উত্তরাখণ্ডের হরসিলে শীতকালীন পর্যটন কর্মসূচিতে ভাষণ প্রধানমন্ত্রীর

নয়াদিল্লি, ৬ মার্চ (হি.স.): প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী উত্তরাখণ্ডের হরসিলে শীতকালীন পর্যটন কর্মসূচিতে ভাষণ দিয়েছেন। বৃহস্পতিবার এই বিষয়ে জানিয়েছে ভারত সরকারের প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরো।

তাদের তরফে জানানো হয়েছে, “প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদী উত্তরাখণ্ডের হরসিলে একটি ট্রেক এবং বাইক র্যা লির উদ্বোধন করার পর শীতকালীন পর্যটন কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন। তিনি মুখওয়ায় মা গঙ্গার শীতকালীন আবাসে পূজা এবং দর্শন সারেন। সমাবেশে ভাষণে তিনি মানাগ্রামে দুঃখজনক ঘটনায় গভীর দুঃখপ্রকাশ করেন এবং দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান। তিনি বলেন, সারা দেশের মানুষ এই সংকটের সময় তাঁদের পাশে আছে, যা পীড়িত পরিবারকে প্রবল শক্তি জোগাবে।

এই অঞ্চল জীবনদায়ী মা গঙ্গার শীতকালীন আবাস বলে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “দেবভূমি বলে পরিচিত উত্তরাখণ্ড আধ্যাত্মিক শক্তিদ্বারা চালিত এবং চারধাম ও অসংখ্য পবিত্র মন্দিরের আশীর্বাদধন্য”। এখানে আসার সুযোগ পেয়ে এখানকার মানুষ এবং তাদের পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে পেরে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন তিনি জানান এটা আশীর্বাদ। তিনি বলেন, মা গঙ্গার আশীর্বাদে তিনি কয়েক দশক ধরে উত্তরাখণ্ডে সেবা করার সুযোগ পেয়েছেন। শ্রী মোদী বলেন, “মা গঙ্গার আশীর্বাদ আমাকে কাশীর পথ দেখিয়েছে, যেখানে আমি বর্তমানে সাংসদ হিসেবে সেবা করছি”। প্রধানমন্ত্রী সন্তানের জন্য মা গঙ্গার স্নেহ এবং ভালোবাসার উল্লেখ করেন, যা তাঁকে মুখওয়া গ্রামে গঙ্গার মায়ের বাড়িতে এনেছে এবং মুখীমঠ-মুখওয়ায় দর্শন এবং পূজা করার সম্মান পেয়েছেন। হরসিলে তাঁর সফরের বিষয়ে স্থানীয় মহিলাদের যাদের তিনি উল্লেখ করেন, “দিদি-ভুলিয়া” বলে তাদের কাছ থেকে স্নেহ পাওয়ার উল্লেখ করেন। শ্রী মোদী তাঁকে হরসিলের রাজমা এবং স্থানীয় পণ্য পাঠানোর পিছনে গভীর ভাবনা চিন্তার উল্লেখ করেন। তাদের আন্তরিকতা, যোগাযোগ এবং উপহারের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।

