ত্রিপুরায় ৫১ কোটি ৪৯ লক্ষ ৩৩ হাজার ৩০৩ টাকার সাইবার জালিয়াতি হয়েছে, সচেতন হোন, রাজ্যবাসীর কাছে আবেদন ডিজিপি-র

আগরতলা, ৩০ আগস্ট : সাইবার জালিয়াতির মাধ্যমে আর্থিক প্রতারণায় সারা বিশ্বে ভারত বর্তমানে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। জালিয়াতরা হাজার হাজার কোটি টাকা লুটে নিচ্ছে। স্বাভাবিকভাবে ত্রিপুরাও ওই ত্রাসের কবল থেকে রক্ষা পাচ্ছে না। এখন পর্যন্ত ত্রিপুরায় জনগণ ৫১ কোটি ৪৯ লক্ষ ৩৩ হাজার ৩০৩ টাকার সাইবার জালিয়াতির শিকার হয়েছেন। বিষয়টি উদ্বেগজনক হলেও, ত্রিপুরা পুলিশের মহানির্দেশক অনুরাগ ধ্যানকরের দাবি, এ-ধরনের জালিয়াতির প্রবণতা ক্রমশ কমছে। জনসচেতনতার মাধ্যমে তা সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু, মানুষের আরো সচেতন হতে হবে, আহবান রেখেছেন তিনি।

আজ ত্রিপুরা পুলিশের মুখ্য কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সাথে মত বিনিময়ে সাইবার জালিয়াতির বেশ কিছু তথ্য ও পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়েছে। ত্রিপুরা পুলিশের তরফে এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভুয়ো বিদ্যুৎ অথবা গ্যাস বিল এবং আরটিও চালানের নামে সাইবার অপরাধীরা প্রতারণার ফাঁদ পেতে চলেছে। এছাড়াও, বিভিন্ন ট্রেডিং গ্রুপের নামে বিনিয়োগ দুর্নীতি, পুলিশ কিংবা আয়কর আধিকারিকদের ভুয়ো পরিচিতি ব্যবহার করে ডিজিটাল এরেস্ট, ওটিপি চুরি করে ব্যাংক জালিয়াতি, সোশ্যাল মিডিয়া কিংবা ভিডিও কলের মাধ্যমে যৌন নির্যাতন, ভুয়ো ফ্র্যাঞ্চাইজি দেওয়া, লটারি, ওএলএক্স, ক্যুরিয়ার এবং হোটেল বুকিংয়ের নামে জালিয়াতি এবং সোশ্যাল মিডিয়া হ্যাক করে অর্থ আত্মসাতের হাজারো অভিযোগ মিলছে।

ত্রিপুরা পুলিশের দাবি, ওই ধরণের জালিয়াতি মোকাবিলায় প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, অপরাধীরা অন্য রাজ্য কিংবা অন্য কোন দেশ থেকে এই ধরণের অপরাধ করছে। শুধু তাই নয়, তাঁরা নিরীহ মানুষের ব্যাংক একাউন্ট, ভুয়ো সিম কার্ড, ভিপিএন, এআই এবং ডিপফেকের সহায়তায় সাধারণ মানুষকে টার্গেট করছে এবং তাঁদের কাছ থেকে বিপুল অঙ্কের অর্থ লুটে নিচ্ছে। তাছাড়া, অনেক ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্থ নাগরিক অনেক দেরিতে পুলিশের কাছে অভিযোগ জানাচ্ছে। তাতে, ওই অপরাধীরা নাগালের বাইরে চলে যেতে সক্ষম হচ্ছে।

ত্রিপুরা পুলিশের মহানির্দেশক অনুরাগ ধ্যানকর জানিয়েছেন, সাইবার জালিয়াতির প্রবণতা সারা দেশেই বেড়ে চলেছে। ২০২৩ সালে ৭৪৬৫ কোটি টাকা সাইবার অপরাধীরা লুটে নিয়েছিল। তা ২০২৪ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২২৮৪৫ কোটি টাকা। ফলে, এখন এই অপরাধের বিরুদ্ধে কঠোরভাবে রুখে দাঁড়ানোর প্রয়োজনীয়তা পড়েছে। তাঁর কথায়, শুধু মাত্র সহজ সরল নাগরিকই নন, অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে সাইবার বিশেষজ্ঞরাও ওই অপরাধের শিকার হয়েছেন। তাঁর বক্তব্য, সারা দেশে ৮৫০ মিলিয়ন নাগরিক এখন প্রতিনিয়ত ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন। সাইবার অপরাধীদের সংখ্যায় প্রতিনিয়ত বেঁড়ে চলেছে।

তিনি জানান, ত্রিপুরায় ২৬৯ জন সাইবার জালিয়াতির শিকার হয়েছেন। তাঁদের কাছ ৫১ কোটি ৪৯ লক্ষ ৩৩ হাজার ৩০৩ টাকা সাইবার অপরাধীরা লুটে নিয়েছিল। তবে, এখনও পর্যন্ত ৩৩ লক্ষ ৮৪ হাজার ১৬৩ টাকা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। এছাড়াও ২০ হাজার ৩৮৭টি ব্যাংক একাউন্ট বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। তাতে, প্রায় ৫ কোটি ৭৬ লক্ষ ৪৪ হাজার ১০৬ কোটি টাকা ফেঁসে রয়েছে। আগামী তিন মাসের মধ্যে ওই টাকা উদ্ধার করা সম্ভব হবে তিনি আশা প্রকাশ করেছেন।

