নিজস্ব প্রতিনিধি, আগরতলা, ২৮ নভেম্বর৷৷ উন্মুক্ত সীমান্ত ত্রিপুরায় বিএসএফের জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ কারণ, তাদের হাত বেঁধে রেখেছে কেন্দ্রীয় সরকার৷ ফলে, চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই সীমান্ত রক্ষার দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে বিএসএফের৷ বৃহস্পতিবার বিএসএফ ত্রিপুরা ফ্রন্টিয়ারের আইজি সলোমোন ইয়াশ কুমার মিঞ্জ এভাবেই তাদের কাজের বর্ণনা দিয়েছেন৷ তাঁর দাবি, ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এবং নানা জটিলতায় সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ এখনও অসম্পূর্ণ রয়েছে৷ এদিকে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন এনএলএফটির ঘাঁটি রয়েছে বলে দাবি করেছেন আইজি৷ সাথে তিনি যোগ করেন, রাজ্যে পাচারের পদ্ধতিগত পরিবর্তন হয়েছে৷ ফেন্সিডিল কিংবা গাঁজার বদলে ইয়াবা টেবলেটের পাচার বেড়েছে৷
![](https://jagarantripura.com/wp-content/uploads/2019/11/DSC_0599-1024x681.jpg)
এদিন তিনি জানিয়েছেন, ত্রিপুরায় বিএসএফের ১৮টি ব্যাটালিয়ন রয়েছে৷ সীমান্ত নিরাপত্তায় অতন্দ্র প্রহরীর দায়িত্ব পালন করছেন বিএসএফ জওয়ানরা৷ তাই ত্রিপুরায় সীমান্ত অনেকটাই নিরাপদে রয়েছে৷ তাঁর কথায়, সিপাহিজলা জেলার শ্রীমন্তপুর ভারত-বাংলা সীমান্ত নেশাসামগ্রী পাচারে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে৷ তাছাড়া দক্ষিণ সাব্রুমের সীমান্ত দিয়ে গবাদি পশু পাচার সবচেয়ে বেশি হচ্ছে৷ তবে, বিএসএফের কড়া নজরদারির কারণে এখন ওই সীমান্ত দিয়েও পাচার অনেকটাই কমেছে৷
বিএসএফ ত্রিপুরা ফ্রন্টিয়ারের আইজি বলেন, ত্রিপুরায় সব ঋতুতে ৮৫৬ কিলোমিটার সীমান্ত সুরক্ষার দায়িত্বে রয়েছে বিএসএফ৷ প্রতিদিন নতুন অধ্যায় রচিত হচ্ছে৷ কঠিন পরিস্থিতি সত্ত্বেও একটি সংগঠিত দল হিসেবে বিএসএফ প্রতিনিয়ত সীমান্ত সুরক্ষা করে চলেছে৷
তিনি জানান, ভৌগোলিকগত অবস্থানের কারণে ত্রিপুরায় পুরো সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না৷ কারণ, সীমান্তের একটি বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছে নদী৷ তাছাড়া, জমি জটের কারণেও সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণে জটিলতা হচ্ছে৷ এদিন তিনি দাবি করেন, উন্মুক্ত সীমান্ত ত্রিপুরায় পাচার বাণিজ্য বন্ধে বিরাট চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে হচ্ছে বিএসএফকে৷ তাঁর কথায়, আপাতত ত্রিপুরায় ৬৬ কিলোমিটার সীমান্ত এলাকায় কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের কাজ অবশিষ্ট রয়েছে৷ সেখানে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের কাজে অগ্রগতি হচ্ছে৷
