দুর্গাপুর, ২৩ সেপ্টেম্বর (হি.স.): সঙ্কটে জলের হাহাকার। আবার অতিবৃষ্টিতে জলসংরক্ষন তলানিতে। বিশ্ব ব্যাঙ্কের কোটি কোটি টাকায় নিম্ন দামোদর সংস্কারের কাজ শুরু হলেও, জল সংরক্ষনের বিকল্প ভাবনা উধাও। চাহিদার সঙ্গে সঙ্কট মোকাবিলা ও বন্যা নিয়ন্ত্রনে এবার দামোদর নদের রনডিহা ‘ওয়ের’ কে ব্যারেজ করার দাবী উঠল। দামোদর নদের ওপর দুর্গাপুর ব্যারেজের ২০ কিলোমিটার নিম্নে রনডিহা ‘ওয়ের’ বা ছোট জলাধার। বৃটিশ আমলে ১৯৩৩ সালে তৈরী। উদ্বোধন করেন তৎকালিন গর্ভনর স্যার জন আন্ডারসন। তিনটি লকগেট রয়েছে। পলি জমে জল ধারন কমেছে। রনডিহা ওয়ের বর্তমান জলস্তরের বিপদসীমা ১৬৮.৪৯ ফুট হলেও, ১৬৫.০৪ ফুট জলস্তর উঠেছে। তারও দুপাশে দুই স্বল্প দৈর্ঘ্যের সেচখাল বা ক্যানেল রয়েছে। সংস্কারের অভাবে মজে গেছে। গত কয়েকদিন আগে ঝাড়খন্ডে প্রবল বৃষ্টিপাতের দরুন মাইথনে জলস্তর আচমকা বেড়ে উঠেছিল। রাত্রে অপ্রত্যাশিত ৩ লক্ষ একরফুট জল ঢুকে যায় মাইথনে। কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলায় সেখান থেকে ২ লক্ষ কিউসেক জল ছাড়া হয়। আবার একইসঙ্গে পাঞ্চেত জলাধার থেকে প্রায় ৫০ হাজার কিউসেক জল ছাড়া হয়। সব মিলিয়ে দুর্গাপুর ব্যারেজে প্রায় ৩ লক্ষ কিউসেক জল ঢুকে পড়ায়, সেখান থেকেও জল ছাড়া শুরু হয়। আর ওই জলে নিম্ন দামোদর আববাহিকায় বন্যা পরিস্থিতি তৈরী হয়। শুধু তাই নয়, তারপরও মাইথন পাঞ্চেত জলাধারের জলস্তর নিয়ন্ত্রনে রাখতে পর্যায় ক্রমে জল ছাড়া অব্যাহত রয়েছে। বিপুল পরিমান জলরাশি ছাড়ার দরুন নিম্ন দামোদরের কাঁকসার সিলামপুর, কসবা মানাচর সহ হুগলি ও হাওড়ার বেশ কিছু এলাকায় প্লাবিত হয়। আর এই জল ছাড়া নিয়ে রাজ্যের সঙ্গে ডিভিসির কাজিয়া তুঙ্গে। রাজ্যের বন্যা পরিস্থিতির জন্য ডিভিসিকে কাঠগড়ায় তুলেছে রাজ্য সরকার। যদিও ডিভিআরআরসির সদস্য সচিব শশী রাকেশ বলেন,” প্রাকৃতিক বিপর্যয়। এটা নিয়ন্ত্রন করা যায় না। প্রবল বৃষ্টিতে ৪ লক্ষ ২৩ হাজার কিউসেক জল ঢুকেছে মাইথন ও পাঞ্চেত জলাধারে। তার মধ্যে আড়াই লক্ষ কিউসেক জল ছাড়তে হয়েছে। প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে কাজে লাগানো দরকার। ডিভিসি না থাকলে আরও জলও যেত। তাহলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হত। তেমনই চাষের সেচের জল পানীয় জলের আরও সঙ্কট হত।” আর প্রশ্ন এখানেই। সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে বন্যার জলসংরক্ষনের দিশা নেই।