নিজস্ব প্রতিনিধি, আগরতলা, ২৮ সেপ্ঢেম্বর৷৷ সেপটিক ট্যাঙ্কের ম্যানহোলে ময়লা পরিস্কার করতে নেমে অকালে নিভে গেল দুই
যুবকের জীবনদীপ৷ ঘটনাটি ঘটেছে মঙ্গলবার সকাল পৌণে এগারটা নাগাদ শহরের ইন্দ্রনগর হাইসুকল এলাকায়৷ ঘটনাকে কেন্দ্র করে গোটা এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে৷ পাশাপাশি রাজ্যের ফায়ার সার্ভিস এবং দূর্য্যোগ মোকাবিলা টিমের ব্যর্থতায় তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে৷ স্থানীয় জনগণ এই দুই বাহিনীর ব্যর্থতার প্রতিবাদে ঐ এলাকায় পথ অবরোধ করেন৷ সেই সঙ্গে ফায়ার সার্ভিসের এক আধিকারীককে মারধর করা হয়৷ পুলিশের গাড়িতে ভাঙচুর চালানো হয়৷ পরিস্থিতি তীব্র উত্তেজনার সৃষ্টি হওয়াতে ঘটনাস্থলে পুলিশের আইজি, এসপি, ডিএম, এসডিএম সহ অন্যান্য আধিকারীকরা ছুটে যান৷ সকাল পৌণে এগারটা নাগাদ ঐ দুই যুবকের মৃত্যু হয়েছে৷ কিন্তু, মৃতদেহ ম্যানহোল থেকে উদ্ধার করে আনতে টানা তিন ঘন্টা লাগল৷ তাও ফায়ার সার্ভিস কিংবা দূর্যোগ মোকাবিলার রাজ্য টিমের দ্বারা সম্ভব হয়নি৷ ন্যাশনাল ডিজাস্টার রেসপন্স ফোর্সের জওয়ান ও আধিকারীকরা গিয়ে মৃতদেহ দুটি উদ্ধার করে ম্যানহোল থেকে৷ বিকাল পাঁচটা নাগাদ মৃতদেহ ময়নাতদন্তের পর নিকটাত্মীয়দের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে৷
সংবাদে প্রকাশ, শহরতলীর ইন্দ্রনগর এলাকায় সেফটিক ট্যাঙ্কের সাথে যুক্ত থাকা রাস্তার পাশের ম্যানহোল নির্মাণের দায়িত্বে রয়েছে এনবিসিসি৷ এনবিসিসি আবার এই কাজের দায়িত্ব দিয়েছে এক সাব কন্ট্রাক্টরকে৷ পুর নিগমের হাতে এখনও একাজ সম্পন্ন করে হস্তান্তর করেনি এনবিসিসি৷ এদিকে, ম্যানহোলের ময়লা পরিস্কার করার জন্য এদিন সকাল পৌণে এগারটা নাগাদ শ্রমিকদের নিযুক্ত করা হয়৷ ইন্দ্রনগর হাইসুকল এলাকায় একটি ম্যানহোলের ঢাকনা তুলে ভেতরে নামেন আঠার বছরের শ্রমিক শুভম নমঃ৷ সে নিচে নেমেই বিষাক্ত গ্যাসের শিকার হয়ে অজ্ঞান হয়ে জলে ডুবে যায় এবং মুহুর্তের মধ্যেই তার মৃত্যু হয়৷ তাকে
বাঁচাতে নামে মঙ্গল দাস নামে আরও এক শ্রমিক৷ সেও বিষাক্ত গ্যাসের ছোবলে অসুস্থ হয়ে পড়ে৷ ম্যানহোলের ভেতর থেকে চিৎকার চেচামেচি করলে আশেপাশের লোকজন ছুটে গিয়ে দেখতে পান তাদের এই সঙ্কটজনক অবস্থা৷ সঙ্গে সঙ্গেই খবর দেওয়া হয় ফায়ার সার্ভিসকে৷ ছুটে যায় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা৷ কিন্তু তাদের কাছে আসবাবপত্র না থাকায় তারা ফিরে যায়৷ ততক্ষণে মৃত্যু হয় মঙ্গল দাসের৷ এই খবর ছড়িয়ে পড়তেই কাতারে কাতারে মানুষ জড়ো হয় ঘটনাস্থলে৷
ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের অসহায়ত্ব দেখে উপস্থিত জনতা উত্তেজিত হয়ে ওঠে৷ জনতার রোষাণলে পড়ে ফয়ার সার্ভিস ও পুলিশ৷ উত্তেজিত জনতা পুলিশের গাড়িতে ভাঙচুর চালায়৷ দুই শ্রমিককে ম্যানহোল থেকে উদ্ধারের পরিবর্তে রণক্ষেত্রের রূপ নেয় ইন্দ্রনগর৷ খবর পেয়ে জেলা শাসক মিলিন্দ রামটেকে, এসডিএম সুমিত চৌধুরী সহ পুলিশের পদস্থ আধিকারীকরা ঘটনাস্থলে ছুটে যান৷ জরুরী তলব করে নিয়ে যাওয়া হয় এনডিআরএফ কে৷ এই মর্মান্তিক ঘটনার খবর পেয়ে অকুস্থলে ছুটে যান স্থানীয় বিধায়ক তথা তৃণমূল নেতা সুদীপ রায় বর্মন৷ তিনি নিহত শ্রমিকদের পরিবার পরিজনদের সাথে কথা বলেন৷ ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত খোঁজ খবর নিয়েছেন৷ তিনি প্রশাসনের কাছে দাবি জানিয়েছেন যাদের মৃত্যু হয়েছে তাদের পরিবারকে আর্থিক সহয়তা করার৷ পাশাপাশি তিনি বলেন, রাজ্যের ফায়ার সার্ভিসের যে পরিকাঠামো তার জন্যই এই অবস্থা৷ অক্সিজেন মাস্ক সহ অন্যান্য আনুসঙ্গিক সরঞ্জাম না থাকার জন্য এদিন ব্যর্থ হয়েছে ফায়ার সার্ভিস৷ ফায়ার সার্ভিসের