গুয়াহাটি, ১১ আগস্ট : অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকায় বসবাসরত মূলনিবাসী হিন্দুদের অস্ত্র লাইসেন্স দেওয়ার সিদ্ধান্তকে প্রকাশ্যে সমর্থন জানিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য, এই পদক্ষেপ ওইসব এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য অত্যন্ত জরুরি। তিনি উদাহরণ হিসেবে দক্ষিণ সালমারা, মনকাচর ও ভাগবরের মতো জেলাগুলির কথা উল্লেখ করে বলেন, “অসমে কিছু গ্রাম আছে যেখানে ৩০ হাজার মানুষের মধ্যে মাত্র ১০০ জন সনাতনী হিন্দু বাস করেন। যদি এসব পরিবার আইনসম্মত প্রক্রিয়ায় আবেদন করেন, তবে তাঁদের অস্ত্র লাইসেন্স দেওয়া যেতে পারে। সনাতন ধর্ম রক্ষা করা আমাদের কর্তব্য।”
গত ২৮ মে অসম মন্ত্রিসভা একটি বিশেষ সিদ্ধান্ত নেয়, যাতে সংবেদনশীল ও দুর্গম এলাকায় বসবাসকারী মূলনিবাসী নাগরিকদের অস্ত্র লাইসেন্স দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছে ধুবড়ি, নগাঁও, মোরিগাঁও, বারপেটা, গ্বালপাড়া এবং দক্ষিণ সালমারা-মনকাচর—যেখানে বাংলাদেশি উৎসের মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং স্থানীয় হিন্দুরা সংখ্যালঘু। মুখ্যমন্ত্রীর দাবি, এই সিদ্ধান্ত বহুদিনের দাবি পূরণ করছে। ১৯৮৫ সাল থেকে এ ধরনের উদ্যোগের দাবি উঠছিল, কিন্তু কোনও সরকার সাহস করে তা কার্যকর করেনি। তাঁর মতে, যদি এই সিদ্ধান্ত আগেই নেওয়া হতো, তবে স্থানীয়রা জমি বিক্রি করে এলাকা ছেড়ে চলে যেতেন না।
সরকারি পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এই নীতি নাগরিকদের সামরিকীকরণ করার জন্য নয়, বরং অবৈধ হুমকি রোধ ও স্থানীয়দের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ও আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর জন্য। সরকারের দাবি, এসব এলাকায় স্থানীয়রা প্রায়শই বাংলাদেশ বা নিজের গ্রাম থেকেই হামলার শিকার হতে পারেন এবং তাঁরা দীর্ঘদিন ধরে এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে বাস করছেন।
ভারতে সাধারণ নাগরিকদের অস্ত্র রাখার অধিকার ১৯৫৯ সালের ‘আর্মস অ্যাক্ট’-এর অধীনে সীমিত। নাগরিকরা শুধুমাত্র নন-প্রোহিবিটেড বোর (NPB) বন্দুকের লাইসেন্স পেতে পারেন এবং তা পেতে হলে জীবনের জন্য গুরুতর হুমকির প্রমাণ দেখাতে হয়। এই প্রমাণের জন্য সাধারণত একটি এফআইআর দাখিল করা হয়। প্রক্রিয়াটি দীর্ঘ—প্রথমে জেলা পুলিশ সুপারের কাছে আবেদন জমা দিতে হয়, এরপর ঠিকানা যাচাই ও অপরাধমূলক রেকর্ড পরীক্ষা করা হয়। আবেদনকারীকে সাক্ষাৎকারে ডাকা হয়, যেখানে শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতা এবং অস্ত্র রাখার প্রয়োজনীয়তার কারণ যাচাই করা হয়। যদি কারণ যুক্তিসঙ্গত হয়, রিপোর্ট অপরাধ শাখা ও ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোতে পাঠানো হয়। সমস্ত ধাপ পেরিয়ে জেলা পুলিশ কর্তৃপক্ষ সন্তুষ্ট হলে লাইসেন্স মঞ্জুর হয়।
অসমের এই নতুন নীতি বিরোধী দলগুলির কড়া সমালোচনার মুখে পড়েছে। তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ সুশ্মিতা দেব বলেন, “এই সিদ্ধান্ত সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষুণ্ণ করছে এবং এটি প্রমাণ করে যে রাজ্যের পুলিশ ও সীমান্তরক্ষী বাহিনী আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখতে অক্ষম।” তাঁর অভিযোগ, সরকার অস্ত্র লাইসেন্স দিতে পারে ঠিকই, কিন্তু কেউ সেই অস্ত্র কী উদ্দেশ্যে ব্যবহার করবে তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। একবার লাইসেন্স পেয়ে গেলে তার অপব্যবহারের ঝুঁকি থেকেই যায়।
তিনি মূলনিবাসীর সংজ্ঞা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন—“আজ পর্যন্ত মূলনিবাসী কারা, তা স্পষ্ট নয়। মুখ্যমন্ত্রী ইচ্ছেমতো ঠিক করেন কে মূলনিবাসী আর কে নয়। এই নীতি একটি বিপজ্জনক নজির তৈরি করছে এবং বার্তা দিচ্ছে যে ‘ডাবল ইঞ্জিন সরকার’-এর অধীনে অসম নিরাপদ নয়।”
রাজনৈতিক মহলের মতে, এই নীতি আসন্ন সময়ে অসমে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বাড়াতে পারে। যেখানে ধর্মীয় ভিত্তিতে অস্ত্র লাইসেন্স দেওয়ার প্রস্তাব কার্যকর হয়, সেখানে সামাজিক বিভাজন গভীর হওয়ার আশঙ্কা থাকে। অন্যদিকে, সমর্থকরা মনে করছেন, এই পদক্ষেপ দীর্ঘদিন ধরে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগা একটি ছোট জনগোষ্ঠীকে আত্মরক্ষার সুযোগ দেবে এবং তাঁদের এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার প্রবণতা রোধ করবে।
এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে তা কেবল আইনশৃঙ্খলা নয়, বরং আসন্ন রাজ্য ও জাতীয় রাজনীতিতেও বড় প্রভাব ফেলতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