প্রসঙ্গত, দুর্গাপুর ব্যারেজের ওপর নির্ভরশীল ৮ লক্ষ ২০ হাজার হেক্টর কৃষিজমি। দুর্গাপুর ব্যারেজ থেকে নগরায়নের জন্য ৫০০ কিউসেক জল দৈনিক ছাড়তে করতে হয়। আসানসোল- রানীগঞ্জ নগরায়নের জন্য দৈনিক প্রায় ১ হাজার কিউসেক জল লাগে। কৃষিকাজে সেচের জন্য বছরে জল প্রয়োজন সাড়ে ৪ লক্ষ একরফুট। আগামীদিনে যেভাবে নগোরায়ন বাড়ছে, তাতে আরও জলের প্রয়োজন। এছাড়াও রয়েছে শিল্পায়ন। আসানসোল-দুর্গাপুর, রানীগঞ্জ, জামুড়িয়া, কাঁকসা, পানাগড় ও বড়াজোড়া শিল্পতালুক ব্যারেজের জলের ওপর নীর্ভরশীল। এছাড়াও রয়েছে ওইসব শিল্পাঞ্চলের মেজিয়া, অন্ডাল, ডিটিপিএস, ডিপিএলসহ ৫ টি গুরুত্বপুর্ন তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, যেগুলি ব্যারেজের জল না পেলে মুখ থুবড়ে পড়বে। ব্যারেজের মূল সেচখাল দুটি। উত্তরপ্রান্তে রয়েছে ১৩৬. ৬ কিমি, দক্ষিণপ্রান্তে রয়েছে ৮৮.৫ কিমি। প্রধান ও শাখা সেচখাল বা ক্যানেল রয়েছে ২৪৯৪ কিমি। উল্লেখ্য, দক্ষিনপ্রান্তের সেচক্যানেলে সাইফোনিং সিস্টেম ছিল। তাতে ওই ক্যানেল দিয়ে বর্ষায় যেমন জল ঢুকত ব্যারেজে। তেমনই শীতকালিন চাষে জল ছাড়া হত ওই ক্যানেলে। গত ২০ বছর ধরে বর্ষার ধারাবাহিকতা বদলেছে। তার আগে অতিবৃষ্টিপাতের ফলে যেভাবে জল ছাড়া হত। তাতে জলস্রোতের সঙ্গে পলি, নুড়ি, কাঁকর বেরিয়ে পড়ত। কিন্তু সেই বৃষ্টির ধারাবাহিকতা নেই। ফলে, দামোদরের উপরিভাগ থেকে জলস্রোতে পলি, নুড়ি, কাঁকর আসলেও সেসব আটকে পড়ে ব্যারেজে। ফলে পলি পড়ে প্রায় ৫২ শতাংশ নাব্যতা কমেছে ব্যারেজের। যার দরুন ভারি বর্ষা হলেই জল ছাড়তে হয় ব্যারেজে। ফলত, জলসংরক্ষন লাটে উঠেছে। স্বাভাবিকভাবে ব্যারেজে জলধারন কমতে থাকায় জলসঙ্কট আরও প্রকট হতে পারে আশঙ্কা করছে শিল্পশহরবাসী। তাই, রনডিহা ওয়েরটিকে বিকল্প ব্যারেজ তৈরী করা দরকার বলে মনে করছে পূর্ব বর্ধমান কৃষি অঞ্চল। তাতে যেমন বর্ষায় অতিরিক্ত জল ধরে রাখা যাবে। তেমনই জলসঙ্কট আগামীদিনে মোকাবিলা করা যাবে। রনডিহা ওয়ের পলি সংস্কার করে ব্যারেজ তৈরী হলে কমপক্ষে ২ লক্ষ কিউসেক জল ধারন ক্ষমতা সম্ভব বলে মনে করছে বিশেষজ্ঞ মহল। তাতে সেচের জলের সঙ্কট যেমন মিটবে। বর্ধমান, বাঁকুড়া, হুগলি জেলায় কৃষিকাজে সেচের জলের জোগান দেওয়া সহজ সম্ভব হবে। ৫ লক্ষ হেক্টর কৃষিজমি সুবিধা সেচের সুবিধা পাবে। তেমনই পানাগড় শিল্পতালুকে জলের জোগান দেওয়া সম্ভব হবে। গলসী-১ নং ব্লকের কৃষক মলয় চট্যোপাধ্যায়, সামসুল হক প্রমুখ বলেন,” প্রকৃতির ধারাবাহিকতা বদলেছে। গত কয়েকবছর দেরিতে বর্ষা আসছে। খামখেয়ালিপনা। ফলে খারিফ চাষেও ব্যারেজের জলের ওপর নির্ভর করতে হয় চাষীদের। তাই রনডিহা ওয়েরটিকে পুনর্গঠন করা দরকার। তাতে বন্যা নিয়ন্ত্রন হবে। এবং ওই জল সেচের ও শিল্পের কাজে ব্যাবহৃত হবে।” সোনামুখির বিজেপি বিধায়ক দিবাকর ঘরামি বলেন,” রাজ্য সরকারের সদিচ্ছার অভাব। জল সংরক্ষনে সম্পূর্ন ব্যার্থ। বিশ্ব ব্যাঙ্কের কোটি কোটি টাকায় নিম্ন দামোদরের কি কাজ চলছে, সেসব প্রশ্ন রয়েছে। বর্তমানে রনডিহা ওয়ের সংস্কার ও ব্যারেজ তৈরী অত্যন্ত জরুরি। দামোদরে বিকল্প ব্যারেজ তৈরী করলে বন্যা নিয়ন্ত্রন করা ও জল সংরক্ষন করা সম্ভব হবে।”
2024-09-23