এআই প্রযুক্তির অপব্যবহারে অসমের এক নারীর জীবনে বিভীষিকা, সাইবার অপরাধে গ্রেফতার অভিযুক্ত

ডিব্রুগড়, ১৪ জুলাই : একটি সাধারণ ইনস্টাগ্রাম প্রোফাইল, কয়েকটি “প্ররোচনামূলক” ছবি ও ভিডিও এবং তাতেই রাতারাতি ভাইরাল হয়ে উঠেছিল অসমের এক নারীর নাম। অনলাইনে ছড়িয়ে পড়ে যে তিনি পর্নো ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে পা রেখেছেন। সংবাদমাধ্যম, সোশ্যাল মিডিয়া এবং সাধারণ মানুষ যখন তা নিয়ে চর্চায় মত্ত, তখনই সত্য সামনে আনে ডিব্রুগড় পুলিশ। জানা যায়, ওই নারী আসলে একটি ভয়ঙ্কর সাইবার অপরাধের শিকার, যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই-এর সাহায্যে তার ছবি ও ভিডিও বিকৃত করে তা ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। অভিযুক্ত প্রীতিম বড়া, যিনি ভুক্তভোগীর প্রাক্তন সহপাঠী, তাকে শনিবার রাতে তিনসুকিয়া থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

ডিব্রুগড় জেলার এসপি (ভারপ্রাপ্ত) সিজাল আগরওয়াল রবিবার সাংবাদিক সম্মেলনে জানান, ভুক্তভোগী নারী গত ১২ জুলাই থানায় অভিযোগ দায়ের করেন। তার অভিযোগ, একটি ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্ট থেকে তাঁর মর্ফ করা নগ্ন ছবি ও ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রোফাইলে এমনকি তাঁকে প্রখ্যাত পর্নস্টার কেন্ড্রা লাস্ট-এর সঙ্গে দেখা যায়, যার মাধ্যমে ভুয়ো দাবি করা হয় যে তিনি পর্ন ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করছেন।

তদন্তে নেমে পুলিশ ওই ইনস্টাগ্রাম প্রোফাইলটির তথ্য সংগ্রহ করে এবং একটি মোবাইল নম্বরের সূত্র ধরে শনাক্ত করে অভিযুক্ত প্রীতিম বড়াকে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে বড়া স্বীকার করে, এটি মূলত ‘ব্যক্তিগত প্রতিশোধ’ হিসেবে শুরু করেছিল। কিন্তু পরে বিষয়টি আর্থিক লাভের দিকে মোড় নেয়।

পুলিশ জানিয়েছে, অভিযুক্ত বিভিন্ন এআই ভিত্তিক সফটওয়্যার যেমন ওপেনআর্ট, মিডজার্নি এবং কিছু সিনেমা/পর্নোগ্রাফি শেয়ারিং সাইট যেমন ডিজায়ার মুভিজ -এর মতো প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করেছিল ছবি এবং ভিডিও বিকৃত করতে। এই সফটওয়্যার ও ওয়েবসাইটগুলির মাধ্যমে বাস্তবসম্মত ভুয়া পর্নোগ্রাফিক কনটেন্ট তৈরি করে তা অনলাইনে ছড়িয়ে দেওয়া হয়।

এআই প্রযুক্তির মাধ্যমে তৈরি এইসব ছবি ও ভিডিও এতটাই নিখুঁত ও বিশ্বাসযোগ্য ছিল যে অনেকেই তা আসল বলে ধরে নেয়। কিছু কিছু ছবি এমনকি ২০২২ সাল থেকে পোস্ট করা হচ্ছিল, কিন্তু চলতি বছরের ২ জুলাই একটি বিশেষ পোস্টের পরেই প্রোফাইলটি ভাইরাল হয়ে যায়। সেখানে ভুক্তভোগীর মর্ফ করা ছবি একজন আন্তর্জাতিক পর্নস্টারের সঙ্গে পোস্ট করে বলা হয়, “নতুন জার্নি শুরু হচ্ছে”।