এদিন তিনি সাইবার জালিয়াতির কয়েকটি উদাহরণ তুলে ধরেছেন। তিনি জানান, ত্রিপুরায় বিনিয়োগের নামে জালিয়াতিতে এক ব্যাক্তি ২.৩ কোটি টাকা খুইয়েছেন। তেমনি, ফ্র্যাঞ্চাইজি দেওয়ার নামে এক ব্যাক্তি ধাপে ধাপে প্রায় ১৮ লক্ষ টাকা জালিয়াতির শিকার হয়েছেন। সাথে তিনি যোগ করেন, এক যুবক সোশ্যাল মিডিয়ায় ভিডিও কলের মাধ্যমে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এবং প্রচুর টাকা প্রতারণার শিকার হয়েছেন।

সাইবার জালিয়াতির বছর ভিত্তিক পরিসংখ্যান তুলে ধরে তিনি জানিয়েছেন, ২০২১ সালে ১.৯৮ কোটি টাকা, ২০২২ সালে ৪.৬২ কোটি টাকা, ২০২৩ সালে ৯ কোটি টাকা, ২০২৪ সালে ২৫.৫৪ কোটি টাকা এবং ২০২৫ সালের জুলাই পর্যন্ত ৯.৭৭ কোটি টাকা প্রতারণার রিপোর্ট নথিভুক্ত হয়েছে। বিষয়টি নি:সন্দেহে খুবই উদ্বেগের স্বীকার করেও তাঁর দাবি, সাইবার অপরাধীদের মাধ্যমে আর্থিক জালিয়াতির প্রবণতা রাজ্যে ক্রমশ নিম্নমুখী।

ত্রিপুরা পুলিশের মহানির্দেশক রাজ্যবাসীর উদ্দেশ্যে সচেতন হওয়ার আবেদন জানিয়েছেন। সে-বিষয়ে নাগরিকদের নিজেকে সুরক্ষিত রাখার বেশ কিছু উপায় বলেছেন। জনসচেতনতায় ত্রিপুরা পুলিশের পরামর্শ, মোবাইল ফোনে শুধুমাত্র সেইসব অ্যাপ ইনস্টল করুন যেগুলো নিয়মিত ব্যবহার হয়। মোবাইল ফোন থেকে অব্যবহৃত অ্যাপগুলো সরিয়ে ফেলাই ভালো। পাসওয়ার্ড যথেষ্ট শক্তিশালী রাখতে হবে এবং তা বড় হাতের অক্ষর, ছোট হাতের অক্ষর এবং বিশেষ অক্ষরের সমন্বয় রেখে সাজাতে হবে। মাঝে মাঝে পাসওয়ার্ড পরিবর্তন এবং একাধিক অ্যাকাউন্টে একই পাসওয়ার্ড ব্যবহার করা এড়িয়ে চলতে হবে।

ত্রিপুরা পুলিশের আরও পরামর্শ, কল বা এসএমএস ফরোয়ার্ড করা হচ্ছে কিনা তা পর্যায়ক্রমে পরীক্ষা করা খুবই প্রয়োজন। ফরোয়ার্ড করা হলে, তাৎক্ষণিকভাবে বন্ধ করতে হবে। প্রতারণার শিকার হয়ে যদি কোনও টাকা হারানো যায়, তাহলে অবিলম্বে ১৯৩০ নম্বরে ডায়াল করে ওই লেনদেনগুলি রিপোর্ট করতে হবে। এছাড়াও, আরও আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য স্থানীয় থানা বা আগরতলার সাইবার ক্রাইম থানায় যোগাযোগ করতে পারেন।

ত্রিপুরা পুলিশ বিশেষভাবে জোর দিয়ে বলেছে, দেশে চলমান সাইবার অপরাধের সাম্প্রতিক প্রবণতা সম্পর্কে আপডেট থাকা এবং সেই অনুযায়ী নিজেকে এবং অন্যদের সুরক্ষার জন্য সমস্ত সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা খুবই জরুরী। সাথে ‘সাইবারডোস্ট’ এর পাশাপাশি ত্রিপুরা পুলিশের সোশ্যাল মিডিয়া হ্যান্ডেল ইত্যাদি অনুসরণ করা উচিত। মনে রাখবেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ব্যক্তিগত ছবি, ভয়েস এমনকি ভিডিও ব্যবহার করে ক্লোন করা যেতে পারে এবং এই ক্লোন করা ভয়েস, ভিডিও বা চিত্র দিয়ে অপরাধ করা যেতে পারে। বিনিয়োগ সম্পর্কিত কোনও সোশ্যাল মিডিয়া গ্রুপে যুক্ত হলে, অবিলম্বে সেই গ্রুপ থেকে বেরিয়ে যেতে হবে।

