ভারতের সরকারি বেকারত্ব তথ্য নিয়ে রইটার্সের প্রতিবেদন বিভ্রান্তিকর ও ভিত্তিহীন: পরিসংখ্যানগত বিশ্লেষণে পাল্টা যুক্তি সরকারি পক্ষের

নয়াদিল্লি, ২৩ জুলাই : ভারতের সরকারি বেকারত্ব তথ্য নিয়ে রইটার্সের একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদন ঘিরে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। ২২ জুলাই প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনটি দাবি করে যে ভারতের সরকার-প্রদত্ত বেকারত্ব সংক্রান্ত পরিসংখ্যান ‘অসঠিক’ ও বাস্তবতার প্রতিফলন নয়। তাদের দাবি, প্রায় ৫০ জন অর্থনীতিবিদের উপর ভিত্তি করে করা এক ‘সমীক্ষা’র মাধ্যমে তারা এই বিশ্লেষণে উপনীত হয়েছে। তবে পরিসংখ্যানবিদ, নীতি বিশ্লেষক এবং সরকারি পরিসংখ্যান সংস্থাগুলি এই প্রতিবেদনের উপর কঠোর আপত্তি জানিয়ে বলেছে, এটি তথ্যভিত্তিক নয়, বরং অনুমাননির্ভর ও পদ্ধতিগতভাবে দুর্বল।

বিশ্লেষকদের মতে, রইটার্স প্রতিবেদনটি মূলত কিছু নাম না-জানা অর্থনীতিবিদের ‘ধারণা’-র উপর দাঁড় করানো হয়েছে, যাদের নাম, পরিচয়, বা নির্বাচন পদ্ধতি সম্পর্কে কোনও ধরনের স্বচ্ছতা দেখানো হয়নি। এমনকি, তাঁদের মতামত কি পদ্ধতিগত প্রশ্নমালার মাধ্যমে নেওয়া হয়েছে, তা-ও অস্পষ্ট। এতে স্পষ্ট হয় যে, সংশ্লিষ্ট সমীক্ষায় নমুনা বৈচিত্র্য, পরিসংখ্যানগত গুরুত্বপূর্ণতা, কিংবা ম্যাক্রো ইকোনমিক সূচকের সঙ্গে তুলনার কোনও উল্লেখ নেই।

পরিসংখ্যানবিদদের মতে, এই ধরনের ‘পারসেপশন সার্ভে’ মূল্যবান হলেও, তা কখনোই প্রতিনিধিত্বশীল, বৃহৎ পরিসরে সংগৃহীত এবং বৈজ্ঞানিকভাবে বিশ্লেষিত সরকারি জরিপের বিকল্প হতে পারে না।

ভারতের শ্রম বাজার পরিস্থিতি বোঝার জন্য মূল ভিত্তি হলো পিএলএফএস, যা পরিচালনা করে ভারতের ন্যাশনাল স্ট্যাটিস্টিকাল অফিস। এই জরিপ ২০১৭ সাল থেকে শ্রম ও কর্মসংস্থানের তথ্য সরবরাহ করছে এবং এটি আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা-র সংজ্ঞা অনুযায়ী পরিচালিত হয়। পিএলএফএস একটি স্ট্রাটিফায়েড মাল্টি-স্টেজ র্যান্ডম স্যাম্পলিং ডিজাইনের উপর ভিত্তি করে তৈরি, যা দেশের গ্রামীণ ও শহরাঞ্চলের প্রতিনিধি নমুনার মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে। ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে পিএলএফএস মাসিক ভিত্তিতে তথ্য প্রকাশ করছে, যা শ্রমবাজার পর্যবেক্ষণে আরও তীক্ষ্ণতা এনেছে।

পিএলএফএস তথ্য শুধুমাত্র আইএলও নয়, বিশ্বব্যাংক, ইউএনডিপি, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)-এর মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলিও ব্যবহার করে। এটি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার প্রেক্ষিতে ভারতের অগ্রগতি মূল্যায়নের গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান।

পিএলএফএস-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এর স্বচ্ছতা ও খোলামেলা তথ্যপ্রকাশ। এনএসও নিয়মিতভাবে তাদের নমুনা পরিকল্পনা, প্রশ্নপত্র, ওজনন পদ্ধতি, এবং সম্ভাব্য ত্রুটি -র তথ্য প্রকাশ করে। এই খোলামেলা পদ্ধতি গবেষক, নীতিনির্ধারক এবং আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের জন্য পিএলএফএস-কে একটি গ্রহণযোগ্য ও নির্ভরযোগ্য উৎসে পরিণত করেছে।

পিএলএফএস-এর ২০২৩–২৪ সালের তথ্য অনুযায়ী, ভারতে ১৫ বছর বা তার ঊর্ধ্বে বয়সী জনগণের শ্রম বাহিনী অংশগ্রহণের হার ৬০.১%, যা ২০১৭–১৮ সালে ছিল মাত্র ৪৯.৮%। একই সময়কালে কর্মী জনসংখ্যা অনুপাত ৪৬.৮% থেকে বেড়ে ৫৮.২% হয়েছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, বেকারত্বের হার (ইউআর) ২০১৭–১৮ সালের ৬.০% থেকে কমে ২০২৩–২৪ সালে হয়েছে মাত্র ৩.২%।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই পরিবর্তন ভারতীয় অর্থনীতিতে শ্রমশক্তির বৃহত্তর সংযোজন এবং উৎপাদনশীল কর্মসংস্থানের প্রতিফলন। যুবসমাজের বেকারত্বও উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে—১৭.৮% থেকে নেমে হয়েছে ১০.২%, যা আইএলও-এর ২০২৪ সালের বৈশ্বিক গড় ১৩.৩%-এর চেয়ে অনেক ভালো।

ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক আরবিআই-এর কেএলইএমএস ডাটাবেস অনুসারে, ২০১৭–১৮ সাল থেকে ২০২৩–২৪ সাল পর্যন্ত দেশে মোট কর্মসংস্থানের পরিমাণ ৪৭.৫ কোটি থেকে বেড়ে ৬৪.৩৩ কোটিতে পৌঁছেছে, অর্থাৎ মাত্র ৬ বছরে ১৬.৮৩ কোটি কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে।

এমপ্লয়িজ প্রভিডেন্ট ফান্ড অর্গানাইজেশন (ইপিএফও)-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪–২৫ অর্থবর্ষে ১.২৯ কোটি নতুন নেট সদস্য যুক্ত হয়েছেন, যা ২০১৮–১৯ সালের ৬১.১২ লক্ষের তুলনায় দ্বিগুণ। শুধু এপ্রিল ২০২৫ মাসেই যুক্ত হয়েছেন ১৯.১৪ লক্ষ নতুন কর্মী। এই প্রবণতা ভারতের প্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মসংস্থানের সম্প্রসারণ ও সামাজিক সুরক্ষার বিস্তৃতিকে নির্দেশ করে।

পিএলএফএস এর মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে, স্বনিযুক্তদের হার ৫২.২% থেকে বেড়ে হয়েছে ৫৮.৪%, এবং ক্যাজুয়াল শ্রমিকদের হার ২৪.৯% থেকে কমে হয়েছে ১৯.৮%। এই পরিবর্তন প্রমাণ করে, ভারতীয় অর্থনীতিতে উদ্যোক্তা-ভিত্তিক ও আত্মনির্ভর জীবিকার বিকাশ ঘটছে।

রইটার্স প্রতিবেদনে যেখানে মজুরি স্থবির থাকার দাবি করা হয়েছে, সেখানে পিএলএফএস তথ্য এক ভিন্ন চিত্র তুলে ধরে। ২০১৭ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বর ত্রৈমাসিকে, সরকার বাদে অন্যান্য কাজে নিযুক্ত ক্যাজুয়াল শ্রমিকদের গড় দৈনিক মজুরি ছিল ২৯৪, যা ২০২৪ সালের এপ্রিল–জুন ত্রৈমাসিকে বেড়ে হয়েছে ৪৩৩। নিয়মিত বেতনভুক্ত কর্মীদের মাসিক গড় আয়ও একই সময়ে ১৬,৫৩৮ থেকে বেড়ে হয়েছে ২১,১০৩।

সরকারের বহু-মুখী উদ্যোগ যেমন স্কিল ইন্ডিয়া, ডিজিটাল ইন্ডিয়া, স্টার্ট-আপ ইন্ডিয়া এবং ন্যাশনাল এডুকেশন পলিসি (এনইপি)২০২০-র ফলে গ্র্যাজুয়েটদের চাকরির উপযোগিতা ২০১৩ সালের ৩৩.৯৫% থেকে ২০২৪ সালে ৫৪.৮১%-তে উন্নীত হয়েছে । নতুন ৯৯,৪৪৬ কোটি এমপ্লয়মেন্ট লিঙ্কড ইনসেনটিভ (ইএলআই) স্কিম আগামী কয়েক বছরে ৩.৫ কোটি নতুন চাকরি তৈরির লক্ষ্যে চালু হয়েছে।

এমজিএনআরইজিএস, পিএমইজিপি, ডিডিইউ-জিকেওয়াই, পিএমএমওয়াই, ডিএওয়াই-এনআরএলএম, ডিএওয়াই-এনইউএলএম -এর মতো কর্মসূচিগুলি সরাসরি ও পরোক্ষভাবে ব্যাপক কর্মসংস্থান তৈরি করেছে। গিগ ইকোনমি, স্টার্টআপ, ডিজিটাল পরিষেবা, এবং গ্লোবাল ক্যাপাবিলিটি সেন্টার (জিসিসি)-এ চাকরির সুযোগ দ্রুত বাড়ছে।

রইটার্স প্রতিবেদনটি একটি ‘পারসেপশন বেসড’ জরিপের উপর নির্ভর করে ভারতের সরকারি বেকারত্ব পরিসংখ্যানকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে, কিন্তু কোনও ধরনের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি, পূর্ণাঙ্গ পদ্ধতি বা ডেটা বিশ্লেষণ উপস্থাপন করেনি।
ভারতের কর্মসংস্থান পরিস্থিতি বর্তমানে অগ্রগতির পথে—বৃদ্ধি পাচ্ছে অংশগ্রহণ, কমছে বেকারত্ব, বাড়ছে মজুরি ও আয় এবং বৈচিত্র্য আসছে কর্মসংস্থানের প্রকৃতিতে। তাই যেকোনও বিশ্লেষণ কিংবা সমালোচনা যদি তথ্যবিহীন, অনুমানভিত্তিক এবং পক্ষপাতদুষ্ট হয়, তবে তা শুধুই বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে।