নয়াদিল্লি, ২৫ আগস্ট : ১৩০তম সংবিধান সংশোধনী বিলকে ঘিরে দেশের রাজনৈতিক মহলে তীব্র উত্তেজনা ছড়িয়েছে। এই বিল অনুসারে, কোনও প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী বা কেন্দ্রীয় ও রাজ্য মন্ত্রিসভার সদস্য যদি কোনও গুরুতর অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে ৩০ দিনের বেশি কারাবাস করেন, তবে তাঁকে বাধ্যতামূলকভাবে পদত্যাগ করতে হবে। এই প্রস্তাব নিয়ে বিরোধী দলগুলি বিলটি “অসাংবিধানিক” ও “কালা আইন” হিসেবে বর্ণনা করলেও, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ স্পষ্ট জানিয়েছেন, এই বিলের পেছনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নিজেরই উদ্যোগ ছিল।
সোমবার, এক সাংবাদিক বৈঠকে অমিত শাহ বলেন, “এই সংশোধনীতে প্রধানমন্ত্রীকেও অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব স্বয়ং নরেন্দ্র মোদিজি দিয়েছেন। অতীতে ইন্দিরা গান্ধী সংবিধানের ৩৯তম সংশোধনের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং লোকসভার স্পিকারকে আদালতের বিচারাধীন থেকে রক্ষা করার ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু মোদিজি এক ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন, যেখানে তিনি নিজেই বললেন, ‘যদি আমি অপরাধ করে জেলে যাই, তাহলে আমাকেও প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়তে হবে।’”
অমিত শাহের বক্তব্য অনুযায়ী, এটি এক ধরনের নৈতিক দায়িত্ববোধের প্রকাশ, যা দেশের রাজনীতিতে বিরল। তিনি জানান, এই সংশোধনীর মাধ্যমে শাসকের পদে থাকা কোনও ব্যক্তি গুরুতর অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে দীর্ঘকাল জেলে থাকলে, তিনি যাতে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে না পারেন, সেই লক্ষ্যেই এই বিল।
এই বিল পেশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই লোকসভায় প্রবল প্রতিবাদ শুরু করে বিরোধীরা। তাঁদের দাবি, এই বিল “অসাংবিধানিক” এবং এর মাধ্যমে বিজেপি সরকারের উদ্দেশ্য হল বিরোধী মুখ্যমন্ত্রী ও মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে ইচ্ছেমতো কেন্দ্রীয় এজেন্সি ব্যবহার করে তাঁদের ফাঁসানো এবং রাজ্য সরকার ভাঙা।
কংগ্রেস, তৃণমূল, আপ, ডিএমকে সহ একাধিক বিরোধী দল একযোগে এই বিলকে “কালা আইন” বলে আক্রমণ করে। তাঁদের অভিযোগ, বিজেপি এই বিলের আড়ালে রাজনৈতিক প্রতিশোধ নিতে চাইছে। কোনও মুখ্যমন্ত্রী বা মন্ত্রী যদি রাজনৈতিক চক্রান্তের শিকার হয়ে মিথ্যা মামলায় জেলবন্দি হন, তবে তাঁদের সরকার চালানোর অধিকার কেড়ে নেওয়া হবে।
বিরোধীদের এই অভিযোগের বিরুদ্ধে পাল্টা সওয়াল তুলে অমিত শাহ বলেন, “আমি দেশের জনগণ ও বিরোধীদের জিজ্ঞেস করতে চাই, একজন মুখ্যমন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রী যদি জেলে থাকেন, তাহলে কি তিনি সরকার চালাতে পারবেন? এটা কি গণতন্ত্রের জন্য উপযুক্ত?”
তিনি আরও বলেন, “দেশের আইন অনুযায়ী উচ্চ আদালত বা সুপ্রিম কোর্ট চাইলে জামিন দিতে পারে। কিন্তু যদি জামিন না মেলে, তাহলে সরকার চালানোর নৈতিক অধিকারও থাকা উচিত নয়। এই সংশোধনী এটাই নিশ্চিত করে।”
অমিত শাহ বিরোধীদের “কালা বিল” তকমাকে সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বলেন, “যে কোনও ব্যক্তি জেলে গেলে, তার বদলে বিকল্প নেতৃত্ব আসতেই পারে। একটি দেশের শাসনব্যবস্থা কোনও একক ব্যক্তি ছাড়া চলবে না—এই ধারণা গণতন্ত্রের পরিপন্থী।”
তাঁর কথায়, “এই বিল আমাদের দলের মুখ্যমন্ত্রীদের জন্যও প্রযোজ্য। বর্তমানে এনডিএ শাসিত রাজ্য বেশি, এবং প্রধানমন্ত্রীও এনডিএ-র। তাই এটা কেবল বিরোধীদের বিরুদ্ধে নয়, আমাদের নিজেদের দায়িত্ববোধও প্রমাণ করে।”
এই বিল নিয়ে আলোচনা এখনো সংসদে সম্পূর্ণ হয়নি। কিন্তু শুরুতেই বিরোধীদের প্রবল আপত্তি ও বিক্ষোভে এটি এখন জাতীয় রাজনীতির অন্যতম বিতর্কিত ইস্যুতে পরিণত হয়েছে।
বিলটি পাস হলে দেশের রাজনৈতিক কাঠামোতে একটি বড় পরিবর্তন আসতে পারে, যেখানে আইনের চোখে শাসকেরাও দায়বদ্ধ থাকবে, এবং অপরাধ প্রমাণ হলে তাঁদের গদি ছাড়তেই হবে। তবে বিরোধীরা যদি রাজ্যসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়ে বিলটি আটকে দিতে সক্ষম হয়, তাহলে এর বাস্তবায়ন নিয়ে অনিশ্চয়তা থেকেই যাবে।
১৩০তম সংবিধান সংশোধনী বিল নিয়ে দেশজুড়ে শুরু হয়েছে নীতিগত, আইনগত ও রাজনৈতিক বিতর্ক। এটি একদিকে যেমন শাসকের দায়বদ্ধতা বাড়ানোর উদ্যোগ বলে দেখা হচ্ছে, অন্যদিকে বিরোধীরা একে গণতান্ত্রিক কাঠামোতে হস্তক্ষেপ বলেই তুলে ধরছেন। সামনের দিনগুলিতে সংসদে এই বিল নিয়ে কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তা ভারতের রাজনীতির ভবিষ্যতের দিক নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

