নয়াদিল্লি, ৩ আগস্ট : প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আজ নয়াদিল্লির জাতীয় কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্র (এনএএসসি) মিলনায়তনে কৃষি অর্থনীতিবিদদের ৩২ তম আন্তর্জাতিক সম্মেলনের উদ্বোধন করেন| এবারের সম্মেলনের মূল আলোচ্য বিষয় হচ্ছে, দীর্ঘস্থায়ী কৃষি-খাদ্য ব্যবস্থার দিকে রূপান্তর ঘটানো| এর উদ্দেশ্য হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন, প্রাকৃতিক সম্পদের অবক্ষয়, কৃষি উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি ও নানা দ্বন্দের অবসান কল্পে বিশ্ব ব্যাপী নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে দীর্ঘস্থায়ী কৃষি ব্যবস্থা প্রণয়নের জরুরী প্রয়োজন মেটানো| সম্মেলনে প্রায় ৭৫টি দেশের এক হাজারেরও বেশি প্রতিনিধি অংশ নিয়েছেন|
সম্মেলনে ভাষনদান কালে প্রধানমন্ত্রী, ৬৫ বছর পর ভারতে কৃষি অর্থনীতিবীদদের আন্তর্জাতিক সম্মেলন (আইসিএই)আয়োজন করায় সন্তোষ প্রকাশ করেন| ভারতে ১২ কোটি কৃষক, ৩ কোটি মহিলা কৃষক, ৩ কোটি মৎসজীবি ও ৮ কোটি প্রাণী পালকদের তরফে সম্মেলনে আগত প্রতিনিধিদের স্বাগত জানান প্রধানমন্ত্রী| প্রধানমন্ত্রী বলেন, আপনারা এমন এক দেশে রয়েছেন, যেখানে ৫০ কোটিরও বেশি গবাদি পশু রয়েছে| ভারতের মত কৃষি ও পশুপ্রেমী দেশে প্রতিনিধিদের স্বাগত জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী কৃষি ও খাদ্যে প্রাচীনা ভারতীয় বিশ্বাস ও অভিজ্ঞতার পরম্পরার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন| তিনি ভারতের কৃষির ঐতিহ্যে বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা তুলে ধরেন| তিনি খাদ্যের ঔষুধিগুনের পেছনে বিজ্ঞানের অবদানের কথা তুলে ধরেন|
সহস্র বছরের পুরানো দৃষ্টিভঙ্গীর ওপর ভিত্তি করেই ভারতে কৃষির বিকাশ ঘটেছে বলে তিনি উল্লেখ করেনা। প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের উপর ভিত্তি করে রচিত প্রায় ২০০০ বছর পুরানো কৃষি বিষয়ক গ্রন্থ “কৃষি পরাশরের” কথাও উল্লেখ করেন| প্রধানমন্ত্রী ভারতে কৃষি বিষয়ক গবেষনা ও শিক্ষা প্রসারের এক শক্তিশালী ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করেন| ১০০টিরও বেশি গবেষনা প্রতিষ্ঠান নিয়ে ভারতীয় কৃষি গবেষণা পর্ষদ (আই সি এ আর), নিজেই এ ব্যাপারে গর্ব করতে পারে বলে তিনি উল্লেখ করেন| প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, কৃষি বিষয়ক শিক্ষার জন্য ভারতে ৫০০ টির বেশি মহাবিদ্যালয় ও ৭০০টির বেশি কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্র রয়েছে|
ভারতে কৃষি ব্যবস্থার ওপর ছয়টি ঋতুর প্রভাবের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভারতে ১৫ টি কৃষি জলবায়ু অঞ্চল রয়েছে। তিনি বলেন, এসব অঞ্চলে বিভিন্ন ঋতুতে ফসল উৎপাদনের স্বতন্ত্র গুনাবলী রয়েছে| প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশে প্রায় ১০০ কিলোমিটার পর পর কৃষি উত্পাদন চিত্রের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়| প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভারতের মত দেশে জমিতে চাষাবাদ হোক বা, হিমালয় অঞ্চল, জলাভাব স্থান, মরুভূমি হোক বা উপকুলীয় অঞ্চল, ভারতে খাদ্য উৎপাদনের এই বৈচিত্র, বিশ্ব খাদ্য নিরাপত্তার দিক থেকে ভারতকে এক গুরুত্বপূর্ন স্থানে নিয়ে এসেছে ও বিশ্বের কাছে ভারত এক আশার আলো হিসাবে উপস্থিত হয়েছে|
