নিজস্ব প্রতিনিধি, আগরতলা, ৭ জুন ৷৷ ত্রিপুরার বিকাশের অপার সম্ভাবনা রয়েছে৷ ত্রিপুরা উন্নতির শিখরে পৌঁছোনোর জন্য তৈরী৷ কিন্তু, এর জন্য

চাই শান্তি৷ কারণ শান্তি প্রগতির প্রধান শর্ত৷ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রবীন্দ্র শতবার্ষিকী ভবনে রাজ্য সরকার আয়োজিত রাজ্য সংবর্ধনায় এই প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ৷ সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি রাজ্যের ক্যুইন প্রজাতির আনারসকে রাজ্য ফল হিসেবে ঘোষণা করেছেন৷ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন রাষ্ট্রপতির সহধর্মিনী সবিতা কোবিন্দ, রাজ্যপাল তথাগত রায়, মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেব, উপমুখ্যমন্ত্রী যীষ্ণু দেববর্মা, রাজস্ব মন্ত্রী এন সি দেববর্মা, কৃষিমন্ত্রী প্রণজিৎ সিনহা রায়, বিরোধী দলনেতা প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার৷
রাজ্য সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ বলেছেন, এ রাজ্যে এসে তিনি আনন্দিত এবং যে স্মারক উপহার তাঁকে আজ দেওয়া হয়েছে তা ত্রিপুরার জনগণের ভালোবাসার প্রতীক৷ তিনি সেই উপহারকে রাষ্ট্রপতি ভবনের অঙ্গনে সাজিয়ে রাখবেন৷ উদ্বোধনী সঙ্গীতে যেবাবে ওম শান্তি ওম মন্ত্র উচ্চারণ করা হয়েছে তার অর্থ হচ্ছে কোনও কিছু প্রাপ্তির জন্য এবং কোনও দেশের উন্নতির জন্য শান্তির পরিবেশ দরাকর৷ তাই এই মন্ত্রোচ্চারণের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করার জন্য তিনি ত্রিপুরাবাসীকে অভিনন্দন জানান৷ তিনি বলেন, ত্রিপুরা এখন বিভিন্ন ক্ষেত্রে এগিয়ে চলেছে এবং সম্প্রতি যেসব কম বয়সী ছেলে-মেয়েরা খেলাধূলার ক্ষেত্রে সাফল্য এনে দিয়েছেন তাদের সাতে মিলিত হয়ে আমি খুবই আনন্দিত৷ তিনি বলেন, এই ছেলে-মেয়েরা ত্রিপুরার তথা দেশের গর্ব৷ ত্রিপুরার যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে কিছু করে দেখানোর উদ্যম রয়েছে৷ তাদের মধ্য তিনি এক বিশেষ আশার কিরণ দেখতে পান৷ যদি কারও কিছু করে দেখানোর উদ্যাম ও ইচ্ছা না থাকে তাহলে সে কিছুই করতে পারবে না৷ ত্রিপুরা ছেলে-মেয়েদের মধ্যে সেই ইচ্ছা ও উদ্যম আছে৷ তিনি ত্রিপুরার জনগণ, মুখ্যমন্ত্রী ও যুব সম্প্রদায়ের প্রশংসা করে বলেন, ত্রিপুরা উন্নতির শিখরে পৌঁছোনোর জন্য তৈরী৷
রাষ্ট্রপতি বলেন, ত্রিপুরার প্রাক্তন রাজধানী উদয়পুর৷ ত্রিপুরার গৌরবময় ঐতিহ্য রয়েছে৷ ত্রিপুরার মহারাজ বিশেষ করে বীরবিক্রম মাণিক্য ত্রিপুরার আধুনিকীকরণের জন্য সচেষ্ট ছিলেন৷ ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় ত্রিপুরা যেভাবে শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছিলো তিনি তার ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং পরমবীরচক্র অ্যালবার্ট এক্কা আগরতলাকে রক্ষা করার জন্য যেভাবে আত্মত্যাগ করেছিলেন তাঁকে সম্মান জানাতে সম্প্রতি তাঁর নামে এক পার্ক উৎসর্গীকৃত করা হয়েছে৷ সাহিত্য ও বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে ত্রিপুরার রাজার যেভাবে আর্থিক সহায়তা দিয়ে গিয়েছিলেন তিনি তা উল্লেখ করেন৷ ত্রিপুরার সমৃদ্ধ সংসৃকতি সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি শচীন দেববর্মণকে ভারতীয় সঙ্গীত জগতের আশীবার্দ বলে অভিহিত করেন৷ তেমনি তাঁর পুত্র রাহুল দেববর্মণ ছাড়াও ভারতের আধুনিক সিনেমার জগৎ পূর্ণ হতো না বলে মন্তব্য করেনে রাষ্ট্রপতি৷ তিনি ত্রিপুরার ক্ষেত্রে যেভাবে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হচ্ছে তাতে পর্যটন শিল্পের বিকাশে সহায়তা হবে এবং যুবক-যুবতীদের কর্মসংস্থানও হবে বলে মনে করেন৷ মহিলাদের ক্ষমতায়ণের ক্ষেত্রেও ত্রিপুরার লোকদের নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গীর প্রশংসা করেন৷ দীপা কর্মকার কম বয়সীদের আইকন এবং বাকি সকল খেলোয়াড় যেমন লক্ষ্নীতা রিয়াং, সোমদেব দেববর্মণ, নিষ্ঠা চক্রবর্তীর কথাও উল্লেখ করেন রাষ্ট্রপতি৷ তিনি ক্যুইন প্রজাতির আনারসকে ত্রিপুরার রাজ্য ফল হিসেবে ঘোষণা দিতে পেরে আনন্দিত বলে জানান৷ আনারসের রপ্তানি ত্রিপুরার বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে আরও উন্নতি ঘটাতে সাহায্য করবে৷ তিনি ত্রিপুরার দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়নের কথা উল্লেখ করে রাবার, বাঁশ চাষের মতো ক্ষেত্রগুলির কথাও তুলে ধরেন৷ বর্তমানে উপজাতি কল্যাণ দেশের অগ্রাধিকারের বিষয়৷ এই লক্ষ্যে কৌশল বিকাশ যোজনাকে জুড়ে দিতেও বলেন তিনি৷ হস্ত শিল্প, উপজাতি উন্নয়ন, পর্যটন পরিকাঠামোর উন্নয়ন ইত্যাদির প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন রাষ্ট্রপতি৷ ভারত সরকারের অ্যাক্ট ইস্ট পলিসির অঙ্গ হিসেবে এশিয়ান দেশগুলির সাথে বাণিজ্যিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে ত্রিপুরা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি৷
রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ এবং রাষ্ট্রপতির সহধর্মিনী সবিতা কোবিন্দ ত্রিপুরার আমন্ত্রণে রাজ্য সফরে আসায় রাজ্যপাল তথাগত রায় তাঁদের ধন্যবাদ জানান৷ তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতি আমাদের দুই দিনের সময় দিয়েছেন৷ তিনি আমাদের উৎসাহ দিয়েছেন, প্রেরমা দিয়েছেন৷ ক্যুইন প্রজাতির আনারসকে রাজ্য ফল হিসেবে ঘোষণা করায় রাজ্যপাল রাষ্ট্রপতির প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান৷ তিনি বলেন, এই আনারস শুধু ত্রিপুরাতেই হয়৷ রাজ্যপাল জানান, তিনি দেশে-বিদেশে অনেক জায়গায় নানা ধরণের ফল খেয়েছেন৷ কিন্তু এমন উপাদেয় ফল তিনি কোথাও খাননি৷ এই ফলটির আরও প্রচার দরকার৷ মুখ্যমন্ত্রী এই ফলটির আরও প্রচারের উদ্যোগ নেবেন বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন৷
সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেব বলেন, আমাদের মাতৃভূমি ত্রিপুরাতে রাষ্ট্রপতি ২ দিনের রাজ্য সফরে আসার জন্য ৩৭ লক্ষ ত্রিপুরাবাসীকে পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি৷ আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী সবকা সাথ সবকা বিকাশ মন্ত্রে রাজ্যকে হীরা বানাবার যে স্বপ্ণ দেখেছেন তা আজ আপনি ৭৩ কিলোমিটার রাস্তার শুভারম্ভ করে পূরণ করেছেন৷ ৩৭ লক্ষ ত্রিপুরাবাসীকে সংসৃকতির ও পরম্পরার প্রাণ রয়েছে মাতা ত্রিপুরেশ্বরী মন্দিরে৷ এই মন্দিরকে নতুনবাবে উন্নয়ন করার লক্ষ্যে আপনি