মানুষের ক্ষমতায়নে পরিচ্ছন্ন পরিবেশ : প্রধানমন্ত্রী

নয়াদিল্লি৷৷ রাষ্ট্রসংঘ বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ‘চ্যাম্পিয়নস্‌ অফ দ্য আর্থ’ পুরস্কারে সম্মানিত করেছে। এই সম্মান পেয়ে তিনি অভিভূত। তিনি মনে করেন, এই পুরস্কার কোনও একজন ব্যক্তির নয়, বরং ভারতীয় সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের স্বীকৃতি, যা চিরকালই প্রকৃতি মায়ের সঙ্গে একাত্ম হয়ে থাকার ওপর গুরুত্ব দিয়ে এসেছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনরোধে ভারতের অত্যন্ত ইতিবাচক ভূমিকাকে রাষ্ট্রসংঘের মহাসচিব শ্রী অ্যান্টনিও গ্যুটারেস এবং ইউএনইপি-র এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর শ্রী এরিক সলহ্যামের স্বীকৃতি এবং প্রশংসা করতে দেখার বিষয়টি প্রত্যেক ভারতবাসীর কাছে অত্যন্ত গর্বের ব্যাপার।

মানব এবং প্রকৃতির মধ্যে বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। প্রকৃতি মা আমাদের লালন-পালন করেছেন। মানুষের আদি সভ্যতাগুলি সবই নদীতটে গড়ে উঠেছে। প্রকৃতির সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণভাবে থাকা সমাজ ফলে-ফুলে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে।

মানবসমাজ আজ একটি গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমরা যে পথ বেছে নিয়েছি, তা শুধু আমাদেরই ভালো করবে না, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেও সমৃদ্ধ করবে। লোভ এবং প্রয়োজনের মধ্যে সমতার অভাব, পরিবেশে কঠিন ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি করতে পারে। আমাদের হয় এটিকে মেনে নিতে হবে, অথবা আগের মতো চলতে হবে নতুবা কোনও সংস্কারের পথ বেছে নিতে হবে।

আমরা কোন্‌ পথ বেছে নেব, তা থেকেই ঠিক হবে কিভাবে একটি সমাজ সার্থক পরিবর্তন আনতে পারে।

প্রথমত, আন্তরিক সচেতনতা। এর জন্য নিজেদের গৌরবময় অতীতের দিকে তাকানোর চেয়ে ভালো কোনও পথ নেই। প্রকৃতির প্রতি সম্মান ভারতীয় ঐতিহ্যের মূলে রয়েছে। অথর্ব বেদে যে পৃথিবী সুক্ত রয়েছে, তা প্রকৃতি ও পরিবেশ সম্পর্কে অগাধ জ্ঞানের আকর। অথর্ব বেদে অত্যন্ত সুন্দরভাবে লেখা হয়েছে যে,

‘য়স্যাং সমুদ্র উত সিন্দুরাপো য়স্যামন্নং কৃষ্ট্যঃ সংবভূবুঃ। য়স্যামি দং জিন্বতি প্রাণদেজৎসা নো ভূমিঃ পূর্বপায়েদধাতু।।৩।।’ অর্থাৎ, পৃথিবীমাকে অভিনন্দন, তাঁর মধ্যে রয়েছে মহাসাগর ও নদীগুলির জল; তাঁর মধ্যে রয়েছে খাদ্য, যা ভূমিতে কর্ষণের মাধ্যমে উৎপন্ন হয়; এতে নিশ্চিত রূপেই সমস্ত জীবন সমাহিত; তিনি আমাদের জীবন প্রদান করুন।

ঋষিরা পঞ্চতত্ত্ব – পৃথিবী, বায়ু, জল, অগ্নি ও আকাশ সম্পর্কে লিখেছেন এবং এটা ব্যাখ্যা করেছেন। কিভাবে আমাদের জীবন প্রক্রিয়া এই তত্ত্বগুলির সমাহারে গড়ে ওঠে। এই প্রকৃতির তত্ত্বগুলি থেকেই অলৌকিকতা প্রতিভাত হয়।

মহাত্মা গান্ধী পরিবেশ সম্পর্কে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কথা লিখেছেন। তিনি তাঁর জীবনশৈলীকে পরিবেশ-বান্ধব প্রয়োগে সমৃদ্ধ করেছিলেন। তিনি তাঁর লেখা ‘আস্থার সিদ্ধান্ত’ গ্রন্থে আমাদের অর্থাৎ বর্তমান প্রজন্মকে এই দায়িত্ব দিয়েছেন, যাতে আমরা আগামী প্রজন্মকে একটি পরিচ্ছন্ন পৃথিবী উপহার দিয়ে যাই। তিনি যুক্তিসঙ্গত সাশ্রয়ের আহ্বান জানিয়েছেন, যাতে বিশ্বে  কখনও সম্পদের অভাব না হয়।

