নয়াদিল্লি, ১২ জুলাই : ভারতের ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসা ব্যবস্থা ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সমন্বয়ে গঠিত একাধিক উদ্ভাবনী উদ্যোগ এবার আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিশেষ স্বীকৃতি লাভ করল। সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রকাশ করেছে একটি গুরুত্বপূর্ণ টেকনিক্যাল ব্রিফ—“ ম্যাপিং দ্য এপ্লিকেশন অফ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইন ট্রেডিশনাল মেডিসিন”, যেখানে বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে ভারতের আয়ুষ (আয়ুর্বেদ, যোগ, ইউনানি, সিদ্ধা, সওয়া রিগ্পা ও হোমিওপ্যাথি) ব্যবস্থায় এআই-এর প্রয়োগ ও তা থেকে উদ্ভূত বৈজ্ঞানিক সম্ভাবনা।
এই ঐতিহাসিক প্রকাশনাটি ডব্লিউএইচও-এর ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসায় এআই ব্যবহারের প্রথম রোডম্যাপ হিসেবেও বিবেচিত হচ্ছে। আশ্চর্যের বিষয় হল, এই উদ্যোগের সূচনা হয়েছে ভারতের প্রস্তাবনা থেকে, যা আরও একবার প্রমাণ করল যে, স্বাস্থ্য খাতে উদ্ভাবন ও প্রযুক্তি ব্যবহারে ভারত এখন বিশ্ব নেতৃত্বের আসনে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদনে বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়েছে ভারতের ঐতিহ্যবাহী জ্ঞানভান্ডারকে ডিজিটাল মাধ্যমে সংরক্ষণের পদক্ষেপ, যেমন— ট্রেডিশনাল নলেজ ডিজিটাল লাইব্রেরি (টিকেডিএল), যা প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতির জ্ঞানকে ডিজিটাল ফর্মে সংরক্ষণ ও আন্তর্জাতিক মানে রক্ষার এক মডেল হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। ডব্লিউএইচও জানিয়েছে, ভারতই প্রথম দেশ যারা টিকেডিএল-এর মতো উদ্যোগ নিয়ে ঐতিহ্যকে ভবিষ্যতের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে।
প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদী-র “এআই ফর অল ” দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ডব্লিউএইচও এই ব্রিফে ভারতের বহুমাত্রিক উদ্যোগের প্রশংসা করেছে। প্রধানমন্ত্রী ২০২৩ সালে জিপিএআই সামিটে বলেছিলেন, “আমরা সরকারী নীতিমালা ও কর্মসূচি এআই-কে জনকল্যাণে কাজে লাগানোর লক্ষ্যেই সাজিয়েছি। সমাজের সর্বস্তরের জন্য সমন্বিত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির পথে এআই এক শক্তিশালী হাতিয়ার।”
এই প্রেক্ষাপটে, আয়ুষ ও স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী (স্বতন্ত্র দায়িত্বপ্রাপ্ত) শ্রী প্রতাপরাও জাধব বলেছেন, “ডব্লিউএইচও-র এই স্বীকৃতি ভারতের ঐতিহ্য ও প্রযুক্তির একত্র প্রয়োগে দৃঢ় প্রতিশ্রুতি ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন। সাহি, নমস্তে ও আয়ুষ রিসার্চ পোর্টাল-এর মতো ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে আমরা শুধু চিকিৎসার আধুনিকীকরণ করছিই না, বরং ঐতিহ্যবাহী জ্ঞানকে তথ্যভিত্তিক, ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও বৈজ্ঞানিক কাঠামোয় স্থাপন করছি।”
