উত্তর ও পূর্ব ভারতের একাধিক রাজ্যে বন্যা ও দুর্যোগে জনজীবন বিপর্যস্ত: জম্মু-কাশ্মীর, পাঞ্জাব, হিমাচল প্রদেশ ও ওড়িশায় অব্যাহত দুর্ভোগ

শ্রীনগর/চণ্ডীগড়/শিমলা/ভুবনেশ্বর, ২৭ অগস্ট : উত্তর ও পূর্ব ভারতের একাধিক রাজ্যে টানা বৃষ্টিপাতের জেরে সৃষ্ট বন্যা, ভূমিধস এবং নদীর জলস্তর বৃদ্ধি জনজীবনকে সম্পূর্ণরূপে স্তব্ধ করে দিয়েছে। জম্মু ও কাশ্মীরের বিভিন্ন জেলায় টানা ২৪ ঘণ্টার ভারী বৃষ্টিতে অন্তত ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। জম্মু ডিভিশনে পরিস্থিতি এতটাই গুরুতর যে, বৈষ্ণোদেবী যাত্রা সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে। ত্রিকূট পর্বতের উপরে যাত্রাপথে একাধিক ভূমিধসে ৬ জন ভক্ত প্রাণ হারিয়েছেন এবং আহত হয়েছেন আরও ১৮ জন। দোডা জেলায় আরও চারজনের মৃত্যু হয়েছে। হিমকোটি যাত্রাপথও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে প্রশাসনের তরফে। জম্মুর কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ ও মোবাইল নেটওয়ার্ক পরিষেবা ব্যাহত হয়েছে। সব সরকারি অফিস বন্ধ রাখার নির্দেশ জারি হয়েছে, যদিও জরুরি পরিষেবা চালু আছে। ত্রাণ ও উদ্ধার কাজ দ্রুত সম্পন্ন করার জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সমস্ত কর্মীদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। ত্রাণ সহায়তা ও জরুরি যোগাযোগের জন্য বিভিন্ন জেলার জন্য আলাদা হেল্পলাইন নম্বর চালু করা হয়েছে, যা প্রশাসনের সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মেও উপলব্ধ। এদিকে, জম্মু-কাশ্মীরের প্রধান নদীগুলি — যেমন তাওই, চেনাব, নেরু ও কালনাই — এর জলস্তর মারাত্মকভাবে বেড়ে গিয়েছে। আবহাওয়া দফতর আগাম আরও বৃষ্টির পূর্বাভাস দিয়ে রাখায় পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যেতে পারে বলে আশঙ্কা।

অন্যদিকে, পাঞ্জাবেও বন্যা পরিস্থিতি দ্রুত জটিল হয়ে উঠছে। বিশেষত রাভি, বেয়াস ও শতদ্রু নদীর জলধারায় বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। পাঠানকোট, গুরুদাসপুর, ফজিলকা, ফিরোজপুর, হোশিয়ারপুর, কপুরথলা ও তরণতারণ সহ অন্তত সাতটি জেলা হাই অ্যালার্টে রাখা হয়েছে, অমৃতসরেও সতর্কতা জারি হয়েছে। রঞ্জিত সাগর ড্যাম ও পং ড্যামের জলস্তর সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছেছে, ফলে সেখান থেকে নিয়ন্ত্রিতভাবে জল ছাড়া হচ্ছে। ভাকরা ড্যাম থেকেও এক সপ্তাহ ধরে নিয়ন্ত্রিত জল ছাড়া হচ্ছে যাতে বাঁধের কোনও ক্ষতি না হয়। রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে সব আধিকারিকদের ছুটি বাতিল করে, ২৪ ঘণ্টা নজরদারির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি জেলায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ ঘর খোলা হয়েছে এবং স্থানীয় প্রশাসন উদ্ধার ও ত্রাণকাজে নিযুক্ত হয়েছে।