বাবা কেদারনাথ সফরের কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। যেখানে তিনি বলেছিলেন, “এই দশক উত্তরাখণ্ডের দশক হতে চলেছে”। তিনি বলেন যে, এই কথার পিছনে শক্তি এসেছে বাবা কেদারনাথের থেকেই। বাবা কেদারনাথের আশীর্বাদে এই দর্শন ক্রমে বাস্তব হয়ে উঠছে। উত্তরাখণ্ডের অগ্রগতির নতুন রাস্তা খুলছে, যে কারণে রাজ্য গঠন হয়েছিল সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে জানিয়ে শ্রী মোদী বলেন, উত্তরাখণ্ডের উন্নতির জন্য করা প্রতিশ্রুতি পূরণ হচ্ছে লাগাতার সাফল্য এবং নতুন নতুন মাইল ফলকের মাধ্যমে। তিনি আরও বলেন, “শীতকালীন পর্যটন এই লক্ষ্যে একটি বড় পদক্ষেপ। উত্তরাখণ্ডের অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে সাকার করতে সাহায্য করছে”। এই উদ্ভাবনী প্রয়াসের জন্য উত্তরাখণ্ড সরকারকে অভিনন্দন জানিয়ে রাজ্যের উন্নতির জন্য শুভেচ্ছা জানান প্রধানমন্ত্রী।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, “পর্যটনে বৈচিত্র ঘটানো এবং বছরভর নানা কার্যকলাপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উত্তরাখণ্ডের জন্য”। তিনি বলেন, উত্তরাখণ্ডে কোনো অফ সিজন যেন না থাকে। সব মরশুমেই যেন পর্যটন চলে। তিনি বলেন, বর্তমানে পাহাড়ে পর্যটন মরশুম কেন্দ্রিক। মার্চ, এপ্রিল, মে এবং জুনে পর্যটকদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ে। তারপরে, পর্যটকদের সংখ্যা অত্যন্ত কমে যায়। ফলে শীতকালে, হোটেল, রিসর্ট এবং হোমস্টেগুলি খালি পড়ে থাকে। তিনি বলেন, এই ভারসাম্যহীনতা উত্তরাখণ্ডে বছরের একটি বড় সময় অর্থনৈতিক স্থবিরতা তৈরি করে এবং পরিবেশেও সংকট তৈরি করে।

শ্রী মোদী বলেন, “শীতকালে উত্তরাখণ্ডে বেড়ালে দেবভূমির দেবমাহাত্ম্যের প্রকৃত পরিচয় পাওয়া যায়”। এই সূত্রে তিনি ট্রেকিং এবং স্কিইং-এর মতো রোমাঞ্চকর কার্যকলাপের উল্লেখ করেন, যা শীতকালীন পর্যটনে পাওয়া যায় এই অঞ্চলে। তিনি বলেন, উত্তরাখণ্ডে শীতকালে তীর্থযাত্রার বিশেষ তাৎপর্য আছে। কারণ এই সময়ে অনেক পবিত্র স্থানেই অভিনব ধরনের আচার পালন করা হয়। এলাকার প্রাচীন এবং মনে রাখার মতো রীতির অঙ্গ মুখওয়া গ্রামের ধর্মীয় আচার যার উল্লেখ করেন তিনি। প্রধামনন্ত্রী বলেন, উত্তরাখণ্ড সরকারের বছরভর পর্যটনের ভাবনা মানুষকে স্বর্গীয় অভিজ্ঞতার সুযোগ দেবে। তিনি বিশেষ করে বলেন, এই উদ্যোগে বছরভর কর্মসংস্থানের সুযোগ মিলবে। স্থানীয় মানুষ এবং যুব সম্প্রদায় উপকৃত হবে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, “কেন্দ্র এবং রাজ্যে আমাদের সরকার উত্তরাখণ্ডকে উন্নত রাজ্য হিসেবে তৈরি করতে একসঙ্গে কাজ করবে।” চারধামে সব মরশুমের উপযোগী রাস্তা, আধুনিক এক্সপ্রেসওয়ে, রেল, বিমান, হেলিকপ্টার পরিষেবার সম্প্রসারণ সহ গত দশকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটেছে। তিনি আরও বলেন, কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা সম্প্রতি কেদারনাথ এবং হেমকুণ্ড রোপওয়ে প্রকল্প অনুমোদন করেছে। তিনি বলেন, কেদারনাথ রোপওয়ে ৮-৯ ঘন্টা থেকে যাত্রার সময় কমিয়ে প্রায় ৩০ মিনিট করবে। বৃদ্ধ এবং শিশুদের জন্য বিশেষ করে সুবিধা হবে। শ্রী মোদী বলেন, কয়েক হাজার কোটি টাকা লগ্নি করা হবে এই রোপওয়ে প্রকল্পে। এই রূপান্তরকারী উদ্যোগের জন্য উত্তরাখণ্ড এবং সমগ্র দেশকে অভিনন্দন জানান তিনি।