আয়ুষ মন্ত্রকের সচিব বৈদ্য রাজেশ কোটেচা জানান, ডব্লিউএইচও-এর প্রকাশনায় যে ভারতীয় উদ্যোগগুলির কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হল—আয়ুরজেনোমিক্স প্রকল্প, যা আয়ুর্বেদের ‘প্রকৃতি’ তত্ত্বের সঙ্গে আধুনিক জেনোমিক্স-এর সংযোগ স্থাপন করে। এআই-এর সহায়তায় এই প্রকল্প ব্যক্তির শারীরিক গঠন, রোগপ্রবণতা ও প্রতিরোধক্ষমতা নির্ধারণে সহায়তা করে এবং ব্যক্তিকেন্দ্রিক চিকিৎসা ও প্রতিরোধের দিশা দেয়। এই প্রকল্প আন্তর্জাতিক গবেষণার ক্ষেত্রেও একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে।
আয়ুষ গ্রিড, যা ২০১৮ সালে চালু হয়, এই ডিজিটাল রূপান্তরের মূল ভিত্তি। এর মাধ্যমে আয়ুষ খাতের জন্য এক শক্তিশালী তথ্যভান্ডার, ই-গভর্ন্যান্স, গবেষণা ও রোগী পরিষেবা ব্যবস্থার ডিজিটাল অবকাঠামো গড়ে উঠেছে। এই গ্রিডের আওতায় তৈরি হওয়া সাহি (স্মার্ট আয়ুর্বেদ হেরিটেজ ইন্টারফেস), নমস্তে (ন্যাশনাল আয়ুষ রোগ এবং মানসম্মত টার্মিনোলজিস ইলেকট্রনিক) এবং আয়ুষ রিসার্চ পোর্টাল ইত্যাদি প্ল্যাটফর্মগুলি ব্যবহারকারীদের জন্য চিকিৎসার স্বচ্ছতা, গ্রহণযোগ্যতা এবং কার্যকারিতা বাড়িয়ে তুলছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার টেকনিক্যাল ব্রিফে ভারতের উদ্যোগগুলিকে উদ্ভাবনী ও ভবিষ্যত-দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এতে আরও বলা হয়েছে, এআই-এর সাহায্যে আয়ুর্বেদের নাড়ি নির্ণয়, জিভের পর্যবেক্ষণ ও প্রকৃতি নিরূপণের মতো প্রথাগত পদ্ধতিগুলিকে মেশিন লার্নিং ও ডিপ নিউরাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে আরও উন্নত ও নির্ভুল করা সম্ভব হয়েছে। এতে শুধু চিকিৎসার নির্ভুলতা বেড়েছে না, বরং প্রতিরোধমূলক চিকিৎসাও আরও কার্যকর হয়েছে।
ডব্লিউএইচও এর রিপোর্টে ভারতীয় গবেষকদের এমন উদ্যোগেরও প্রশংসা করা হয়েছে যেখানে এআই ব্যবহৃত হয়েছে হরবাল ফর্মুলেশনের জিনগত ও অণু-জৈবিক গঠন বিশ্লেষণ এবং আধুনিক রোগে সেগুলোর পুনরায় ব্যবহার নির্ধারণে। এআই-চালিত কেমিক্যাল সেন্সর ব্যবহার করে আয়ুর্বেদের রস, গুণ ও বির্য-এর মতো বৈশিষ্ট্য বিচার করাও এখন সম্ভব হচ্ছে।
প্রতিবেদনে এটাও বলা হয়েছে, ভারতে এআই প্রযুক্তির সহায়তায় ঐতিহ্যবাহী ও আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার মধ্যে একটি কার্যকর সেতুবন্ধন গড়ে উঠছে। এর ফলে রোগ নির্ণয়, ওষুধের প্রতিক্রিয়া বিশ্লেষণ, ওষুধ আবিষ্কারের গতি এবং রোগ প্রতিরোধে এক নতুন দিশা সৃষ্টি হয়েছে।
ডব্লিউএইচও ভারত সরকারের এই উদ্যোগগুলিকে শুধুমাত্র প্রযুক্তিনির্ভর নয়, বরং বৈজ্ঞানিকভাবে দায়িত্বপূর্ণ এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার পথিকৃত হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এই ব্রিফ ভারতের আয়ুষ খাতে গবেষণা ও উদ্ভাবনের প্রতি আন্তর্জাতিক মহলের আগ্রহ বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এই প্রকাশনা আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য নীতিনির্ধারণে ভারতের নেতৃত্বের স্বীকৃতি। এটি শুধু ভারতীয় ঐতিহ্যকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরেনি, বরং দেখিয়েছে কীভাবে এআই-এর মতো অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রাচীন জ্ঞানকে আধুনিক বিজ্ঞান ও মানবকল্যাণের সঙ্গে যুক্ত করা যায়। আয়ুষ মন্ত্রকের মতে, এই স্বীকৃতি ভবিষ্যতে আরও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, গবেষণা এবং উদ্ভাবনের পথে ভারতকে এগিয়ে নিয়ে যাবে এবং বৈশ্বিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় আয়ুষ-এর ভূমিকা আরও গুরুত্বপূর্ণ করে তুলবে।