যে শিলান্যাস করেছেন তার জন্যও ত্রিপুরাবাসী আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ৷ আপনি পন্ডিত দীনদয়ালজীর অন্ত্যোদয়কে সমাজের অন্তিম ব্যক্তির কাছে পৌঁছে দেওয়ার কাজ করেছেন৷ আপনি পুরো জীবন সমাজের জন্য যে কাজ করেছেন তার জন্য ১২৫ কোটি ভারতবাসী অনুপ্রাণিত হয়েছে৷ আপনার সব সময় উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলির প্রতি যে ভাবনা এবং আপনার যে কর্মনিষ্ঠা এর মাধ্যমে আমরা শক্তি পাই৷ এই শক্তিকে পাথেয় করেই আমরা ত্রিপুরার উন্নয়নে কাজ করে যেতে চাই৷ আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি স্বপ্ণ দেখেছেন যে, আগামী ২০২২ সালের মধ্যে দেশের গরিব কৃষকদের রোজগার দ্বিগুণ করা৷ এই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই ত্রিপুরা সরকার রাজ্যের ক্যুইন প্রজাতির আনারসকে রাজ্যের ফল হিসাবে ঘোষণা করার যে উদ্যোগ নিয়েছে তা আজ আপনার ঘোষণার মাধ্যমে পূরণ হয়েছে৷ রাজ্যের ক্যুইন আনারস বিশ্বের সবচেয়ে সুস্বাদু ফলের মধ্যে অন্যতম৷ এই আনারস রাজ্যের জনজাতি এলাকয়া সবচেয়ে বেশি উৎপন্ন হয়৷ আমি আপনাকে জানাতে খুবই খুশি হচ্ছে যে, কিছুদিন পূর্বে আমরা এক টন আনারস সুদূর দুবাইয়ে পাঠিয়েছি৷ এইগুলির দামও দ্বিগুণ করা হয়েছে৷ এর মাধ্যমে কৃষকদের রোজগার দ্বিগুণ করার যে স্বপ্ণ দেশের প্রধানমন্ত্রী দেখেছেন রাজ্য সরকার তা পূরণ করার কাজ শুরু করে দিয়েছে৷
অনুষ্ঠানে সবাইকে স্বাগত জানিয়ে উপমুখ্যমন্ত্রী যীষ্ণু দেববর্মা বলেন, এই ঐতিহাসিক শহরে রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ এবং রাষ্ট্রপতি পত্নীকে স্বাগত জানাচ্ছি৷ সবকা সাথ সবকা বিকাশ এর যে কর্মসূচি তা রূপায়ণ করার জন্য আমরা সব ধরণের উদ্যোগ নিয়েছি৷ রাষ্ট্রপতি ত্রিপুরেশ্বরী মন্দিরের উন্নয়নের যে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে তা দেখেছেন এবং আরও এগিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন৷ উপমুখ্যমন্ত্রী আশা প্রকাশ করেন রাষ্ট্রপতির দেখানো পথে এবং পরামর্শে ত্রিপুরা আরও এগিয়ে যাবে৷
সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে রাজস্ব মন্ত্রী এন সি দেববর্মা বলেন, রাষ্ট্রপতি রাজ্য সফরে আসায় রাজ্যবাসী আপ্লুত এবং গর্বিত৷ রাজ্য সরকার এবং রাজ্যবাসীর পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপতি এবং রাষ্ট্রপতি পত্নীকে অভিনন্দন জানাই৷ তিনি বলেন, রাজ্যের উন্নয়নমূলক কর্মসূচির বিষয়ে রাষ্ট্রপতি অবগত আছেন৷ ভৌগোলিকভাবে দিল্লি অনেক দূরে হলেও রাজ্যবাসী আশাবাদী রাজ্যের সামগ্রিক উন্নয়নে দিল্লি এবং ত্রিপুরা অনেক কাছাকাছি চলে এসেছে৷ আগামী দিনে তা আরও বেশি নিবিড় হবে৷
অনুষ্ঠানের শুরুতে ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা ককবরক এবং বাংলায় উদ্বোধনী সঙ্গীত পরিবেশন করেন৷ এদিকে, আজ রাজ্যপাল তথাগত রায় রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ ও রাষ্ট্রপতির সহধর্মিনী ফার্স্ট লেডি সবিতা কোবিন্দকে রাজভবনে এক নৈশভোজে আপ্যায়ন করেন৷ নৈশভোজে মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেব সহ মন্ত্রিসভার সদস্যগণ ও অন্যান্য সম্মানিত ব্যক্তিগণ উপস্থিত ছিলেন৷