হিমাচল প্রদেশে চিত্র আরও ভয়াবহ। চম্বা, কাংরা ও মান্ডি জেলায় ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টির ফলে ভূমিধস ও সড়ক বিচ্ছিন্নতার ঘটনা ঘটেছে। চম্বা জেলাটি বিগত চার দিন ধরে দেশের বাকি অংশ থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন। নেই টেলিযোগাযোগ পরিষেবা, ভেঙে গেছে একাধিক রাস্তা, বহু ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়েছে। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জয়রাম ঠাকুর রাজ্য সরকারকে তীব্র আক্রমণ করে বলেন, “সরকার দুর্যোগ মোডে আছে, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় নয়।” তাঁর অভিযোগ, মুখ্যমন্ত্রী সুখবিন্দর সিং সুক্কুর সরকার সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে এই দুর্যোগ মোকাবেলায়। তিনি দাবি করেন, হাজার হাজার গবাদি পশু মারা গেছে, বহু ঘরবাড়ি ধসে পড়েছে, যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, কিন্তু সরকার রাজনৈতিক বিবৃতি দিতেই ব্যস্ত। এর মধ্যে আইএমডি চম্বা, মান্ডি এবং কাংরায় লাল সতর্কতা জারি করেছে পরবর্তী দুই দিনের জন্য। ২৮ অগস্ট থেকে বিভিন্ন জেলায় হলুদ এবং কমলা সতর্কতা কার্যকর থাকবে, যার মধ্যে রয়েছে শিমলা, কুলু, লাহুল-স্পীতি প্রভৃতি জেলা। মান্ডি-কুলু মহাসড়ক ও বিকল্প পথগুলো একাধিক ভূমিধসে ক্ষতিগ্রস্ত, ফলে যোগাযোগ ব্যাহত।

এদিকে পূর্ব ভারতের ওড়িশা রাজ্যেও বন্যা পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। যদিও নদীগুলোর জলস্তর ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে, তবু বালাসোর, ভদ্রক ও জাজপুর জেলার প্রায় ১৭০টি গ্রাম এখনও জলবন্দি। জাজপুরে কানি নদীর একটি বাঁধ ভেঙে ৪৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। সুদারগড় জেলার সাহাজবাহাল এলাকায় একটি ব্রিজ পার হওয়ার সময় ট্রেলার ট্রাক ভেসে গিয়ে এক চালক নিখোঁজ হয়েছেন, ট্রাকের সহকারীকে উদ্ধার করেছে দমকল কর্মীরা। নতুন করে বঙ্গোপসাগরের উত্তর-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলে একটি নিম্নচাপ তৈরি হয়েছে, যা আরও দু’দিনে শক্তিশালী হয়ে উঠবে বলে জানিয়েছে আইএমডি। এর ফলে ২৬ ও ২৭ অগস্ট রাজ্যের একাধিক জেলায় অতি ভারী বৃষ্টিপাতের সতর্কতা জারি হয়েছে। কোরাপুট ও মালকানগিরি জেলায় ২০ সেন্টিমিটারের বেশি বৃষ্টিপাত হতে পারে বলে ‘রেড ওয়ার্নিং’ জারি হয়েছে। এছাড়া কালাহান্ডি, রায়গড়া, নওরংপুর, কন্ধমাল, গজপতি সহ একাধিক জেলায় কমলা সতর্কতা দেওয়া হয়েছে। রাজ্যপাল হরি বাবু কম্ভমপাটি রাজ্য প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠক করে ক্ষয়ক্ষতির পূর্ণাঙ্গ পর্যালোচনা করেন এবং ‘জিরো ক্যাজুয়ালটি’র লক্ষ্যে কাজ চালিয়ে যেতে বলেন। একই সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার প্রয়োজনীয়তার কথাও উঠে আসে, যাতে উত্তর ওড়িশায় বন্যার পুনরাবৃত্তি রোধ করা যায়।

সব মিলিয়ে উত্তর ও পূর্ব ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগ এক মারাত্মক মানবিক সংকটের রূপ নিচ্ছে। প্রবল বৃষ্টিপাত, নদীর জলস্তর বৃদ্ধি, বাঁধ থেকে জল মুক্তি, এবং ভূমিধসের জেরে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। প্রশাসনের তরফে উদ্ধার ও ত্রাণকাজ চালানো হলেও, আবহাওয়া দফতরের সতর্কতা অনুযায়ী আরও কয়েকদিন দুর্যোগের আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। সমস্ত নাগরিককে নিরাপদ স্থানে থাকার, প্রশাসনের নির্দেশ মেনে চলার এবং জরুরি প্রয়োজনে নির্ধারিত হেল্পলাইন নম্বরে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।