ভারতীয় দুগ্ধ খাতে নতুন দিগন্ত, হোয়াইট রেভলিউশন ২.০ নিয়ে গ্রামীণ সমৃদ্ধির পথে দেশ

নয়াদিল্লি, ২৯ সেপ্টেম্বর : ভারত আজ বিশ্বের সর্ববৃহৎ দুধ উৎপাদক দেশ। দেশের গ্রামীণ জীবন ও অর্থনীতির অন্যতম প্রধান ভিত্তি হয়ে উঠেছে দুগ্ধ খাত। পাঞ্জাবের রূপনগর জেলার আজৌলি গ্রামের গুরবিন্দর কৌর তারই এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। শিক্ষক থেকে সফল দুগ্ধ উদ্যোক্তা হওয়ার গল্প আজ বহু মহিলাকে অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছে। ২০১৪ সালে দুগ্ধ উন্নয়ন দপ্তরের প্রশিক্ষণ নিয়ে একটি হলস্টেইন ফ্রিসিয়ান গরু দিয়ে শুরু করে তিনি আজ চারটি দুধাল গরুর মালিক। আধুনিক প্রযুক্তি যেমন চাফ কাটার, মিল্কিং মেশিন ও সাইলেজ ইউনিট ব্যবহার করে প্রতিদিন প্রায় ৯০ লিটার দুধ উৎপাদন করছেন। উৎপাদিত দুধ ভেরকা ডেয়ারি ও স্থানীয় বাজারে সরবরাহ হয়, যা তাকে নিয়মিত আয় ও সামাজিক পরিচিতি এনে দিয়েছে।

দুধকে পূর্ণাঙ্গ খাদ্য বলা হয়, কারণ এতে প্রোটিন, ভিটামিন, খনিজ, ল্যাক্টোজ ও ফ্যাট বিদ্যমান। শিশুদের বৃদ্ধি, হাড়ের মজবুতি ও সব বয়সে সক্রিয় জীবনের জন্য দুধ অপরিহার্য। বর্তমানে ভারতের দুগ্ধ খাত জাতীয় অর্থনীতিতে প্রায় ৫% অবদান রাখছে এবং ৮ কোটিরও বেশি কৃষককে সরাসরি কর্মসংস্থান দিচ্ছে, যার প্রায় ৭০% নারী।

২০১৪-১৫ অর্থবছরে ১৪৬.৩০ মিলিয়ন টন দুধ উৎপাদন থেকে বেড়ে ২০২৩-২৪ সালে তা দাঁড়িয়েছে ২৩৯.৩০ মিলিয়ন টনে— অর্থাৎ ৬৩.৫৬% বৃদ্ধি। বছরে গড় বৃদ্ধির হার ৫.৭%। মাথাপিছু দৈনিক দুধের প্রাপ্যতা এখন ৪৭১ গ্রাম, যা বিশ্ব গড় ৩২২ গ্রামের তুলনায় অনেক বেশি। একইসঙ্গে ২০১৪ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে গবাদি পশুর উৎপাদনশীলতায় ২৭.৩৯% উন্নতি হয়েছে, যা বিশ্ব গড় (১৩.৯৭%)–এর দ্বিগুণেরও বেশি।

২০২৫ সালের মধ্যে ভারতীয় দুগ্ধ সমবায় নেটওয়ার্ক ২২টি মিল্ক ফেডারেশন, ২৪১টি জেলা ইউনিয়ন, ২৮টি মার্কেটিং ডেয়ারি ও ২৫টি মিল্ক প্রোডিউসার অর্গানাইজেশন (MPO) নিয়ে গঠিত হয়েছে। এটি ২.৩৫ লক্ষ গ্রাম ও ১.৭২ কোটি কৃষককে সংযুক্ত করছে। এর মধ্যে প্রায় ৪৮,০০০ সমবায় নারী নেতৃত্বাধীন। উল্লেখযোগ্যভাবে, ২৩ MPO–র মধ্যে ১৬টি সম্পূর্ণ মহিলাদের দ্বারা পরিচালিত, যেখানে ১২ লক্ষেরও বেশি দুধ উৎপাদক যুক্ত। অন্ধ্রপ্রদেশের অল-উইমেন ‘শ্রীজা’ MPO আন্তর্জাতিক দুগ্ধ ফেডারেশনের শিকাগো সম্মেলনে “ডেয়ারি ইনোভেশন অ্যাওয়ার্ড” পেয়েছে।

২০১৪ সালে শুরু হওয়া জাতীয় গোকুল মিশন ২০২৫ সালে আরও ১০০০ কোটি টাকার সংযোজন পেয়েছে, ফলে মোট বাজেট দাঁড়িয়েছে ৩৪০০ কোটি। কৃত্রিম প্রজনন (AI), জিন উন্নয়ন ও প্রজাতি সংরক্ষণে বিশেষ জোর দেওয়া হচ্ছে। আগস্ট ২০২৫ পর্যন্ত ৯.১৬ কোটি পশুর ওপর ১৪.১২ কোটি AI প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। ২২টি আইভিএফ ল্যাব স্থাপন ও ১.০৩ কোটি সেক্স-সোর্টেড সীমেন ডোজ প্রস্তুত হয়েছে, যার মধ্যে ৭০ লক্ষ ব্যবহৃত হয়েছে। এর ফলে বেশি সংখ্যক গাভী জন্ম নিয়েছে এবং উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে।

২০২৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হওয়া হোয়াইট রেভলিউশন ২.০ আগামী পাঁচ বছরে ভারতের দুগ্ধ সমবায় নেটওয়ার্ককে আরও শক্তিশালী করার লক্ষ্যে কাজ করছে। ২০২৮-২৯ সালের মধ্যে সমবায়গুলির দুধ সংগ্রহ ক্ষমতা প্রতিদিন ১০০৭ লাখ কেজি পর্যন্ত বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে। এর জন্য ৭৫,০০০ নতুন দুগ্ধ সমবায় গঠন এবং ৪৬,৪২২ বিদ্যমান সমবায়কে শক্তিশালী করা হবে। পাশাপাশি, চারা, জৈব সার, বায়োগ্যাস উৎপাদন ও মৃত পশু ব্যবস্থাপনার জন্য তিনটি মাল্টি-স্টেট সমবায় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হচ্ছে।

ভারতের দুগ্ধ খাত আজ ৮ কোটি কৃষকের জীবিকা ও পুষ্টি সুরক্ষার নিশ্চয়তা। মহিলাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ, সমবায় শক্তি ও আধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয়ে ভারত বিশ্বে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। হোয়াইট রেভলিউশন ২.০ দেশের গ্রামীণ জীবনে সমৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের নতুন সম্ভাবনা তৈরি করবে।