ধর্মশালা, ৩ জুলাই : ভারত সরকার চীনের সাম্প্রতিক মন্তব্যের বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান নিয়েছে, যেখানে বেইজিং দাবি করেছিল যে তিব্বতের ধর্মগুরু দালাই লামার পরবর্তী অবতার নির্বাচন চীনা আইন ও প্রথা অনুযায়ী হতে হবে। এর পাল্টা জবাবে, ভারত বৃহস্পতিবার জানিয়ে দিয়েছে যে দালাই লামার উত্তরসূরি নির্বাচন শুধুমাত্র তাঁর নিজের সিদ্ধান্ত এবং তাঁর অফিসের আওতাভুক্ত গ্যাডেন ফোডরাং ট্রাস্টের মাধ্যমেই হবে।
ভারতের সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রী কিরেন রিজিজু ধর্মশালায় সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে বলেন, “দালাই লামার পদ শুধুমাত্র তিব্বতি জনগণের নয়, বরং সারা বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের কাছে একটি আধ্যাত্মিক শক্তির প্রতীক। তাঁর উত্তরসূরি নির্বাচন করার অধিকার একমাত্র তাঁরই এবং এ বিষয়ে অন্য কোনো দেশের হস্তক্ষেপ মেনে নেওয়া যায় না।”
তিনি আরও বলেন, “এই অনুষ্ঠান একটি নিখাদ ধর্মীয় উপলক্ষ। এখানে কোনো রাজনৈতিক বার্তা নেই, তবে চীনের এই দাবি আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতার পরিপন্থী।”
রিজিজু এবং জনতা দল (ইউনাইটেড) নেতা লালন সিং বর্তমানে ধর্মশালায় অবস্থান করছেন দালাই লামার ৯০তম জন্মদিন উদযাপনের উপলক্ষে। এই অনুষ্ঠানে তাঁরা ভারত সরকারের পক্ষ থেকে অংশ নিয়েছেন এবং তিব্বতি সম্প্রদায়ের সঙ্গে ঐক্য প্রকাশ করেছেন।
এই উত্তেজনার সূচনা ঘটে যখন চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রকের মুখপাত্র মাও নিং একটি বিবৃতি দিয়ে বলেন, “দালাই লামার পুনর্জন্ম অবশ্যই চীনের আইন, ধর্মীয় প্রথা এবং ঐতিহাসিক রীতিনীতি অনুসরণ করে হতে হবে। এই বিষয়ে বেইজিং-এর অনুমোদন অপরিহার্য।” চীন দীর্ঘদিন ধরেই দাবি করে আসছে যে তিব্বত চীনের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলির নেতৃত্ব নির্বাচনেও তাদের কর্তৃত্ব থাকবে।
তবে দালাই লামার অফিস বুধবার এক বিবৃতিতে স্পষ্ট করে জানিয়ে দেয় যে, তাঁর উত্তরসূরি নির্বাচনের প্রক্রিয়া একটি নিখুঁত ধর্মীয় এবং ঐতিহাসিক পদ্ধতি অনুসরণ করে পরিচালিত হবে এবং এটি গ্যাডেন ফোডরাং ট্রাস্টের অধীনেই থাকবে। এই ট্রাস্ট হল দালাই লামার সরকারিভাবে স্বীকৃত আধ্যাত্মিক ও প্রশাসনিক কাঠামো।
২০১১ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর দালাই লামা একটি ঐতিহাসিক বিবৃতিতে জানিয়েছিলেন, “আমার উত্তরসূরি নির্বাচনের সমস্ত দায়িত্ব আমি গ্যাডেন ফোডরাং ট্রাস্টের হাতে তুলে দিচ্ছি। এটি একটি ধর্মীয় প্রশ্ন এবং এর কোনও রাজনৈতিক রূপ থাকা উচিত নয়।”
১৯৫৯ সালে তিব্বতে চীনা শাসনের বিরুদ্ধে এক ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর দালাই লামা ভারত পালিয়ে আসেন এবং হিমাচল প্রদেশের ধর্মশালায় নির্বাসনে বসবাস শুরু করেন। সেই থেকে তিনি তিব্বতের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ঐতিহ্য রক্ষার প্রতীক হয়ে উঠেছেন। বিশ্বজুড়ে তাঁর শান্তির বার্তা, অহিংসার দর্শন এবং মানবিক মূল্যবোধের প্রচার তাঁকে একটি আন্তর্জাতিক মর্যাদার আসনে বসিয়েছে।
চীন বরাবরই দালাই লামাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা বলে চিহ্নিত করে আসছে এবং আশঙ্কা করা হচ্ছে যে বেইজিং ভবিষ্যতে তাদের পছন্দমতো একজন “দালাই লামা” মনোনীত করতে পারে, যা তিব্বতের ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং সংস্কৃতির জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, দালাই লামার পুনর্জন্ম নিয়ে এই বিতর্ক শুধু একটি ধর্মীয় ইস্যু নয়, বরং এটি তিব্বতের ওপর চীনের দখলদারিত্ব, ধর্মীয় অধিকার এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার রক্ষার বৃহত্তর প্রশ্নের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
চীনের চাপ ও হুমকি সত্ত্বেও দালাই লামার অবস্থান স্পষ্ট এবং অবিচল। তিনি বলেছেন, “আমার পরবর্তী অবতার কোথায় এবং কিভাবে জন্ম নেবেন, সে সিদ্ধান্ত আমি নিজেই নেব এবং আমার অফিসের ট্রাস্ট তা বাস্তবায়ন করবে।” ভারতের এই কড়া অবস্থান আন্তর্জাতিক স্তরে একটি স্পষ্ট বার্তা হিসেবে গৃহীত হয়েছে যে ধর্মীয় স্বাধীনতার ক্ষেত্রে কোনও বহিরাগত চাপ বরদাস্ত করা হবে না।
এই অবস্থান আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে এক গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করল ধর্মীয় স্বাধীনতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে এমন সময়ে যখন ধর্মীয় নেতৃত্বকেও রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করার চেষ্টা চলছে।