ঐকতানের জীবনশৈলী পালন করা আমাদের লোকাচারের অঙ্গ। যখন আমরা অনুভব করব যে, আমরা এক সমৃদ্ধ পরম্পরার পতাকা বহন করে চলেছি, তখন আমাদের ব্যবহারে নিজে থেকেই ইতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করবে।

দ্বিতীয় বিষয়টি হ’ল গণসচেতনতা। আমাদের পরিবেশ সংক্রান্ত প্রশ্নগুলি নিয়ে যথাসম্ভব কথা বলা, লেখা ও আলাপ-আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। এর সঙ্গে পরিবেশ বিষয়ক নানা অনুসন্ধান ও উদ্ভাবনে উৎসাহ প্রদানও গুরুত্বপূর্ণ। এভাবে যথাসম্ভব বেশি মানুষকে আমাদের সময়ে বড় সমস্যাগুলি সম্পর্কে সচেতন করবে এবং সেগুলি সমাধানের প্রচেষ্টা নিয়ে ভাবার সুযোগ দেবে।

যখন আমরা একটি সমাজ রূপে পরিবেশ সংরক্ষণের সঙ্গে নিজেদের নিবিড় সম্পর্ক নিয়ে সচেতন হব, আর তা নিয়ে নিয়মিত চর্চা করব, তখন স্বাভাবিকভাবেই নির্মল পরিবেশের প্রতি আমরা নিজে থেকেই সক্রিয় পদক্ষেপ নেব। সেজন্য ইতিবাচক পরিবর্তনের স্বার্থে সক্রিয়তাকে তৃতীয় পদক্ষেপ বলে মনে করি।

এই প্রেক্ষিতে আমি অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে বলতে চাই যে, ভারতের ১৩০ কোটি মানুষ পরিচ্ছন্ন ও সবুজ পরিবেশের লক্ষ্যে সক্রিয় এবং সেজন্য নিজেদের সাধ্যাতীত কাজ করে চলেছেন।

স্বচ্ছ ভারত মিশনে জনগণের এই উদ্দীপ্ত সক্রিয়তা ভবিষ্যতে স্থায়ী উন্নয়নের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। দেশবাসীর আশীর্বাদে সাড়ে ৮ কোটি গৃহে প্রথমবার শৌচালয় নির্মাণ করা হয়েছে এবং ৪০ কোটিরও বেশি ভারতীয়দের এখন আর খোলা মাঠে প্রাকৃতিক কর্মসম্পাদনের প্রয়োজন নেই। পরিচ্ছন্নতার পরিমাণ ৩৯ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৯৫ শতাংশে পৌঁছে গেছে। প্রাকৃতিক পরিবেশে চাপ কমানোর ক্ষেত্রে এটি একটি ঐতিহাসিক প্রচেষ্টা।

উজ্জ্বলা যোজনার ক্ষেত্রেও আমরা এই উদ্দীপ্ত সক্রিয়তা দেখছি, যার ফলে অধিকাংশ বাড়িতে  অভ্যন্তরীণ বায়ু দূষণ হ্রাস পেয়েছে। কারণ, রান্নার সময়ে সৃষ্ট অসুস্থ পরিবেশের ফলে রোগ অনেক বৃদ্ধি পাচ্ছিল। উজ্জ্বলা যোজনায় ইতিমধ্যেই ৫ কোটিরও বেশি বাড়িতে রান্নার গ্যাসের সংযোগ প্রদান করা হয়েছে। ফলে, মহিলারা এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যদের জন্য একটি উন্নত ও পরিচ্ছন্ন জীবন সুনিশ্চিত হয়েছে।

দেশের নদীগুলিকে পরিচ্ছন্ন করার লক্ষ্যে দ্রুতগতিতে কাজ এগিয়ে চলেছে। দেশের জীবনরেখা গঙ্গানদী অনেক স্থানে ভীষণ রকম প্রদূষণের শিকার। নমামি গঙ্গে মিশন এই ঐতিহাসিক ভুল শুধরানোর কাজ করছে। পয়ঃপ্রণালীর নোংরা জল ও বর্জ্যকে পুনর্ব্যবহারযোগ্য করে তোলার কাজ গুরুত্ব দিয়ে করা হচ্ছে।

