লাদাখে রাজ্য মর্যাদার দাবিতে আন্দোলন হিংসাত্মক রূপ নিল, নিহত ৪, আহত অন্তত ৮০; সোনম ওয়াংচুকের অনশন স্থগিত, কেন্দ্র ও বিরোধীদের পাল্টাপাল্টি প্রতিক্রিয়া

লাদাখে রাজ্য মর্যাদা ও সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলের অন্তর্ভুক্তির দাবিতে লেহ অ্যাপেক্স বডির ডাকা বন্‌ধ বুধবার হিংসাত্মক রূপ নেয়। বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে অন্তত ৪ জন নিহত হন এবং ৮০ জনের বেশি আহত হন, যার মধ্যে ৪০ জন পুলিশকর্মী রয়েছেন বলে সরকারি সূত্রে জানা গেছে। বিক্ষোভকারীরা বিজেপির লেহ জেলা অফিস, একটি পুলিশ গাড়ি এবং একাধিক ব্যক্তিগত গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। হিংসা ছড়িয়ে পড়ার পর কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক জানায়, বিকেল ৪টার পর থেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে এবং আর কোনও বড় হিংসার ঘটনা ঘটেনি।

পরিবেশকর্মী ও লাদাখের দাবির অন্যতম মুখ সোনম ওয়াংচুক তাঁর ১৫ দিনব্যাপী অনশন বুধবার স্থগিত করেন। তিনি বলেন, পরিস্থিতি যাতে আরও উত্তপ্ত না হয়, সে কারণে তিনি অনশন ভঙ্গ করেছেন। সাংবাদিক সম্মেলনে ওয়াংচুক জানান, এই আন্দোলনে কোনও রাজনৈতিক দলের মদত নেই এবং হিংসার পথ পরিহার করার আবেদন জানিয়ে বলেন, “এই সহিংসতা আমাদের দাবিকে দুর্বল করে দিচ্ছে।” পরে এক ভিডিও বার্তায় ওয়াংচুক বলেন, “আমার শান্তির বার্তা ব্যর্থ হয়েছে। আমি তরুণ প্রজন্মকে বলছি, এই হিংসা বন্ধ করুন। এভাবে আন্দোলন ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”

কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক এক বিবৃতিতে হিংসার জন্য সোনম ওয়াংচুকের “প্ররোচনামূলক মন্তব্য”কে আংশিকভাবে দায়ী করে। পাশাপাশি তারা দাবি করেছে, কিছু রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত গোষ্ঠী সরকার ও লাদাখি সংগঠনগুলির মধ্যে চলমান আলোচনায় অগ্রগতি হওয়ায় অসন্তুষ্ট। কেন্দ্র জানায়, তারা লাদাখবাসীর সাংবিধানিক অধিকার রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং জনগণকে পুরনো বা উস্কানিমূলক ভিডিও ছড়াতে নিষেধ করে।

বিরোধী দলগুলি কেন্দ্রের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। সিপিআই(এম) ও সিপিআই(এম-এল) লিবারেশন মোদি সরকারকে “সংবিধান পদদলিত করে ফেডারাল কাঠামো ধ্বংস করার” অভিযোগ তোলে। সিপিআই(এম-এল) এক বিবৃতিতে জানায়, “লাদাখ ও জম্মু-কাশ্মীর দুই জায়গাতেই রাজ্য মর্যাদার দাবি জোরদার হয়েছে, কিন্তু কেন্দ্র সেই দাবিকে উপেক্ষা করছে।”

জম্মু-কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ বলেন, “লাদাখকে তো রাজ্যত্বের প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়নি, তবুও তারা আজ ক্ষুব্ধ। যারা ২০১৯ সালে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হওয়া উদযাপন করেছিল, তারাই এখন নিজেদের প্রতারিত মনে করছে।” এদিকে, শিবসেনা (উদ্ধব ঠাকরে গোষ্ঠী)-র সাংসদ প্রিয়াঙ্কা চতুর্বেদী বলেন, “শান্তিপ্রিয় লাদাখবাসীকে এমন সহিংস রূপ নিতে দেখে দুঃখ হয়। কেন্দ্রকে এবার মানুষের সঙ্গে সরাসরি আলোচনায় বসতে হবে।”

বিজেপি নেতা অমিত মালব্য এই হিংসার জন্য কংগ্রেসকে দায়ী করেন। তিনি এক্স-এ একটি ভিডিও শেয়ার করে দাবি করেন, “যিনি লাদাখে দাঙ্গা চালাচ্ছেন, তিনি হলেন কংগ্রেস কাউন্সিলর ফুন্তসোগ স্তানজিন সেপাগ। ভিডিওতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, তিনি জনতাকে উসকাচ্ছেন ও বিজেপি অফিসে হামলায় অংশ নিচ্ছেন।” তিনি রাহুল গান্ধীর দিকে ইঙ্গিত করে লেখেন, “এই-ই কি সেই অস্থিরতা যার স্বপ্ন রাহুল গান্ধী দেখেন?”

জম্মু-কাশ্মীর ন্যাশনাল কনফারেন্স-এর প্রধান ফারুক আবদুল্লাহ বলেন, “এই সহিংসতার পিছনে কোনও রাজনৈতিক দলের ভূমিকা নেই। এটি লাদাখবাসীর নিজস্ব কণ্ঠস্বর। পাঁচ বছর ধরে তাঁরা শান্তিপূর্ণভাবে দাবি জানাচ্ছেন, কিন্তু প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন না হওয়ায় যুবসমাজের ধৈর্য চূড়ান্তভাবে ভেঙে পড়েছে।” তিনি আরও বলেন, “সীমান্ত রাজ্যে এমন ঘটনা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক বিপদ। চিন বারবার অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা করে এবং এই পরিস্থিতি তাদের হাত শক্ত করবে।”

২০১৯ সালের আগস্টে জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহার করে রাজ্যকে ভাগ করে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে রূপান্তর করা হয়—জম্মু-কাশ্মীর ও লাদাখ। এরপর থেকেই লাদাখবাসী রাজ্য মর্যাদা ও ষষ্ঠ তফসিলে অন্তর্ভুক্তির দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিল মূলত উপজাতি জনগোষ্ঠীর সাংবিধানিক স্বার্থ রক্ষার জন্য প্রযোজ্য, যা বর্তমানে অসম, মেঘালয়, ত্রিপুরা ও মিজোরামে কার্যকর।

বিশ্লেষকদের মতে, এই পরিস্থিতি সরকারের প্রতি জনগণের দীর্ঘদিনের আস্থাহীনতারই প্রতিফলন। হিংসা বা রাজনৈতিক দোষারোপে না গিয়ে, আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানই এখন সময়ের দাবি।