নয়াদিল্লি, ২৫ জুলাই : আজ ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ দিন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তার দীর্ঘ ও নিরবচ্ছিন্ন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে আরেকটি ঐতিহাসিক মাইলফলক স্পর্শ করলেন। এই দিনে তিনি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত ইন্দিরা গান্ধীর ৪৮ বছর পুরনো রেকর্ড অতিক্রম করে দ্বিতীয় দীর্ঘতম একটানা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিজের নাম ইতিহাসে লিপিবদ্ধ করলেন। আজ, ২৫ জুলাই ২০২৫-এ মোদী পরপর ৪,০৭৮ দিন দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেন, যেখানে ইন্দিরা গান্ধীর একটানা মেয়াদ ছিল ৪,০৭৭ দিন (২৪ জানুয়ারি ১৯৬৬ – ২৪ মার্চ ১৯৭৭)।
ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুই এখনো দেশের ইতিহাসে সর্বাধিক দিন পর্যন্ত একটানা প্রধানমন্ত্রী ছিলেন — ১৯৫২ সালের এপ্রিলে প্রথম সাধারণ নির্বাচনের পর থেকে ১৯৬৪ সালের ২৭ মে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত। প্রধানমন্ত্রী মোদী এখন তাঁর পরেই অবস্থান করছেন।
নরেন্দ্র মোদীর রাজনৈতিক যাত্রা শুরু হয় গুজরাট রাজ্যে। ২০০১ সালে তিনি প্রথমবার গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নিযুক্ত হন এবং এরপর তিনবার পরপর— ২০০২, ২০০৭ এবং ২০১২ সালে বিধানসভা নির্বাচনে জয়ী হয়ে রাজ্যের নেতৃত্ব দেন। তাঁর শাসনামলে গুজরাট শিল্পোন্নয়ন ও অবকাঠামো উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি লাভ করে, যার ফলস্বরূপ তিনি জাতীয় রাজনীতিতে নিজেকে একটি শক্তিশালী বিকল্প নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন।
২০১৪ সালে মোদী বিজেপির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে প্রথমবারের মতো লোকসভা নির্বাচনে নেতৃত্ব দেন এবং নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার গঠন করেন। এরপর ২০১৯ ও ২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচনেও বিজেপিকে পুনরায় শক্তিশালী জয় এনে দিয়ে তিনি পরপর তিনবার প্রধানমন্ত্রী হন। উল্লেখযোগ্যভাবে, তিনি ভারতের ইতিহাসে একমাত্র অ-কংগ্রেসি প্রধানমন্ত্রী যিনি দুইটি পূর্ণ মেয়াদ শেষ করে তৃতীয়বার সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় ফিরেছেন।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর দীর্ঘতম একটানা শাসনকালে ভারত অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে। তাঁর শাসনামলে দেশের রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও প্রশাসনিক কাঠামোয় দৃঢ়তা এসেছে, যা তাঁকে ভারতের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে। মোদী হলেন স্বাধীনতার পরে জন্ম নেওয়া ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী, যা তাঁকে ইতিহাসে একটি অনন্য স্থান দিয়েছে। তিনি ভারতের ইতিহাসে দীর্ঘতম মেয়াদকালীন অ-কংগ্রেসি প্রধানমন্ত্রী হিসেবেও রেকর্ড গড়েছেন।
এছাড়া, তিনি একমাত্র অ-কংগ্রেসি নেতা, যিনি টানা তিনটি লোকসভা নির্বাচনে তাঁর দলকে সংখ্যাগরিষ্ঠতা সহকারে জয়ী করে কেন্দ্রীয় সরকার গঠন করতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁর এই ধারাবাহিক সাফল্য তাঁকে পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর পরে দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে, যিনি একটানা তিনটি জাতীয় নির্বাচনে দলের নেতৃত্বে জয় পেয়েছেন। মোদীর আরেকটি উল্লেখযোগ্য অর্জন হল—তিনি একমাত্র নেতা যিনি ছয়টি বড় নির্বাচন, যার মধ্যে রয়েছে গুজরাট বিধানসভার তিনটি এবং লোকসভার তিনটি, দলের প্রধান হিসেবে জিতেছেন। তাছাড়া, তিনি ভারতের একমাত্র প্রধানমন্ত্রী, যিনি দক্ষিণ বা পশ্চিম ভারতের অ-হিন্দিভাষী রাজ্য থেকে উঠে এসেও দীর্ঘদিন ধরে দেশের নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন। এই সব ব্যতিক্রমী সাফল্য মোদীর নেতৃত্বগুণ ও রাজনৈতিক দক্ষতার এক অনন্য নিদর্শন।
ভাদনগরের একটি সাধারণ পরিবারে জন্ম নেওয়া নরেন্দ্র মোদীর শৈশব কেটেছে নানা চ্যালেঞ্জের মধ্যে দিয়ে। তিনি তাঁর বাবার সঙ্গে রেলস্টেশনে চা বিক্রি করতেন। এরপর আরএসএস-এর স্বয়ংসেবক হিসেবে তাঁর আদর্শবাদী কর্মজীবন শুরু হয়, যা পরে তাঁকে নিয়ে যায় ভারতীয় জনতা পার্টিতে। সংগঠনের বিভিন্ন স্তরে কাজ করার পর তিনি হয়ে ওঠেন দলের মুখ, এবং পরে দেশের প্রধানমন্ত্রী।
তাঁর নেতৃত্বের সবচেয়ে বড় শক্তি বলা হয় তাঁর জনসংযোগ দক্ষতা, রাজনৈতিক কৌশল, এবং আত্মবিশ্বাসী আন্তর্জাতিক উপস্থিতি। কূটনৈতিক দিক থেকে মোদীর আমলে ভারত অনেক বেশি দৃঢ়, আত্মনির্ভর এবং বৈশ্বিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী দেশ হিসেবে পরিচিত হয়েছে।
এই ঐতিহাসিক দিনটি শুধু মোদীর জন্য নয়, ভারতীয় রাজনীতির ইতিহাসেও এক উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। তাঁর নেতৃত্বে ভারত আগামী দিনে কীভাবে অগ্রসর হবে, তা নিয়ে যেমন প্রত্যাশা রয়েছে, তেমনই রয়েছে সমালোচনাও। তবে দীর্ঘ ২৪ বছরের ধারাবাহিক ও সফল শাসনকাল — যার মধ্যে ১৩ বছর গুজরাট এবং ১১ বছরের বেশি সময় কেন্দ্রে — তাঁকে ভারতের অন্যতম দীর্ঘস্থায়ী ও প্রভাবশালী নেতায় পরিণত করেছে।
এই রেকর্ড ভাঙা অর্জনের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী শুধু একজন রাজনৈতিক নেতা নন, ভারতের আধুনিক ইতিহাসের একটি অধ্যায় হয়ে উঠেছেন।

