কাশ্মীরে বৈষ্ণো দেবী মন্দিরের পথে ধস: মৃত্যু বেড়ে ৩৬, আহত বহু; স্থগিত তীর্থযাত্রা, উদ্ধারকাজে সেনা-প্রশাসন-এনডিআরএফ

কাত্রা, ২৭ আগস্ট: জম্মু ও কাশ্মীরের রেয়াসি জেলার কাত্রায় বৈষ্ণো দেবী মন্দিরে যাওয়ার পথে এক ভয়াবহ ভূমিধসের ঘটনা ঘটেছে, যাতে অন্তত ৩৬ জন তীর্থযাত্রীর মৃত্যু হয়েছে এবং বহু মানুষ আহত হয়েছেন। এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে বুধবার বিকেলে, প্রবল বর্ষণের কারণে পাহাড় ধসে পড়ায় অর্ধকুমারী এলাকায়, যেখানে মন্দিরে যাওয়ার ১২ কিমি দীর্ঘ যাত্রাপথের প্রায় মাঝামাঝি অবস্থানে হঠাৎই পাথর, মাটি ও কাদাবালি তীর্থযাত্রীদের ওপর নেমে আসে। মৃত ও আহতদের অধিকাংশই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা যাত্রী, যাঁরা হিমকোটি রুট বন্ধ থাকায় পুরনো রুট ধরেই যাত্রা করছিলেন। বিকেল ১:৩০ মিনিট পর্যন্ত তীর্থযাত্রা চলছিল, কিন্তু দুর্ঘটনার পরে প্রশাসনের নির্দেশে পুরো যাত্রা স্থগিত রাখা হয়েছে।

ঘটনার পরপরই সিআরপিএফ-এর ৬ষ্ঠ ব্যাটালিয়নের জওয়ান, স্থানীয় পুলিশ, সেনাবাহিনী, এসডিআরএফ ও এনডিআরএফ-এর যৌথ বাহিনী দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছে উদ্ধারকাজ শুরু করে। এখনও ধ্বংসস্তূপের নিচে অনেকে আটকে রয়েছেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে, ফলে রাতভর উদ্ধার অভিযান চলছে। আহতদের কাত্রার কমিউনিটি হেলথ সেন্টার ও নারায়ণা হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়েছে। পরিস্থিতি এতটাই গুরুতর যে বৈষ্ণো দেবী মন্দিরে তীর্থযাত্রা পুরোপুরি বন্ধ রাখা হয়েছে এবং ভক্তদের পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত নতুন করে যাত্রার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এক্স-এ এক শোকবার্তায় এই ঘটনার নিন্দা করে বলেন, “শ্রী মাতা বৈষ্ণো দেবী মন্দির যাওয়ার পথে ভূমিধসজনিত প্রাণহানির ঘটনা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি আমার সমবেদনা রইল। আহতরা যেন দ্রুত সুস্থ হন—এই প্রার্থনা করছি। প্রশাসন ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যে কাজ করছে। সকলের নিরাপত্তা ও সুস্থতার জন্য প্রার্থনা করছি।” জম্মু ও কাশ্মীরের লেফটেন্যান্ট গভর্নর মনোজ সিনহাও নিহতদের পরিবারের প্রতি শোক প্রকাশ করে বলেন, প্রশাসন আহতদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর। তিনি কাত্রার মাতা বৈষ্ণো দেবী নারায়ণা হাসপাতালে আহতদের সঙ্গে দেখা করেন এবং চিকিৎসার খোঁজখবর নেন। সিনহা ঘোষণা করেন, দুর্ঘটনায় মৃতদের পরিবারকে শ্রাইন বোর্ডের তরফ থেকে ৫ লক্ষ এবং রাজ্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বোর্ডের তরফ থেকে ₹৪ লক্ষ করে ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হবে।

এদিকে, ভারী বর্ষণের জেরে জম্মু ও কাশ্মীরের বিভিন্ন অংশে দেখা দিয়েছে বন্যা ও ভূমিধসের ঘটনা। কিশ্তওয়ার জেলার প্রত্যন্ত মারগি এলাকায় হঠাৎ বন্যায় ১০টি বসতবাড়ি ও একটি সেতু ভেসে গেছে, যদিও সেখানে এখনও পর্যন্ত প্রাণহানির খবর পাওয়া যায়নি। কাঠুয়ার লাখানপুর গ্রামে অন্তত ১২ জন আধাসামরিক জওয়ান জলে আটকে পড়েছেন, যাদের উদ্ধারে অভিযান চলছে। জম্মু জেলাজুড়ে পানি ঢুকে পড়ায় প্রায় ৩,৫০০-র বেশি মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পাশাপাশি, ভেঙে পড়েছে একাধিক সেতু, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিদ্যুৎ সরবরাহ, মোবাইল টাওয়ার এবং অন্যান্য মৌলিক পরিকাঠামো। শ্রীনগরের রাম মুন্সি বাগ এলাকায় ঝেলম নদীর জল বিপদসীমার কাছাকাছি পৌঁছেছে, অনন্তনাগের সাঙ্গাম অঞ্চলে নদীর জলস্তর ২১ ফুটের সতর্কতা মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। শিক্ষা দফতর জানিয়েছে, আবহাওয়ার অবনতির কারণে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত জম্মু ও কাশ্মীর জুড়ে সমস্ত স্কুল ও কলেজ বন্ধ থাকবে।

এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মধ্যে ভারতের কেন্দ্র সরকার মানবিক কারণে পাকিস্তানকে আগাম সতর্ক করেছে যে তাওয়ী নদীতে প্রবল বন্যার সম্ভাবনা রয়েছে, কারণ পাহাড়ি জলাধার থেকে অতিরিক্ত জল ছাড়া হচ্ছে। এই নদী জম্মু অতিক্রম করে পাকিস্তানের চেনাব নদীতে মিশে যায়। এমন পরিস্থিতিতে, তাওয়ী নদীর জলস্তর বৃদ্ধি পেলে পাকিস্তানেও প্লাবনের আশঙ্কা তৈরি হতে পারে।

বিপর্যয়ের গভীরতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন জম্মু ও কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ। তিনি বলেছেন, ২০১৪ সালের বন্যার পরে রাজ্য কতটা প্রস্তুত ছিল, তা নিয়ে এখন নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। তাঁর মতে, প্রশাসন এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার মধ্যে আরও সমন্বয় থাকা উচিত ছিল, যা এই ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারত।

বর্তমানে প্রশাসনের অগ্রাধিকারে রয়েছে বিদ্যুৎ, যোগাযোগ এবং পানীয় জলের পরিষেবা দ্রুত পুনরুদ্ধার করা। পাশাপাশি সাধারণ মানুষকে অপ্রয়োজনীয়ভাবে বাইরে না যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। জরুরি পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে সমস্ত ধরনের প্রশাসনিক ও মানবিক সহায়তা অব্যাহত রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছেন লেফটেন্যান্ট গভর্নর।

এই দুর্যোগ পরিস্থিতি রাজ্যের প্রাকৃতিক দুর্বলতাকে ফের একবার সামনে এনে দিয়েছে। বর্ষার সময়ে পাহাড়ি অঞ্চলে অবকাঠামোগত দুর্বলতা এবং দুর্যোগ মোকাবিলায় পর্যাপ্ত প্রস্তুতির অভাব ভবিষ্যতের জন্য আরও গভীর চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াবে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।