৬৫ বছর আগে ভারতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক কৃষি অর্থনীতিবীদদের সম্মেলনের কথা স্মরন করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভারত এখন এক স্বাধীন স্বত্বার স্বাধীন জাতির দেশ হয়ে উঠেছে, ভারতকে খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষি উৎপাদনের নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হচ্ছে| ভারত বর্তমানে খাদ্য উৎপাদনে উদ্বৃত্ত এক দেশ| দুধ, ডাল মশলা উত্পাদনে বিশ্বের বৃহত্তম উৎপাদক দেশ| খাদ্যশষ্য, ফলমূল, শাকসবজি, তুলা, চিনি, চা পাতা এবং মাছ উৎপাদনে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ| প্রধানমন্ত্রী সেই দিনগুলোর কথা উল্লেখ করেন, যখন ভারতের খাদ্য নিরাপত্তা বিশ্বের কাছে উদ্বেগের বিষয় ছিল| কিন্তু ভারত আজ বিশ্বের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিচ্ছে| তাই, আজ খাদ্য ব্যবস্থার রূপান্তর সম্পর্কে আলাপ-আলোচনার জন্য ভারতের মতামত অভিজ্ঞতা যথেস্ট মূল্যবান এবং তা গোটা বিশ্ব ও দক্ষিন গোলার্ধ নিশ্চিতভাবেই লাভবান হবে বলেন প্রধানমন্ত্রী|
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, বিশ্ব কল্যানে ‘বিশ্ববন্ধু’ ভারেতের অঙ্গীকারের কথা পুনর্ব্যক্ত করেন| বিশ্ব কল্যানে ভারেতের দৃষ্টিভঙ্গীর কথা স্মরন করে প্রধানমন্ত্রী এক পৃথিবী, এক পরিবার, এক ভবিষ্যত, মিশন লাইফ, এক পৃথিবী এক স্বাস্থ্য ইত্যাদি মন্ত্রের কথাও উল্লেখ করেন তিনি| শুধু মানুষ নয় ভারতে পশুপাখি, উদ্ভিদের স্বাস্থ্যের বিষয়েও ভারতের দৃষ্টিভঙ্গীর কথাও তিনি উল্লেখ করেন| তিনি বলেন, মজবুত কৃষি ও খাদ্য ব্যবস্থার চ্যালেঞ্জগুলো শুধুমাত্র এক পৃথিবী, এক পরিবার এক ভবিষ্যত এই দৃষ্টিভঙ্গীর ভিত্তিতেই মোকাবেলা করা সম্ভব|
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভারতে কৃষি ব্যবস্থা দেশের অর্থনৈতিক নীতির মূল| দেশের ৯০ শতাংশই ক্ষুদ্র কৃষক| যাদের অল্প জমি রয়েছে| তারাই ভারতের খাদ্য নিরাপত্তার সবচেয়ে বড় শক্তি। তিনি উল্লেখ করেন, এশিয়ার বহু উন্নয়নশীল দেশে একই চাষবাস পদ্ধতি ও পরিস্থিতি লক্ষ্য করা যায়, যেখানে ভারতের মডেল প্রয়োগ করা হচ্ছে| প্রাকৃতিক চাষের উল্লেখ করে তিনি বলেন, রাসায়নিকমুক্ত প্রাকৃতিক চাষকে ব্যাপক মাত্রায় উৎসাহিত করতে হবে| ইতিমধ্যেই এর ইতিবাচক ফলাফল লক্ষ্য করা যাচ্ছে| প্রধানমন্ত্রী এবছরের কেন্দ্রীয় বাজেটে দীর্ঘস্থায়ী ও জলবায়ু স্থিতিস্থাপক চাষের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করে, ভারতে কৃষকদের সহায়ক একটি সম্পুর্ন বাস্তুতন্ত্র বিকাশের উপর গুরুত্ব দেন তিনি| জলবায়ু সহিষ্ণু ফসল উত্পাদনে গবেষনা ও উন্নয়নে সরকারের গুরুত্বারোপের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, গত ১০ বছরে প্রায় জলবায়ু সহিষ্ণু ১৯ শতাধিক ধানবীজ কৃষকদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে|
ভারতে কৃষি ক্ষেত্রে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের উপর গুরুত্ব দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কিষাননিধি প্রকল্পে এক ক্লিকেই ১০ কোটি কৃষকের ব্যাংক একাউন্টে অর্থ স্থানান্তর হয়েছে| ডিজিটাল পাবলিক পরিকাঠামো কৃষকদের ফসল সমীক্ষা করার তাৎক্ষণিক সুযোগ করে দিয়েছে| তিনি জোর দিয়ে বলেন, এই ধরনের ব্যবস্থায় কোটি কোটি কৃষক উপকৃত হবেন, তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হবে| তিনি বলেন, জমি ডিজিটাইলেজেশানের মাধ্যমে কৃষকদের, জমির জন্য একটি ডিজিটাল পরিচয় পত্র দেওয়া হবে| তাছাড়া. ড্রোণ দিদিদের জন্য ড্রোণ প্রশিক্ষনের উপরও গুরুত্ব দেন প্রধানমন্ত্রী| এবিষয়টি ব্যাপক প্রচারের আলোয় নিয়ে আসার উপর জোর দেন প্রধানমন্ত্রী| তিনি বলেন, এই সব ব্যবস্থা শুধু ভারতের কৃষকদের উপকারে আসবে তাই নয়, বিশ্ব ব্যাপী খাদ্য সুরক্ষা ব্যবস্থাকে জোরদার করবে| সম্মেলনে ব্যাপক সংখ্যক তরুণ তরুনীর উপস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী দারুন উত্সাহ ব্যক্ত করেন| পাঁচ দিন ধরে চলবে এই সম্মেলন|
সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কেন্দ্রীয় কৃষি মন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহান, নীতি আয়োগের সদস্য অধ্যাপক রমেশ চাঁদ, সম্মেলন সভাপতি অধ্যাপক মতিন কাইম, ডিএআরই এবং সচিব ও আইসিএআর – এর অধিকর্তা হিমাংশু পাঠক উপস্থিত ছিলেন|