পুলিশের তদন্তে আরও জানা গেছে, অভিযুক্ত একটি লিঙ্কট্রি পেজ তৈরি করে, যার মাধ্যমে দর্শকরা সাবস্ক্রিপশন নিয়ে পর্নো কনটেন্ট দেখতে পারত। এতে সে প্রায় ₹১০ লক্ষ টাকা উপার্জন করে। এসপি আগরওয়াল জানান, “প্রথমে প্রতিশোধের উদ্দেশ্য থাকলেও পরে বিষয়টি ব্যবসায়িক রূপ নেয়। সে লোভে পড়ে এই অপরাধ চালিয়ে যেতে থাকে।”

গ্রেফতারের সময় পুলিশের টিম অভিযুক্তের কাছ থেকে একটি ল্যাপটপ, দুটি মোবাইল ফোন, একটি ট্যাবলেট, একটি হার্ড ডিস্ক, একটি পেন ড্রাইভ, একাধিক সিম কার্ড এবং একটি কার্ড রিডার জব্দ করেছে। এগুলোর ফরেনসিক পরীক্ষা করা হবে, যাতে আরও তথ্য মিলতে পারে অভিযুক্তের কার্যকলাপের বিষয়ে।

এসপি আরও জানান, “এই ধরণের ডিজিটাল অপরাধে বহু স্তরের ডেটা বিশ্লেষণ প্রয়োজন হয়। আমরা কেন্দ্রীয় এবং বেসরকারি বিভিন্ন সাইবার সিকিউরিটি সংস্থার সাহায্য নিচ্ছি। তদন্ত এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে।”

প্রীতিম বড়ার বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির নতুন সংস্করণ, ভারতীয় ন্যায় সংহিতা এর আওতায় একাধিক ধারা প্রয়োগ করা হয়েছে। অভিযুক্তের বিরুদ্ধে প্রযোজ্য ধারা গুলোর মধ্যে রয়েছে ধারা ৭৪, যা নারীর মর্যাদা ক্ষুণ্ন করার সাথে সম্পর্কিত, ধারা ৭৫, যা যৌন হেনস্থার সাথে সম্পর্কিত, এবং ধারা ২৯৪, যা অশ্লীল কনটেন্ট প্রচারের অভিযোগে ব্যবহৃত হয়েছে। আরও রয়েছে ধারা ৩৩৬(৪), যা ডিজিটাল তথ্যের মাধ্যমে হুমকি প্রদানের ক্ষেত্রে, ধারা ৩৫১(২), যা ডিজিটাল মাধ্যমে মিথ্যা তথ্য তৈরি করে প্রতারণা করার অভিযোগে এবং ধারা ৩৫৬(২), যা মানহানির জন্য দায়ী। ১৩ জুলাই অভিযুক্ত প্রীতিম বড়াকে আদালতে পেশ করা হলে পুলিশ ৯ দিনের রিমান্ড চায়, তবে আদালত ৫ দিনের পুলিশ হেফাজত মঞ্জুর করেছে।

এই ঘটনাটি ভারত তথা গোটা বিশ্বের সামনে এক গুরুতর প্রশ্ন তুলে ধরেছে—জেনারেটিভ এআই প্রযুক্তির অপব্যবহার কীভাবে ব্যক্তিগত জীবনে ভয়াবহ প্রভাব ফেলতে পারে। ভুক্তভোগী নারীর জীবনে এই ঘটনার মানসিক ও সামাজিক প্রভাব অপরিসীম। তিনি এখনও আইনি সহায়তার মাধ্যমে ন্যায়বিচারের অপেক্ষায় রয়েছেন।

পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে জনগণকে এই বিষয়ে সতর্ক থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে এবং বিশেষ করে এআই প্রযুক্তির সচেতন এবং দায়িত্বশীল ব্যবহারের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।