ভিয়েতনামে টাইফুন কাজিকির তাণ্ডবের আশঙ্কা: ৬ লাখের কাছাকাছি মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরানো হয়েছে, বন্ধ বিমানবন্দর ও স্কুল

হ্যানয়, ২৫ আগস্ট : ভিয়েতনামে ধেয়ে আসছে বছরের সবচেয়ে শক্তিশালী ঝড় টাইফুন কাজিকি, যার কারণে দেশজুড়ে ব্যাপক সতর্কতা ও প্রস্তুতির মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে গণউৎখাত ও জরুরি ব্যবস্থা। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, কাজিকির বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় ১৬৬ কিলোমিটার পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে এবং এটি সোমবার স্থানীয় সময় দুপুর ১টার দিকে ভিয়েতনামের মধ্য উপকূলে আছড়ে পড়বে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যেই সরকার ৫.৮৬ লক্ষের বেশি মানুষকে উপকূলবর্তী এলাকা থেকে সরিয়ে নিয়েছে এবং দুইটি অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দর বন্ধ করে দিয়েছে। উপকূলবর্তী অঞ্চলে অবস্থানরত সব মাছ ধরার নৌকাগুলিকে ডেকে এনে বন্দরে রাখা হয়েছে, যাতে ঝড়ের আঘাতে কোনোরকম প্রাণহানি না ঘটে।

ভিয়েতনামের জাতীয় আবহাওয়া সংস্থা জানিয়েছে, টাইফুন কাজিকি আসার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হবে ভারী বর্ষণ, যার ফলে দেখা দিতে পারে ভয়াবহ বন্যা ও ভূমিধস। সেই আশঙ্কায় ১৬,৫০০ সেনা সদস্য ও ১.০৭ লক্ষ আধাসামরিক বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে উদ্ধার ও ত্রাণকাজের জন্য। উপকূলবর্তী পাঁচটি প্রদেশে ৩.২৫ লক্ষের বেশি মানুষকে স্থানীয় স্কুল, সরকারি ভবন ও ইনডোর স্টেডিয়ামের মতো অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত শহর ভিনহ, যেখানে প্রবল বৃষ্টিপাতের কারণে ইতিমধ্যেই জলমগ্ন হয়ে পড়েছে বিভিন্ন এলাকা, রাস্তাঘাট শুনশান ও প্রায় সব দোকানপাট বন্ধ রয়েছে। বাসিন্দারা এবং ব্যবসায়ীরা তাদের ঘরের ও দোকানের প্রবেশপথে বালির বস্তা সাজিয়ে জল আটকানোর চেষ্টা করছেন। ইনডোর স্টেডিয়ামে আশ্রয় নেওয়া ৬৬ বছর বয়সী লে মানহ তুং বলেন, “আমি আমাদের শহরে এত বড় টাইফুন কখনো আসতে দেখিনি। একটু ভয় লাগছে অবশ্যই, তবে এটা প্রকৃতির হাতে — আমাদের কিছু করার নেই।”

টাইফুন কাজিকি ভিয়েতনামে এই বছরের পঞ্চম বড় ধরনের ঘূর্ণিঝড়, তবে এটিকেই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে শক্তিশালী বলে বিবেচনা করা হচ্ছে। সমুদ্র উপকূলে ৯.৫ মিটার বা প্রায় ৩১ ফুট উঁচু ঢেউ তৈরি করছে এই ঝড়। যদিও ঘূর্ণিঝড়টি স্থলভাগের দিকে এগিয়ে এলে ধীরে ধীরে তার শক্তি কমবে বলে ধারণা করছে যৌথ টাইফুন সতর্কীকরণ কেন্দ্র। কারণ, গালফ অফ টঙ্কিন অঞ্চলে সমুদ্রের তাপমাত্রা তুলনামূলকভাবে কম হওয়ায় সেখানে ঝড়ের তীব্রতা হ্রাস পেতে পারে।

কাজিকির প্রভাব শুধু ভিয়েতনামেই সীমাবদ্ধ নয়। ঝড়টির প্রভাবে চীনের দক্ষিণাঞ্চলীয় দ্বীপ হাইনানে প্রায় ২০,০০০ মানুষকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে এবং সানিয়া শহরের পর্যটন কেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে ভিয়েতনামের বেশ কিছু অভ্যন্তরীণ বিমান সংস্থা দশটির বেশি ফ্লাইট বাতিল করেছে। এদিকে, দেশটির কৃষি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ২০২৫ সালের প্রথম সাত মাসে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে ১০০-র বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন বা নিখোঁজ হয়েছেন, এবং প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে ২১ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি। এর আগে গত বছর সেপ্টেম্বরে টাইফুন ইয়াগি ভিয়েতনামের উত্তরাঞ্চলে আঘাত হেনে শতাধিক প্রাণহানি ঘটায় এবং ৩.৩ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি ক্ষতি করে।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, মানবসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্রমশ বাড়ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরিমাণ ও তীব্রতা। আগের তুলনায় এখন ঝড়ের গতি, মাত্রা ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি হচ্ছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মতো জলবায়ু সংবেদনশীল অঞ্চলে এ ধরনের পরিস্থিতি ভবিষ্যতে আরও ঘন ঘন দেখা দিতে পারে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাই টাইফুন কাজিকির মতো দুর্যোগ শুধু একটি প্রাকৃতিক ঘটনা নয়, বরং এটি জলবায়ু পরিবর্তনের এক কঠিন বাস্তবতাকেও সামনে এনে দিয়েছে।