ঢাকা, ২৫ ডিসেম্বর : বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘ ১৭ বছর পর এক গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যাবর্তন ঘটালেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার পুত্র এবং একসময় বাংলাদেশের রাজনীতির ‘ডার্ক প্রিন্স’ হিসেবে পরিচিত তারেক রহমান দীর্ঘ স্বেচ্ছা নির্বাসন কাটিয়ে বৃহস্পতিবার ঢাকায় ফিরে এসেছেন। সহিংসতা ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় জর্জরিত বাংলাদেশের জন্য যেমন এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত, তেমনই আসন্ন ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে ভারতের কৌশলগত স্বার্থের দিক থেকেও এই প্রত্যাবর্তন অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে।
দীর্ঘদিন ধরে ঢাকাসহ সারা বাংলাদেশে বিএনপির পোস্টারে তার মুখ থাকলেও তাঁর কণ্ঠস্বর অনুপস্থিত ছিল। এবার সেই নীরবতা ভাঙল। আওয়ামি লিগ নির্বাচনে অংশ নিতে না পারা, শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতি এবং খালেদা জিয়ার অসুস্থতার প্রেক্ষাপটে তারেক রহমানের দেশে ফেরা বিএনপির জন্য নতুন করে প্রাণসঞ্চার করতে পারে বলে রাজনৈতিক মহলের ধারণা।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে বাংলাদেশে উগ্র ইসলামপন্থী শক্তির উত্থান এবং প্রকাশ্য ভারত-বিরোধী বক্তব্য দিল্লির কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে। বিশেষ করে পাকিস্তানের গুপ্তচর সংস্থা আইএসআইয়ের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত জামায়াতে ইসলামির রাজনৈতিক পুনরুত্থান ভারতের কাছে বড় উদ্বেগের কারণ। শেখ হাসিনা সরকারের আমলে নিষিদ্ধ থাকা জামায়াত তাঁর ক্ষমতাচ্যুতির পর আবার রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, আসন্ন নির্বাচনে বিএনপি সর্বাধিক আসন পেতে পারে, তবে জামায়াত তাদের খুব কাছাকাছি অবস্থানে রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে জামায়াতের ছাত্র সংগঠনের অপ্রত্যাশিত সাফল্য পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে।
এই প্রেক্ষাপটে ভারতের কাছে বিএনপিকে তুলনামূলকভাবে বেশি উদার ও গণতান্ত্রিক শক্তি হিসেবে দেখা হচ্ছে, যদিও অতীতে দিল্লি-বিএনপি সম্পর্ক ছিল টানাপোড়েনপূর্ণ। ভারতের আশা, তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তনে বিএনপি সংগঠিত হবে এবং পরবর্তী সরকার গঠনের সুযোগ পাবে। ছাত্রনেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি (এনসিপি) ইতিমধ্যেই অভিযোগ করেছে যে বিএনপি দলে আওয়ামি লিগের সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করছে—যা রাজনৈতিক সমীকরণ বদলে দিতে পারে।
শেখ হাসিনার আমলে বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছিল এবং চীন ও পাকিস্তানের ক্ষেত্রে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান নিয়েছিল। কিন্তু অন্তর্বর্তী প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে সেই নীতিতে পরিবর্তনের ইঙ্গিত মিলেছে। পাকিস্তানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ানোর পাশাপাশি ভারতের সঙ্গে দূরত্ব তৈরির অভিযোগ উঠেছে।
ভারতের প্রত্যাশা, বিএনপি ক্ষমতায় ফিরলে বাংলাদেশের বিদেশনীতি আবার ভারসাম্যের পথে ফিরবে। সাম্প্রতিক সময়ে দিল্লি ও বিএনপির মধ্যে সম্পর্ক পুনর্গঠনের ইঙ্গিতও মিলেছে। ১ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী খালেদা জিয়ার গুরুতর অসুস্থতা নিয়ে প্রকাশ্যে উদ্বেগ প্রকাশ করে ভারতের সহায়তার প্রস্তাব দেন। এর জবাবে বিএনপির পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা জানানো হয়—যা বহু বছরের টানাপোড়েনের পর এক বিরল রাজনৈতিক সৌহার্দ্যের নজির।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তারেক রহমান অন্তর্বর্তী ইউনুস সরকারের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখেছেন এবং দীর্ঘমেয়াদি বিদেশনীতি নির্ধারণের অধিকার নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। পাশাপাশি তিনি জামায়াতের সমালোচনা করেছেন এবং নির্বাচনে তাদের সঙ্গে জোটে যেতে অস্বীকার করেছেন।
সব মিলিয়ে, তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন শুধু বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেই নয়, দক্ষিণ এশিয়ার কূটনৈতিক ও নিরাপত্তা সমীকরণেও নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে পারে—যার দিকে সতর্ক নজর রাখছে ভারত।

