নয়াদিল্লি, ১৩ জুলাই : ভারতের প্রাক্তন সুপ্রিম কোর্ট বিচারপতি সঞ্জয় কিশন কৌল বলেছেন, দেশের বিচারব্যবস্থাকে এলজিবিটিকিউআইএ ব্যক্তিদের অধিকারের সুরক্ষায় অনুঘটকের ভূমিকা পালন করতে হবে। তিনি মনে করিয়ে দেন, আইনি স্বীকৃতির পথে কিছু অগ্রগতি হলেও এলজিবিটিকিউআইএ সম্প্রদায়ের পূর্ণ অধিকার এখনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। শনিবার রাজধানীতে কেশব সূরি ফাউন্ডেশন এবং বিদি সেন্টার ফর লিগ্যাল পলিসির যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এক নীতিগত সুপারিশ পত্র প্রকাশ অনুষ্ঠানে তিনি এই মন্তব্য করেন।
বিচারপতি কৌল বলেন, “ভারতের আইন প্রণয়নের পরিসরে এলজিবিটিকিউআইএ স্বীকৃতি কিছুটা অগ্রসর হলেও বহু গুরুত্বপূর্ণ ফাঁক রয়ে গেছে। ‘কুইয়ার’ শব্দটির কোনও স্পষ্ট সংজ্ঞা এখনো ভারতীয় আইনে নেই এবং অ্যাসেক্সুয়াল ব্যক্তিদের সম্পর্কে নীতিগত স্তরে কার্যত কোনও স্বীকৃতিই নেই।”
তিনি জানান, “নীতিগত কাঠামোতে এদের অন্তর্ভুক্ত না করায় তারা একেবারেই অদৃশ্য থেকে গেছেন। আইন তৈরি হলেও তা যদি প্রয়োগযোগ্য না হয় কিংবা স্পষ্ট সংজ্ঞা না থাকে, তবে সেই আইন বাস্তবে কার্যকর হয় না।”
নিজের বক্তব্যে বিচারপতি কৌল সাম্প্রতিক টেনিস খেলোয়াড় রাধিকা যাদবের হত্যাকাণ্ডের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, “যে সমাজে একজন নারী নিজের পছন্দমতো জীবনসঙ্গী বেছে নিলে তাকে এখনও হত্যা করা হয়, সেখানে কেবল সমকামী সম্পর্ক নয়, নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখাটাই হয়ে ওঠে চ্যালেঞ্জ।”
তিনি বলেন, “শুধু শহর নয়, গ্রামাঞ্চলেও দেখা যায়, অন্তর্জাত বা আন্তঃধর্ম বিয়ের ক্ষেত্রে পরিবার নিজের সন্তানকে হত্যা করতে পিছপা হয় না। সম্প্রতি এমন একটি ঘটনায় এক বাবা নিজের মেয়েকে গুলি করে হত্যা করেছে—এটি আমাদের সামাজিক মানসিকতার নির্মম চিত্র তুলে ধরে।”
তিনি বলেন, ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সমাজ কল্যাণ ও ক্ষমতায়ন মন্ত্রক কয়েকটি প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে—যেমন, কুইয়ার দম্পতিদের জন্য যৌথ রেশন কার্ড, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট এবং মৃত্যুর পর সঙ্গীর দেহ দাবি করার অধিকার।
তবে এই পদক্ষেপগুলির সীমাবদ্ধতা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এসব এখনো কেবলমাত্র প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে সীমাবদ্ধ, কোনোটিই আইন দ্বারা সমর্থিত নয়। অর্থাৎ, যে কোনও সরকার এগুলো বাতিল করতে পারে, এবং এলজিবিটিকিউআইএ দম্পতিদের অধিকার আবারও ঝুঁকির মুখে পড়ে যেতে পারে।”
বিচারপতি কৌল আরও বলেন, “আজকের যুগে সামাজিক উন্নয়নের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আর্থিক প্রবেশাধিকার। কিন্তু এলজিবিটিকিউআইএ সম্প্রদায়ের মানুষদের জন্য ব্যবসা শুরু করা, বাড়ি কেনা বা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলার মতো প্রাথমিক চাহিদাও দুষ্কর হয়ে উঠেছে। কারণ পরিচয়পত্রে তারা তাঁদের সঠিক লিঙ্গ পরিচয় দেখাতে পারেন না।”
তিনি বলেন, “এ এক অস্তিত্বগত চ্যালেঞ্জ—যেখানে একজন নাগরিকের মৌলিক অধিকার শুধু তার পরিচয় ও পছন্দের জন্য বাধার মুখে পড়ে। এ থেকে মুক্তি পেতে হলে সমাজ এবং রাষ্ট্র—উভয়ের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আবশ্যক।”
তিনি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন, “ভারতের আইনসভা ও নির্বাহী বিভাগে এখনও এলজিবিটিকিউআইএ ব্যক্তিদের অধিকার নিয়ে একটি স্থবিরতা রয়েছে। সমলিঙ্গ বিবাহ, সন্তান দত্তক নেওয়া বা উত্তরাধিকার সংক্রান্ত অধিকার নিয়ে কোনও নির্দিষ্ট আইন নেই, যার ফলে তাঁদের ভবিষ্যৎ আজও অনিশ্চিত।”
তাঁর মতে, সরকারকে বিভিন্ন মন্ত্রক ও বিভাগের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে এগিয়ে আসতে হবে, যেন কুইয়ার অধিকার শুধুমাত্র আদালতের দরজায় সীমাবদ্ধ না থাকে।
তবে বিচারপতি কৌল আশার সুরেও কথা বলেন। তিনি বলেন, “দেশের শহরাঞ্চল এবং তরুণ প্রজন্ম অনেক বেশি গ্রহণযোগ্যতা দেখাচ্ছে। যদিও গ্রামীণ সমাজে এখনও রক্ষণশীলতা বিরাজ করছে, কিন্তু পরিবর্তনের হাওয়া শুরু হয়েছে।”
তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রকাশ্য সমকামী নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হার্ভি মিল্কের কথা উদ্ধৃত করে বলেন, “আশা কখনও নীরব থাকবে না”—‘আশা কখনও নীরব থাকে না।’
প্রাক্তন বিচারপতি কৌলের বক্তব্যে স্পষ্ট, এলজিবিটিকিউআইএ সম্প্রদায়ের অধিকার রক্ষা শুধুমাত্র নৈতিক বা সামাজিক ইস্যু নয়, এটি একটি সাংবিধানিক দায়িত্ব। তাঁর মতে, বিচারব্যবস্থা কেবলমাত্র ন্যায় বিচার করার মাধ্যম নয়, বরং সমাজে নতুন পথ দেখানোর এক শক্তিশালী হাতিয়ার। সেই হাতিয়ার ব্যবহার করেই এলজিবিটিকিউআইএ সম্প্রদায়ের জন্য একটি সমতার পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব।

