তিরুবনন্তপুরম, সেপ্টেম্বর ১৬ : কেরালায় জনস্বাস্থ্যের এক নতুন সংকট তৈরি হয়েছে, যেখানে “ব্রেইন-ইটিং অ্যামিবা” নামে পরিচিত নাগলেরিয়া ফাওলেরি নামক প্রাণঘাতী অ্যামিবার সংক্রমণে এক মাসের মধ্যেই ১৮ জনের মৃত্যু এবং ৬৭ জনের সংক্রমণের খবর মিলেছে। এই বিরল, দ্রুত ছড়িয়ে পড়া ও প্রায়-অপরিবর্তনীয় রোগটি প্রাথমিক অ্যামিবিক মেনিনগোয়েনসেফালাইটিস নামে পরিচিত। সাধারণত এই অ্যামিবা বাস করে উষ্ণ, স্থির, অপরিচ্ছন্ন জলাশয়ে—যেমন পুকুর, হ্রদ, কুয়ো এবং অপরিষ্কৃত সুইমিং পুলে। এটি শরীরে প্রবেশ করে নাকের মাধ্যমে, এবং সোজা পৌঁছে যায় মস্তিষ্কে, যেখানে এটি কয়েক দিনের মধ্যেই রোগীকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। পিএএম রোগ এতটাই দ্রুত গতিতে ছড়ায় যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রোগীকে বাঁচানো সম্ভব হয় না। কেরালার বিভিন্ন জেলায়—বিশেষ করে তিরুবনন্তপুরম, কোঝিকোড় ও মলপ্পুরম—এই সংক্রমণ ব্যাপক হারে দেখা যাচ্ছে। সম্প্রতি তিরুবনন্তপুরম জেলার আক্কুলাম ট্যুরিস্ট ভিলেজে একটি সুইমিং পুলে সাঁতার কাটার পর ১৭ বছরের এক কিশোরের এই সংক্রমণ ধরা পড়ে। প্রশাসন তৎক্ষণাৎ ওই পর্যটন কেন্দ্র বন্ধ করে দেয় এবং শুরু হয় ব্যাপক স্যানিটাইজেশন ও তদন্ত কার্যক্রম।
এই পরিস্থিতিতে কেরালার স্বাস্থ্যমন্ত্রী বীণা জর্জ জনগণের উদ্দেশ্যে একটি সতর্কবার্তা জারি করে বলেন, “সাধারণ মানুষ যেন কোনওভাবেই অপরিষ্কৃত, ক্লোরিনবিহীন জলাশয়ে স্নান বা সাঁতার না করেন, এবং জল ব্যবহারে যেন নাকে জল না যায়, সেদিকে বিশেষভাবে খেয়াল রাখেন।” পিএএম-এর কোনও নির্দিষ্ট বা প্রমাণিত চিকিৎসা নেই বলেই, এই রোগ প্রতিরোধে একমাত্র উপায় হল সচেতনতা ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ। এই সংক্রমণ বৃদ্ধির পটভূমিতে রাজ্য সরকার চালু করেছে একটি বিশেষ রাজ্যব্যাপী অভিযান—”জলই জীবন” ক্যাম্পেইন—যার নেতৃত্বে রয়েছে হরিথা কেরালাম মিশন। এই কর্মসূচির আওতায় রাজ্যের প্রতিটি জেলায় কুয়োতে ক্লোরিনেশন, পাবলিক জলাধার পরিষ্কার, এবং বিদ্যালয় স্তরে জল পরীক্ষা ও সচেতনতামূলক প্রচার চালানো হচ্ছে। আগস্টের ৩০ ও ৩১ তারিখে একযোগে কুয়োগুলি ক্লোরিন দিয়ে পরিশোধনের কাজ হয়, এবং সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত জল বিশুদ্ধকরণ কর্মসূচি চলবে। এই প্রক্রিয়ায় স্থানীয় স্ব-শাসন সংস্থা, স্বাস্থ্যকর্মী, স্কুল ছাত্রছাত্রী এবং সাধারণ জনগণকে যুক্ত করা হয়েছে।
তবে সমস্যার গভীরতা এখানেই। বেশ কিছু সংক্রমিত ব্যক্তি এমন স্থান থেকেও সংক্রমিত হয়েছেন, যেখানে জলাশয়ে প্রত্যক্ষ নামার কোনও প্রমাণ নেই। অর্থাৎ শুধুমাত্র সাঁতার নয়, অন্যভাবে কোনওভাবে জল নাক দিয়ে ঢুকে গেলেও সংক্রমণ ঘটতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে পিএএম প্রতিরোধে জনসচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা ও পরিকাঠামোগত উন্নয়ন জরুরি। যদিও কেরালায় পিএএম সংক্রমণে মৃত্যুহার কমিয়ে ২৪ শতাংশে আনা গেছে—যা বিশ্বব্যাপী গড় ৯৭ শতাংশ মৃত্যুর হার থেকে অনেকটাই কম—তবুও চিকিৎসাবিদরা বলছেন, সংক্রমণের গতির জন্য রোগ চিহ্নিত করা এবং চিকিৎসা শুরু করাই মূল চ্যালেঞ্জ। বর্তমানে কেরালায় জল জীবন মিশন এবং অমৃত প্রকল্পের আওতায় পরিশোধিত জল সরবরাহ বাড়লেও, জল মান নিয়মিতভাবে পরিদর্শন ও রক্ষণাবেক্ষণ করতে না পারলে এই ধরনের সংক্রমণ রোখা কঠিন হবে।
দ্য লজিক্যাল ইন্ডিয়ান তাদের বিশ্লেষণে জানিয়েছে, পিএএম সংক্রমণ কেবল একটি স্বাস্থ্য সংকট নয়, এটি কেরালার জল নিরাপত্তা ও জনস্বাস্থ্য পরিকাঠামোর দুর্বলতার স্পষ্ট প্রতিফলন। সরকারের সচেতনতা অভিযান ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা সঠিক পথে থাকলেও, তা যদি দীর্ঘমেয়াদী নজরদারি ও সম্প্রদায়ভিত্তিক সচেতনতা ছাড়া পরিচালিত হয়, তাহলে এই ধরনের সংক্রমণ বারবার ফিরে আসবে। জনসাধারণের দায়িত্ব শুধু সরকারি নির্দেশ পালন করাই নয়, বরং জল ব্যবহারে সচেতন থাকা, শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করা, এবং যেকোনও উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসা গ্রহণ করা। অবশেষে বলা যায়, এই প্রাণঘাতী অ্যামিবার বিরুদ্ধে যুদ্ধ জেতার একমাত্র উপায়—সচেতনতা, প্রতিরোধ, ও স্বাস্থ্যশিক্ষা। পিএএম-এর মতো রোগগুলিকে ঠেকাতে হলে এখনই উদ্যোগী হতে হবে—সরকারকে, সমাজকে এবং প্রত্যেক নাগরিককে।