বিএসএফ ত্রিপুরা ফ্রন্টিয়ারের আইজি বলেন, ত্রিপুরায় সীমান্ত রক্ষায় তাদেরকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া হচ্ছে না৷ অবশ্য, ত্রিপুরায় ভারত-বাংলা সীমান্ত পাকিস্তান সীমান্তের সমতুল্য নয়৷ তাঁর কথায়, ত্রিপুরায় সীমান্তে প্রহরার সময় জওয়ানরা নন ল্যাথেল অস্ত্র ব্যবহার করেন৷ তাঁর দাবি, অনেক ক্ষেত্রে পাচারকারীদের প্রতিরোধ করার সময় জওয়ানদের আক্রমণের মুখে পড়তে হয়৷ শুধু তা-ই নয়, বিভিন্ন সময় গ্রামবাসীরাও বিএসএফ জওয়ানদের লক্ষ্য করে হামলা চালিয়ে থাকেন৷ এক্ষেত্রে পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিএসএফকে যথেষ্ট ধৈর্যের পরিচয় দিতে হচ্ছে৷ তবুও ত্রিপুরার সীমান্ত অনেকটাই নিরাপদে রয়েছে, জোর গলায় দাবি করেন তিনি৷
তিনি আরও বলেন, নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন এনএলএফটি-র অস্তিত্ব অস্বীকার করেনি বিএসএফ৷ নিষ্ক্রিয় হলেও এখনও এনএলএফটি-র ২২ থেকে ২৪ জন ক্যাডর আত্মসমর্পণ করেনি৷ জঙ্গি দলের গতিবিধির ওপর কড়া নজর রেখেছে বিএসএফ৷
ত্রিপুরায় উগ্রপন্থার কালো অধ্যায় আজও অনেকের মনে শিহরণ জাগায়৷ তাদের আতঙ্কে বিনিদ্র রাত কাটানো ভুলতে পারছেন না অনেকেই৷ তবুও, এনএলএফটি-র নিষ্ক্রিয়তা ত্রিপুরাবাসীকে নিশ্চিন্তে রেখেছে বলেই মনে করা হচ্ছে৷ তবে, তাদের অস্তিত্বকে আজও কোনওভাবেই অস্বীকার করা যাচ্ছে না৷ ১৩ অগাস্ট ২০১৯ নিষিদ্ধ ঘোষিত বৈরী সংগঠন এনএলএফটি-র ৮৮ জন ক্যাডার অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আত্মসমর্পণ করেছিল৷ সাম্প্রতিককালের মধ্যে যা সর্ববৃহৎ বৈরি আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়া৷ সহিংসতার পথ ছেড়ে তারা স্বাভাবিক জীবনে আসতে চেয়েছে৷ তাই, ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেব, উপ-মুখ্যমন্ত্রী জিষ্ণু দেববর্মা, সাংসদ রেবতিকুমার ত্রিপুরার উপস্থিতিতে তারা আত্মসমর্পণ করেছিলেন৷ এনএলএফটি নেতা সবির দেববর্মা, কাজল দেববর্মা, কর্ণ দেববর্মা, তপন কলই এবং সুমেন্দ্র দেববর্মা ওইদিন মুখ্যমন্ত্রীর হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছিলেন৷
সরকারি তথ্য অনুযায়ী ওইদিন বাইরের একে ৪৭ রাইফেল ৩-টি, ৭.৬২ এসএলআর ৬-টি, চাইনিজ রাইফেল ৪-টি, কার্বাইন ৩-টি, ওজি ১-টি, দুই ইঞ্চি মর্টার ১-টি, ৪০ এমএম ১-টি, পয়েন্ট থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল ১৯টি, ইউএস কার্বাইন ১-টি, এম-২০ পিস্তল ৪-টি, সিঙ্গল বোর গান ১-টি, ৯ এমএম কার্তুজ ৫৮৬টি, এম-২০ কার্তুজ ৪-টি, থ্রি-নট-থ্রি কার্তুজ ৯৯১টি, একে ৪৭ কার্তুজ ২৯৫টি জমা দিয়েছেন৷ এছাড়া টাইম ডিভাইস ১৬টি, টাইম পেনসিল ২৩টি, ওয়ারলেস সেট ৯-টি, বোতল গ্রেনেড ১৩টি, চাইনিজ গ্রেনেড ১-টি, গ্যাস গ্রেনেড ১-টি, একে ম্যাগাজিন ৬-টি, এসএলআরভি ম্যাগাজিন ১৪টি, প্রেসার স্যুইচ ১৮টি, ৪০ এমএম সেল ১-টি, টুইন সেল ১-টি, হ্যান্ড গ্রেনেড ১-টি, এম-২০ ম্যাগাজিন ৪-টি, ইউএস কার্বাইন ম্যাগাজিন ১-টি, শজি ম্যাগাজিন ২-টি, লকিং স্যুইচ ৪-টি, টাইম ডিলে ১-টি, থ্রি-নট-থ্রি ম্যাগাজিন ১৯টি জমা দিয়েছেন৷
আজ বিএসএফ ত্রিপুরা ফ্রন্টিয়ারের আইজি বলেন, ত্রিপুরায় আপাতত উগ্রপন্থী সমস্যা নেই৷ এনএলএফটি-র গতিবিধিও নজরে আসছে না৷ তবে, তারা নিষ্ক্রিয় হলেও মুছে যায়নি৷ এনএলএফটি জঙ্গি দলে এখনও ২২ থেকে ২৪ জন আত্মসমর্পণ করেনি৷ তাঁর কথায়, ২০১৮ সালের শেষের দিকে ওই বৈরি সংগঠনের তিনজন আত্মসমর্পণ করেছিল৷ তাছাড়া, গত অগাস্টে একসাথে ৮৮ জন ক্যাডার আত্মসমর্পণ করেছে৷
তিনি আরও বলেন, ত্রিপুরায় পাচারের পদ্ধতিগত পরিবর্তন হয়েছে৷ ফেন্সিডিলের বদলে ইয়াবার থাবা বেড়েছে৷ তবে পাচারকারীদের বিরুদ্ধে বিএসএফেরও সাফল্য রয়েছে৷ নেশা বিরোধী অভিযান সম্পর্কে এভাবেই বিস্তারিত তথ্য দিয়েছেন৷ তাঁর দাবি, এ বছর নেশা সামগ্রী ছাড়া ৩২ কোটি ৯২ লক্ষ ৯৩ হাজার টাকার অন্যান্য সামগ্রী বাজেয়াপ্ত করেছে বিএসএফ৷
এদিন তিনি বলেন, চলতি বছরে নেশা বিরোধী অভিযানে বিরাট সাফল্য মিলেছে৷ ত্রিপুরায় ২৩৬টি অভিযানে ৮,৯৮২ কেজি গাঁজা উদ্ধার হয়েছে৷ যার বাজার মূল্য ৪ কোটি ৮৫ লক্ষ ৫৭ হাজার টাকা৷ তাঁর দাবি, বিগত বছরের তুলনায় গাঁজা কম উদ্ধার হয়েছে৷ কারণ, বর্তমানে গাঁজা এবং ফেন্সিডিল পাচার কমেছে৷ তার বদলে ইয়াবা ট্যাবলেটের পাচার মারাত্মকভাবে বেড়েছে৷
তিনি বলেন, ত্রিপুরায় ইয়াবা ট্যাবলেটের ব্যবহার খুবই কম৷ সে তুলনায় ত্রিপুরাকে পাচারের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে৷ তিনি জানান, এ বছর ৩ লক্ষ ৫১ হাজার ৫৬৮টি ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার হয়েছে৷ যার বাজার মূল্য ১৭ কোটি ৫৭ লক্ষ ৮৪ হাজার টাকা৷ বিএসএফের আইজি বলেন, ইয়াবার পাচারবান্ধব তাই, সহজেই এর পাচার বাণিজ্য বেড়ে গিয়েছে৷ পাশাপাশি ২২ হাজার জমিতে ৪৩ হাজার ২০০ গাঁজা গাছ ধবংস করেছে বিএসএফ জওয়ানরা৷ যার বাজারমূল্য ৮১ লক্ষ ২১ হাজার টাকা, জানান তিনি৷
এদিকে, অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধেও বিএসএফ সাফল্যের নজির স্থাপন করেছে বলে দাবি করেছেন তিনি৷ বিএসএফ-এর ত্রিপুরা ফ্রন্টিয়ারের আইজি বলেন, এ বছর ত্রিপুরায় ভারত-বাংলা সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে পারাপারের সময় ২৩৬ জনকে আটক করা হয়েছে৷ তাদের মধ্যে ১১৭ জন ভারতীয়, ৬৫ জন বাংলাদেশি, ৫৩ জন রোহিঙ্গা এবং একজন নাইজেরিয়ান নাগরিক রয়েছেন৷