আমাদের নগরোন্ননের ক্ষেত্রে ‘অম্রুত’ এবং স্মার্টসিটি মিশনের মূল লক্ষ্য নগর সম্প্রসারণ ও পরিবেশ সংরক্ষণের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা। কৃষকদের যে ১৩ কোটিরও বেশি মৃত্তিকা স্বাস্থ্য কার্ড বিতরণ করা হয়েছে, সেগুলির মাধ্যমে তাঁরা খুব উপকৃত হচ্ছেন এবং এর ফলে ভূমির উৎপাদন ক্ষমতা ও মাটির স্বাস্থ্য রক্ষার মাধ্যমে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আমরা নির্মলতর পরিবেশ উপহার দিতে পারব।

পরিবেশের ক্ষেত্রে আমরা বহুমুখী উদ্দেশ্যসাধনে দক্ষ ভারত প্রকল্প গড়ে তুলেছি। সবুজ দক্ষতা উন্নয়ন প্রকল্প সহ বিভিন্ন প্রকল্প শুরু করেছি, যাতে পরিবেশ, বনজসম্পদ, বন্যপ্রাণী এবং জলবায়ু পরিবর্তনের স্বার্থে ২০২১ সালের মধ্যে ৭ মিলিয়ন নবীন প্রজন্মের মানুষকে দক্ষ করে তুলতে হবে। ফলে, পরিবেশ রক্ষার মাধ্যমে দক্ষ কর্মীদের কর্মসংস্থান এবং নতুন নতুন উদ্যোগ গড়ে ওঠার সুযোগ তৈরি হবে।

আমাদের দেশ নবীন ও নবীকরণযোগ্য জ্বালানির উৎসগুলিকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে এবং বিগত চার বছরে এই ক্ষেত্রটি অনেক সুগম ও সুলভ হয়ে উঠেছে।

উজালা যোজনার মাধ্যমে প্রায় ৩১ কোটি এলইডি বাল্ব বিতরণ করা হয়েছে। ফলে, একদিকে যেমন এলইডি বাল্বের দাম কমেছে, তেমনই বিদ্যুতের বিলে সাশ্রয় হয়েছে এবং কার্বন নির্গমনও হ্রাস পেয়েছে।

ভারতের এসব উদ্যোগ আন্তর্জাতিক স্তরে প্রশংসিত হচ্ছে। আমি গর্বিত যে, ভারত প্যারিসে অনুষ্ঠিত সিওপি-২১ – এর বার্তা বহন করে সাফল্যের সঙ্গে চলেছে। আন্তর্জাতিক সৌরসংঘ গঠনের সুবাদে ২০১৮ সালের মার্চ মাসে বিশ্বের অনেক দেশের নেতৃবৃন্দ নতুন দিল্লিতে একত্রিত হয়েছিলেন। এই সংঘ সৌরশক্তির ক্ষমতাকে আরও ভালোভাবে ব্যবহারের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ। এর মাধ্যমে আমরা বিশ্বের সেই দেশগুলিকে সঙ্গে নেওয়ার চেষ্টা করেছি, যেখানে সূর্যের আলো বেশি সময় থাকে।

এই সময়ে যখন বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে সবাই চিন্তিত, তখন ভারত জলবায়ু বিষয়ক সুবিচারের আহ্বান জানিয়েছে। জলবায়ু সুবিচারের অর্থ সমাজের সেই গরিব ও প্রান্তিক মানুষদের অধিকার সুরক্ষা, যারা জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সর্বাধিক বিপদগ্রস্ত।

আমি আগে যেমন লিখেছিলাম, আমাদের আজকের নানা পদক্ষেপের প্রভাব আগামীদিনে মানবসভ্যতাকে প্রভাবিত করবে। এখন এটা আমাদের ওপর নির্ভর করে যে, ভবিষ্যৎ বিশ্বের জন্য দায়িত্ব পালনের কাজ আমরাই শুরু করবো কিনা! পরিবেশের পরিবেশ সুরক্ষায় বিশ্ববাসীকে এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে, যা শুধুই সরকারি নিয়ম বা আইন পর্যন্ত সীমাবদ্ধ না থেকে জনমানসে পরিবেশ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি হয়। এই লক্ষ্যে যেসব ব্যক্তি ও সংগঠন লাগাতার পরিশ্রম করে চলেছেন, আমি তাঁদের ধন্যবাদ জানাতে চাই, কারণ তাঁরা আমাদের সমাজের চিরস্মরণীয় পরিবর্তনের অগ্রদূত হয়ে উঠেছেন। এই লক্ষ্যে অনেক প্রচেষ্টার জন্য আমি সরকারের পক্ষ থেকে সবরকম সাহায্যের আশ্বাস দিচ্ছি। আমরা সবাই মিলে একটি পরিচ্ছন্ন পরিবেশ গড়ে তুললে, তা মানুষের ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে ভিত্তিপ্রস্তরের ভূমিকা পালন করবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *