১২ দিনের সংঘর্ষ শেষে অস্থায়ী স্বস্তি : ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধবিরতির ঘোষণা

তেহরান, ২৫ জুন: ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান ১২ দিনের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর অবশেষে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা করা হয়েছে, যা বহু যুদ্ধাক্রান্ত সাধারণ মানুষের মধ্যে সাময়িক স্বস্তি এনে দিয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই সংঘর্ষকে “১২ দিনের যুদ্ধ” বলে আখ্যা দিয়েছেন এবং জানান, উভয় পক্ষ প্রায় একসঙ্গেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনের সঙ্গে শান্তি আলোচনা শুরুর আবেদন জানিয়েছিল।

যুদ্ধবিরতির ঘোষণা আসে ইরানি রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমে। সংবাদে জানানো হয়, “শত্রুর ওপর অস্ত্রবিরতি চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।” ইরানের দাবি, এটি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসনের জবাবে একটি “সামরিক প্রতিক্রিয়া।” এই ঘোষণার কয়েক ঘণ্টা আগে ইরান কাতারে অবস্থিত একটি মার্কিন ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়, যা এই সংঘর্ষকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যায় এবং মার্কিন বাহিনীকেও সরাসরি এই অঞ্চলের সংঘাতে যুক্ত করে তোলে।

মানবাধিকার সংস্থা এইচআরএনএ-র তথ্যমতে, ২২ জুন পর্যন্ত ইরানে ৮৬৫ জন নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে ২১৫ জন সেনাসদস্য, ৩৬৩ জন বেসামরিক নাগরিক এবং ২৮৭ জনের পরিচয় অজ্ঞাত। এছাড়া আহত হয়েছেন আরও অন্তত ৩,৩৯৬ জন। ইরানি স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ যদিও এই সংখ্যাকে কমিয়ে দেখিয়েছে—তাদের হিসেব অনুযায়ী মৃতের সংখ্যা ২২৪ এবং আহত ২,৫০০-এর বেশি, তবে উভয় সূত্রই জানিয়েছে, বেশিরভাগ হতাহত সাধারণ মানুষ।

ইসরায়েলি বিমান হামলা শুরুতে সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে কেন্দ্রীভূত থাকলেও পরবর্তীতে তা ব্যাপকভাবে বেসামরিক আবাসিক এলাকায় এবং এমনকি কারাগারেও আঘাত হানে। এতে ব্যাপক অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতি ঘটেছে—লাখো মানুষ ঘর ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। হতাহতের তালিকায় রয়েছেন সহায়তা কর্মী, প্রতিবন্ধী শিশু এবং পরমাণু বিজ্ঞানীরাও। ইরানের বিচার বিভাগ জানিয়েছে, রাজধানী তেহরানের কুখ্যাত এভিন কারাগারেও ইসরায়েলি হামলা হয়েছে, যেখানে বহু রাজনৈতিক বন্দি আটক রয়েছেন।

ইরান থেকে ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইসরায়েলেও প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। এখন পর্যন্ত অন্তত ২৪ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত এবং প্রায় ৬০০ জন আহত হয়েছেন। দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর বেইর শেভাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা ঘটে যুদ্ধবিরতির ঠিক আগে, যেখানে কমপক্ষে তিনজনের মৃত্যু এবং আটজন আহত হওয়ার খবর নিশ্চিত করেছে জরুরি পরিষেবা সংস্থাগুলি। ধ্বংসপ্রাপ্ত ভবনের নিচে এখনও অনেকেই চাপা পড়ে রয়েছেন বলে জানিয়েছে উদ্ধারকারী দল।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জানান, উভয় দেশই একযোগে শান্তি আলোচনার জন্য তাদের প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। তাঁর কূটনৈতিক ও নিরাপত্তা দল রাতভর কাজ করে যুদ্ধবিরতির একটি সমঝোতা তৈরি করে। স্থানীয় সময় অনুযায়ী যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে সকাল ৪টার দিকে। এর কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত ইসরায়েলি বাহিনী ইরানের শহরগুলিতে ব্যাপক বোমাবর্ষণ চালাচ্ছিল।

ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এখনো পর্যন্ত যুদ্ধবিরতি বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দেননি। তবে সূত্র জানিয়েছে, তিনি জরুরি নিরাপত্তা মন্ত্রিসভার বৈঠক আহ্বান করেন এবং মন্ত্রীদের যুদ্ধবিরতি বিষয়ে গণমাধ্যমে মন্তব্য না করার নির্দেশ দেন।

এই ১২ দিনের সংঘর্ষে উভয় দেশের জরুরি সেবাব্যবস্থা চরমভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। হাসপাতালগুলো আহতদের সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে, এবং উদ্ধারকারী দলগুলো ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে বেঁচে থাকা মানুষদের খুঁজে বের করার কাজ করছে। জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক মানবিক সংস্থা অবিলম্বে উত্তেজনা প্রশমন, বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষা এবং নিরবিচারে ত্রাণ সরবরাহের আহ্বান জানিয়েছে।

যুদ্ধবিরতির এই সিদ্ধান্ত সাময়িক স্বস্তি আনলেও, এর স্থায়িত্ব নিয়ে এখনও সন্দেহ রয়েছে। ইরান বলেছে, ইসরায়েল যদি হামলা বন্ধ রাখে, তবে তারাও প্রতিক্রিয়া দেখাবে না। তবে ইসরায়েলি কর্মকর্তারা এখন পর্যন্ত চুক্তির শর্তাবলি সম্পর্কে প্রকাশ্যে কিছু বলেননি।

এই সংঘাত আবারও প্রমাণ করেছে, মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা কত দ্রুত একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের রূপ নিতে পারে, যার সবচেয়ে বড় শিকার হয় সাধারণ নাগরিকেরা।