ভুবনেশ্বর, ৯ আগস্ট : ওডিশার কটক জেলার বামফাকুডা শহুরে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কর্মরত দুই নারী স্বাস্থ্যকর্মীর অভিযোগের ভিত্তিতে, কেন্দ্রটির জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপক নিশিথ রঞ্জন সাহু-কে যৌন হেনস্থার অভিযোগে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। অভিযোগ অনুসারে, সাহু দীর্ঘ কয়েক মাস ধরে সংশ্লিষ্ট মহিলা চিকিৎসক এবং এক ফার্মাসিস্টকে বারবার অশালীন মন্তব্য, অযাচিত স্পর্শ ও মানসিক চাপে ফেলার মতো আচরণ করে আসছিলেন।
কটক সদর থানার ইন্সপেক্টর ইন-চার্জ ওম প্রকাশ মহান্তি জানান, “ভুক্তভোগীরা অভিযোগ দায়ের করার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা তদন্ত শুরু করি। প্রাথমিক তদন্তে যৌন হেনস্থার প্রমাণ পাওয়া গেছে এবং সেই অনুযায়ী সাহুকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাঁকে ভারতীয় ন্যায় সংহিতা অনুযায়ী আদালতে পেশ করা হয়েছে।”
ভুক্তভোগী মহিলা চিকিৎসক অভিযোগে বলেন, সাহু প্রায়ই অফিসের কাজের অজুহাতে তাঁর সঙ্গে শারীরিক সংস্পর্শে আসার চেষ্টা করতেন। “ডাকুমেন্টে সই করাতে গিয়ে হাত ছোঁয়া, ঘনিষ্ঠভাবে দাঁড়িয়ে পড়া— এসব ঘটনা প্রায় নিয়মিত ছিল। একাধিকবার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানালেও কেউ গুরুত্ব দেয়নি,” বলেন তিনি।
অন্যদিকে, ফার্মাসিস্ট জানান, সাহুর আচরণ ছিল আরও অপমানজনক। “সে আমার চুলে হাত দিত, গালে হাত রাখত এবং এমনকি আমার ঘুঙট (ওড়না) তুলে গন্ধ শুঁকত। আমি এবং অন্য নারী কর্মীরা ভয়ে কাজ করতাম। একজন মহিলা ডেটা এন্ট্রি অপারেটর এবং একাধিক নার্সিং স্টাফকেও একইভাবে হয়রানি করেছেন,” অভিযোগ করেন তিনি।
অভিযোগকারীদের দাবি, সাহু তাঁর প্রভাব খাটিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করতেন। তিনি বারবার বলতেন, “আমার ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে ভালো যোগাযোগ আছে। যদি কথা না শুনো, তাহলে তোমাদের অন্যত্র বদলি করে দেব।” এই ধরনের হুমকির ফলে অনেক কর্মী মুখ বন্ধ রাখতে বাধ্য হন।
তাঁরা জানান, এর আগে তাঁরা অভিযোগ জানিয়েছিলেন অতিরিক্ত জেলা শহুরে জনস্বাস্থ্য আধিকারিক সত্যব্রত মহাপাত্র-সহ একাধিক প্রশাসনিক কর্মকর্তার কাছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
ঘটনার গুরুত্ব বুঝে, জেলা মুখ্য চিকিৎসা আধিকারিক প্রসান্ত কুমার হোতা জানান, “এই ঘটনায় আমাদের অভ্যন্তরীণ অভিযোগ কমিটি ইতিমধ্যেই তদন্ত শুরু করেছে। পুলিশি পদক্ষেপ নেওয়ার আগেই প্রশাসনিকভাবে আমরা তদন্ত শুরু করি। ICC-এর রিপোর্টের ভিত্তিতে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
তবে প্রশ্ন উঠেছে— যখন প্রাথমিকভাবে অভিযোগ পাওয়া যায়, তখন কেন অবিলম্বে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অভিযোগকারীদের একাংশের মতে, প্রশাসনের এই গাফিলতিই সাহুর মতো ব্যক্তিদের সাহস যোগায়।
পুলিশ জানিয়েছে, সাহুর বিরুদ্ধে ভারতীয় ন্যায় সংহিতা এর যৌন হেনস্থা, শারীরিক শ্লীলতাহানির চেষ্টা এবং পেশাগত কর্তব্যের অপব্যবহার সংক্রান্ত ধারাগুলি অনুযায়ী মামলা রুজু করা হয়েছে। তাঁকে আদালতে পেশ করা হয়েছে এবং পুলিশি হেফাজতে নেওয়ার আবেদন জানানো হয়েছে, যাতে আরও তথ্য সংগ্রহ করা যায়।
এই ঘটনার পর সাধারণ মানুষের পাশাপাশি মানবাধিকার সংগঠন ও স্বাস্থ্যকর্মী সংগঠনের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। ওডিশা উইমেন হেলথ অ্যাসোসিয়েশন-এর এক সদস্যা বলেন, “এটা কেবল একজন নারীর বিরুদ্ধে অপরাধ নয়, বরং গোটা স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না হওয়ার দৃষ্টান্ত। সাহুর মতো মানুষরা শুধু আইন নয়, গোটা পেশাগত পরিবেশকে কলুষিত করে।”
বিশিষ্ট সমাজতাত্ত্বিক ডঃ অনুরাধা মুখার্জি বলেন, “এই ঘটনা দেখিয়ে দেয়, কিভাবে যৌন হয়রানির অভিযোগের পরও অনেক সময় সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলি দোষী ব্যক্তিকে রক্ষা করার চেষ্টা করে। এটি নারী কর্মীদের আত্মবিশ্বাসে আঘাত হানে।”
ওডিশার এই ঘটনাটি দেখিয়ে দিল, যৌন হেনস্থার বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিলেও প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তা কতটা ভয়ংকর হতে পারে। কর্মস্থলে মহিলাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে কেবলমাত্র অভিযোগ গ্রহণ করাই নয়, যথাযথ এবং দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়াও আবশ্যক। সাহুর গ্রেফতারি শুধুমাত্র একটি সূচনা— ভুক্তভোগীদের ন্যায়বিচার এবং ভবিষ্যতে এমন ঘটনা রুখতে শূন্য সহনশীলতা নীতি বাস্তবায়ন করা সময়ের দাবি।