ত্রিপুরা পুলিশের উপদেশ, ব্যাংক লেনদেনগুলি পর্যায়ক্রমে পরীক্ষা করতে হবে এবং কোন সন্দেহজনক লেনদেন হয়েছে কিনা সেদিকে বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে। পাশাপাশি, সময়ে সময়ে মোবাইল আপডেট, ব্যক্তিগত তথ্যে অ্যাক্সেস সীমাবদ্ধ করতে সোশ্যাল মিডিয়া সাইটগুলিতে গোপনীয়তা সেটিংস ব্যবহার করতে হবে। সর্বোপরি, কম্পিউটার এবং মোবাইল ফোনের জিপিএস, ব্লুটুথ, এনএফসি এবং অন্যান্য সেন্সরগুলি সর্বদা নিষ্ক্রিয় মোডে রাখতে হবে। এগুলি কেবল প্রয়োজনের সময় সক্রিয় করা যেতে পারে।

সাইবার জালিয়াতি থেকে রক্ষা পেতে ত্রিপুরা পুলিশ সকলকে সতর্ক করে বলেছে, অজানা ব্যক্তির কাছ থেকে কল, বার্তা বা সোশ্যাল মিডিয়া থেকে কোনও প্রস্তাব পেলে প্রলুব্ধ হবেন না। এগুলি ফিশিং কল বা এসএমএস হতে পারে। উচ্চ রিটার্ন বা নিষ্পত্তির সাথে বিনিয়োগ বা বিদ্যুৎ বিল/গ্যাস বিল বা এই জাতীয় কোনও বিষয়ে কোনও লিঙ্কে ক্লিক করে কোনও “.apk” ফাইল ইনস্টল করবেন না। পরিচিত বা অপরিচিত কোনও ব্যক্তির সাথে কোনও পরিচয়পত্র, ব্যক্তিগত ছবি বা ভিডিও শেয়ার করবেন না। ঘটনাক্রমে বা দুর্ঘটনাক্রমে এই ধরণের সামগ্রী পাবলিক ডোমেইনে প্রকাশিত হতে পারে এবং ভবিষ্যতে আপনাকে বিব্রত/মানহানি করতে পারে। বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে, কোনও অজুহাতে মোবাইল ফোনে কোনও অজানা ব্যক্তির সাথে কোনও ওটিপি শেয়ার করবেন না। কোনও সামাজিক মিডিয়া অ্যাকাউন্ট থেকে কোনও পরিচিত ব্যক্তির কাছে টাকা চাওয়া হলে, আপনার কাছে সংরক্ষিত যোগাযোগ নম্বর দিয়ে কল করে সেই ব্যক্তির আসল পরিচয় যাচাই না করে তাকে কোনও টাকা পাঠাবেন না।

ত্রিপুরা পুলিশের পরামর্শ, সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারিত বিজ্ঞাপন থেকে কোনও নিবন্ধ কিনবেন না। এই ধরণের বিজ্ঞাপন মিথ্যা হতে পারে। ‘বাড়ি থেকে কাজ’ ইত্যাদি সম্পর্কিত এসএমএস বা সোশ্যাল মিডিয়া থেকে প্রাপ্ত কোনও যোগাযোগের জবাব দেবেন না। কমন সার্ভিস সেন্টার (সিএসসি) মালিকদের জন্য যদি আপনি ইউপিআই থেকে টাকা পাওয়ার পরে কাউকে নগদ টাকা দেন, তাহলে আপনাকে অবশ্যই সেই নগদ টাকা প্রাপকের সঠিক নথি রাখতে হবে। অননুমোদিত অনলাইন গেম খেলবেন না, বিশেষ করে যেখানে আপনি অর্থ উপার্জন করতে পারেন। এই ধরনের অর্থ জালিয়াতির টাকা হতে পারে এবং এক্ষেত্রে আপনার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।

ত্রিপুরা পুলিশের আরও পরামর্শ, কোনও অজানা বা অপ্রচলিত ব্যক্তির কাছ থেকে অজানা ভিডিও কল গ্রহণ করবেন না। অনিয়ন্ত্রিত ঋণ অ্যাপ ইনস্টল এবং ঋণের জন্য আবেদন করবেন না। ডিজিটাল অ্যারেস্ট সম্পর্কিত কোনও কিছুর জবাব দেবেন না। কারণ, ডিজিটাল অ্যারেস্ট বলে কিছু নেই। কলের অন্য পাশে ইউনিফর্ম পরা পুলিশ সদস্য একজন প্রতারক, সেটা আপনাকেই বুঝতে হবে। ত্রিপুরা পুলিশ ক্রিপ্টোকারেন্সি ওয়ালেটে পি২পি লেনদেন না করার পরামর্শ দিয়েছে। সাথে বলেছে, সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টের নগদীকরণের জন্য কোনও ওটিপি শেয়ার করবেন না। অধিকক্ত, অব্যবহৃত বা অপ্রয়োজনীয় সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট বন্ধ হয়ে যেতে পারে।