পাহাড়ে কাঠের বাড়ি, কনভেনশন সেন্টার, হেলিপ্যাড পরিকাঠামো আলোকপাত করে শ্রী মোদী বলেন, “পর্যটন পরিকাঠামো নতুন করে তৈরি হচ্ছে টিমার সাঁই মহাদেব, মানাগ্রাম এবং জাদুং গ্রামের মতো এলাকায়”। তিনি আরও বলেন, ১৯৬২-তে মানা এবং জাদুং-এর শূন্য হয়ে যাওয়া গ্রামগুলির পুনরুদ্ধার করতে সরকার কাজ করেছে। ফলে, উত্তরাখণ্ডে এক দশকে পর্যটকদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। তিনি বলেন, ২০১৪-র আগে বছরে ১৮ লক্ষ তীর্থযাত্রী চারধাম যাত্রা করত, যা এখন বেড়ে হয়েছে ৫০ লক্ষ। প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেন, এবছরের বাজেটে ৫০টি পর্যটন স্থলের উন্নয়নের সংস্থান রাখা হয়েছে। হোটেল পরিকাঠামো গড়ে তোলা হচ্ছে। এরফলে, পর্যটকদের সুযোগ সুবিধা বাড়বে। স্থানীয় মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে।

উত্তরাখণ্ডের সীমান্ত এলাগুলি যাতে পর্যটনের সুযোগ পায়, তারজন্য প্রধানমন্ত্রী বলেন, “যে সমস্ত গ্রামকে আগে শেষ গ্রাম বলে অভিহিত করা হত, সেগুলিকেই এখন দেশের প্রথম গ্রাম বলে ডাকা হচ্ছে”। এগুলির উন্নয়নে ভাইব্র্যান্ট ভিলেজ প্রোগ্রামের সূচনার কথা বলেন তিনি, যাতে ওই অঞ্চলের ১০টি গ্রাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তিনি জানান, নেলং, জাদুং গ্রামগুলি আবার সাজিয়ে তোলা হচ্ছে। এরআগে, জাদুং থেকে একটি বাইক র্যা লির সূচনা করার কথা বলেন তিনি। তিনি আরও ঘোষণা করেন, যারা হোমস্টে চালায় তারাও মুদ্রা যোজনায় সুবিধা পাবে। রাজ্যের হোমস্টের প্রসার ঘটানোতে জোর দেওয়ায় উত্তরাখণ্ড সরকারের প্রশংসা করেন তিনি। তিনি বলেন, দশকের পর দশক যেসব গ্রামে পরিকাঠামো বলে কিছু ছিল না, সেখানে এখন নতুন হোমস্টে তৈরি হচ্ছে, যা পর্যটন বাড়াচ্ছে এবং স্থানীয় মানুষের উপার্জনের বৃদ্ধি ঘটাচ্ছে।

দেশের সকল প্রান্তের মানুষ বিশেষ করে যুবাদের বিশেষ আবেদন জানিয়ে শ্রী মোদী বলেন, শীতকালে দেশের বেশিরভাগ অংশ কুয়াশায় ঢাকা থাকা। কিন্তু, পাহাড় তখন সূর্যোলোকে ভাসে। তাকে একটি বিশেষ ঘটনা বলা যায়। গাড়ওয়ালিতে ‘ঘাম টাপো টুরিজম’ ধারণার উল্লেখ করেন। সারা দেশের মানুষকে শীতকালে উত্তরাখণ্ডে আসতে উৎসাহিত করেন। বিশেষ করে কর্পোরেট জগতকে সভা, সমিতি, প্রদর্শনীর মাধ্যমে শীতকালীন পর্যটনে অংশ নেওয়ার আবেদন জানান। প্রধানমন্ত্রী বলেন, যোগা এবং আয়ুর্বেদ পর্যটকদের নতুন করে প্রাণশক্তিতে চঞ্চল হওয়ার সুযোগ দেবে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি বিদ্যালয় এবং কলেজগুলিকে ছাত্রদের শীতকালীন ভ্রমণের গন্তব্য হিসেবে উত্তরাখণ্ডকে বেছে নেওয়ার আবেদন জানান।

