হাসপাতালে পাঠানো হয়নি৷ তেমনি দক্ষিণ ত্রিপুরায় ১৫ জন, ঊনকোটি জেলায় ৩ জন এবং উত্তর ত্রিপুরা জেলায় ১ জনকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে৷ তাঁদেরও পর্যবেক্ষণের সময়কাল সমাপ্ত হয়নি এবং তাঁদের বাড়িতেই নজরদারিতে রাখা হয়েছে৷
মুখ্যমন্ত্রী আরও জানান, সিপাহিজলা জেলায় ৭ জনকে নজরদারিতে রাখা হয়েছিল৷ তাঁদের মধ্যে ১ জনের পর্যবেক্ষণের সময় সমাপ্ত হয়েছে৷ বাকি ছয় জনের নজরদারি চলছে৷ তাঁদের মধ্যে একজনকে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে৷ তাঁর রক্তের নমুনা পরীক্ষা করা হলেও কোনও ভাইরাসের সংক্রমণ পাওয়া যায়নি৷ তেমনি, ধলাই জেলায় ৫ জনকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে৷ তাঁদের মধ্যে একজনকে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে৷ কিন্তু তাঁর রক্তে করোনা ভাইরাসের প্রমাণ পাওয়া যায়নি৷ তিনি বলেন, খোয়াই জেলায় এখনও কাউকে নজরদারিতে রাখা হয়নি৷
তাঁর কথায়, সারা ত্রিপুরায় ৯৪ জনকে নজরদারিতে রাখা হয়েছিল৷ তাঁদের মধ্যে ২৪ জনের পর্যবেক্ষণের সময় সমাপ্ত হয়েছে৷ বাকি ৭০ জন নজরদারিতে রয়েছেন৷ তাঁদের মধ্যে ৫ জনকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল৷ কিন্তু কারোর রক্তে করোনা ভাইরাস পাওয়া যায়নি৷
মুখ্যমন্ত্রী এদিন আরও জানান, চীন থেকে ৬ জন, ইতালি থেকে ১ জন, হংকং থেকে ১ জন, থাইল্যান্ড থেকে ১৭ জন, মালয়েশিয়া থেকে ৪ জন, সিঙ্গাপুর থেকে ৫ জন, জার্মানি থেকে ২ জন, বাংলাদেশ থেকে ২১ জন, কুয়েত থেকে ১ জন, ইউকে থেকে ১ জন, ইউএই থেকে ১১ জন, সৌদি আরব থেকে ১৩ জন, বেলজিয়াম থেকে ১ জন, ফ্রান্স থেকে ১ জন, ইউএসএ থেকে ২ জন, ওমান থেকে ২ জন, মরিশাস থেকে ১ জন এবং দেশের অন্য কোন প্রান্ত থেকে ভ্রমণ করে ত্রিপুরায় এসেছেন এমন ৪ জনকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে৷ তিনি বলেন, করোনা আক্রান্ত সন্দেহে নজরদারিতে রয়েছেন একজনও ত্রিপুরার স্থায়ী বসবাসকারী নন৷