যে পরিকাঠামো দূর্বলতা রয়েছে বলে স্বীকার করেছেন জেলা শাসক মিলিন্দ রামটেকে৷ তিনি বলেন, ফায়ার সার্ভিসের কাছে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম না থাকার জন্য ম্যানহোল থেকে ঐ দুই যুবককে উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি৷ এদিকে, ঘটনাস্থলে উপস্থিত পুলিশ সুপার অভিজিৎ সপ্তর্ষি জানিয়েছেন, শ্রমিকদের কোন ধরনের সুরক্ষার বিষয়টি মাথায় না রেখে যারা এই ধরনের বিপজ্জনক কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সেই ঠিকাদার সংস্থা কিংবা ব্যাক্তির বিরুদ্ধে আইনানুগ কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে৷ এই বিষয়ে একটি মামলা রুজু করা হয়েছে৷
এদিকে, এদিন পুলিশ প্রশাসন, ফায়ার সার্ভিস এবং ডিজাস্টার মেনেজম্যান্টের ব্যর্থতা ও অসহায়ত্বের প্রতিবাদে রাস্তা অবরোধ করেছেন ক্ষুব্ধ জনগণ৷ তবে এদিনের ঘটনায় রাজ্যের নখদন্তহীন বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর দুর্বলতা আবারও জনসম্মুখে প্রকট হল৷ নিহত শুভম ও মঙ্গলের শেষকৃত্য সম্পন্ন করার জন্য জেলা প্রশাসনের তরফ থেকে তাঁদের পরিবারকে প্রাথমিকভাবে পাঁচ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা করা হয়৷ পরবর্তী সময়ে মৃত দুই শ্রমিকের পরিবারকে আরো আর্থিক সাহায্য দেওয়ার আশ্বাস দেন জেলা শাসক৷
অন্যদিকে, এদিনের ঘটনার প্রেক্ষিতে বিজেপি রাজ্য কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে এনডিআরএফ এর বরাদ্দে রাখা অর্থ কোথায় যাচ্ছে? মুখ্যমন্ত্রীর কাছে জবাব চাওয়া হয়েছে এনডিআরএফ এর টেন্ডার কাদের কি কাজ দেওয়া হয়েছে৷ দলের পক্ষ থেকে এক বিবৃতেত বলা হয়েছে, এই একই ধরনের ঘটনা প্রায় এক পক্ষকাল আগে ধর্মনগরে একটি স্থানীয় কূপ সাফাই করতে গিয়ে ঘটেছিল৷ সেখানেও শ্বাসবন্ধ হয়ে দুটি শ্রমিক প্রাণ হারায়৷ দুটি ক্ষেত্রেই শ্রমিকরা উপযুক্ত অক্সিজেন মাস্ক বা প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ছাড়াই কাজটি সাধ্য করতে যায়৷ এই ধরনের ঘটনা রাজ্য সরকারের একটি ব্যর্থতার নজির সৃষ্টি করে৷ স্বর্ণযুগের রাজ্য প্রশাসন এই ধরনের ঝুকিপূর্ণ কাজের জন্য উপযুক্ত যন্ত্রাংশ শ্রমিকদের দিতে ব্যর্থ এবং তাদের জীবনের সুরক্ষার প্রতি কোন দায়ভার নিতে ইচ্ছুক নয়৷ পাশাপাশি প্রশাসনও এই ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত নয়, কারণ আজ ইন্দ্রনগরের এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটায় প্রায় দুই ঘন্টা পর ফায়ার সার্ভিস ও এনডিআরএফ এর তহবিলে রাখা কেন্দ্রীয় সরকারের বরাদ্দকৃত অর্থ রাজ্য সরকার কোথায় হাফিজ করেছে? এই অর্থ দেওয়া হয় যাতে রাজ্য সরকার রাজ্যে এই ধরনের পরিস্থিতির জন্য উপযুক্ত পরিকাঠামো তৈরী করা ও যন্ত্রাংশ কিনতে পারে৷ কিন্তু, রাজ্যে সাধারণ একটি অক্সিজেন সিলিন্ডারের আর একটি সাধারণ অক্সিজেন মাস্কের অভাবে দুটি নিরীহ জীবন প্রাণ হারায়৷ আর এই ব্যর্থতার দায়ভার সম্পূর্ণভাবে রাজ্য সরকারের এবং তার স্বর্ণযুগের মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকারের৷ তার করণ হল, এনডিআরএফ এর রাজ্য চেয়ারম্যান স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী এবং কেন্দ্র থেকে আসা এনডিআরএফ এর তহবিল উপযোগী করার দায়ভার উনার৷ রাজ্য বিজেপি মুখ্যমন্ত্রীর কাছে দুটি প্রশ্ণের জবাব চেয়েছে- গত দশ বছরের এনডিআরএফ এর অর্থ কোথায় হাফিস হয়েছে? মুখ্যমন্ত্রীর তত্ত্বাবধানে এনডিআরএফ এর পরিকাঠামো এবং যন্ত্রাংশজনিত টেন্ডার কাদের দেওয়া হয়েছে? অন্যদিকে, বিজেপি এদিন দূর্ঘটনায় নিহতদের পরিবারের সদস্যদের ১০ লক্ষ টাকা করে আর্থিক অনুদান প্রদান করার দাবী জানিয়েছে৷