বিবাহ অর্থনীতি যা কয়েক হাজার কোটি টাকার সেই প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী দেশের মানুষকে ‘ওয়েড ইন ইন্ডিয়া’ অনুসরণ করে শীতকালীন বিবাহের স্থান হিসেবে উত্তরাখণ্ডকে বেছে নেওয়ার আহ্বান জানান। উত্তরাখণ্ড সবচেয়ে বেশি চলচ্চিত্র বান্ধব রাজ্য বলে উল্লেখ করে ভারতীয় চলচ্চিত্র শিল্পের কাছ থেকে আরও বেশি প্রত্যাশার কথা জানান প্রদানমন্ত্রী। শীতকালে যাতে শ্যুটিং করা যায়, তারজন্য দ্রুত আধুনিক সব ব্যবস্থা গড়ে তোলার ওপর জোর দেন প্রধানমন্ত্রী।

অনেক দেশে শীতকালীন পর্যটনের জনপ্রিয়তার উল্লেখ করে শ্রী মোদী বলেন, উত্তরাখণ্ড সেখান থেকে অভিজ্ঞতা নিয়ে নিজেদের শীতকালীন পর্যটন শুরু করতে পারে। উত্তরাখণ্ডের হোটেল, রিসর্ট সহ পর্যটনের সব ক্ষেত্রকে ওইসব দেশগুলির মডেল অনুসরণ করার পরামর্শ দেন প্রধানমন্ত্রী। স্থানীয় প্রথা, সঙ্গীত, নৃত্য এবং রন্ধনশৈলীর প্রসারের ওপর জোর দেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, উত্তরাখণ্ডের উষ্ণ প্রস্রবনগুলিকে ওয়েলনেস স্পা এবং তুষারাচ্ছাদিত শান্ত জায়গাগুলিকে যোগাশনের স্থান হিসেবে গড়ে তোলার পরামর্শ দেন তিনি। যোগা গুরুদের উত্তরাখণ্ডে বছরে একবার যোগ শিবিরের আয়োজন করতে বলেন। তিনি শীতকালে বন্যপ্রাণ সাফারির আয়োজন করার পরামর্শ দেন। তিনি পুরোপুরি ৩৬০ ডিগ্রি মনোভাব নিয়ে প্রতিটি স্তরে কাজ করার ওপর জোর দেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধির পাশাপাশি সচেতনতার বার্তা দেওয়াও সমান গুরুত্বপূর্ণ। দেশের তরুণ কনটেন্ট নির্মাতাদের উত্তরাখণ্ডে শীতকালীন পর্যটনের প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেওয়ার আবেদন জানান। নতুন নতুন গন্তব্য খুঁজে বের করে তার অভিজ্ঞতা মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি রাজ্য সরকারকে শর্ট ফিল্মের প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে বলেন। প্রধানমন্ত্রীর আশা আগামীদিনে দ্রুত উন্নতি হবে এবং বছরভর পর্যটনের জন্য অভিনন্দন জানান।

অনুষ্ঠানে উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী শ্রী পুষ্কর সিং ধামি, কেন্দ্রীয় সড়ক পরিবহন প্রতিমন্ত্রী শ্রী অজয় টামটা সহ অন্য বিশিষ্ট ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।”

—————

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *