নারীদের প্রকৃত সম্মান দেওয়ার লক্ষ্যে কাজ করছে বর্তমান সরকার: মুখ্যমন্ত্রী

আগরতলা, ১৩ মার্চ: নারীদের প্রকৃত সম্মান দেওয়ার লক্ষ্যে কাজ করছে বর্তমান কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার। নারীদের স্থান উঁচুতে হলে সমাজ অনেক বেশি সমৃদ্ধ ও উন্নত হবে। মহিলাদের স্বশক্তিকরণের উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে রাজ্য সরকার। নারীদের সুরক্ষা ও আর্থিক অবস্থার উন্নয়নে অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করছে সরকার। প্রধানমন্ত্রীর মার্গদর্শনে নারীদের কল্যাণে নিরন্তর কাজ করে চলছে রাজ্য সরকার।বৃহস্পতিবার আগরতলার রবীন্দ্র শতবার্ষিকী ভবনে আয়োজিত আন্তর্জাতিক নারী দিবসের রাজ্যভিত্তিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে একথা বলেন মুখ্যমন্ত্রী প্রফেসর ডাঃ মানিক সাহা।

সমাজ কল্যাণ ও সমাজ শিক্ষা দপ্তরের উদ্যোগে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ সাহা বলেন, ৮ই মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। আমরা সেদিন সরকারিভাবে নারী দিবস উদযাপন করেছি। বিভিন্ন সামাজিক সংস্থা ও সংগঠনের পক্ষ থেকেও সম্মানের সঙ্গে দিনটি পালন করা হয়েছে। চলতি মাসের ১ তারিখ থেকে আজকের দিন পর্যন্ত প্রায় ১৩দিন ধরে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করা হচ্ছে। ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকা থেকে নারীদের অধিকার নিয়ে আন্দোলনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপন শুরু হয়। এবার জাতিসংঘের পক্ষ থেকে থিম রাখা হয়েছে – সমস্ত নারী ও কন্যা শিশুর জন্য অধিকার, সমতা ও ক্ষমতায়ন। আমাদের রাজ্যে এবারের থিম – ভবিষ্যত প্রজন্মে নারীদের ক্ষমতায়নের জন্য বাল্যবিবাহ রোধ করা। ত্রিপুরায়ও এই বিষয়টি বেশ উদ্বেগের। উত্তর ত্রিপুরা, দক্ষিণ ত্রিপুরা ও সিপাহীজলা জেলায় এধরণের প্রবনতা রয়েছে।

মুখ্যমন্ত্রী বলেন, আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে আমি মা বোনেদের ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করছি। এই সরকার মহিলাদের ক্ষমতায়নে বিশেষ অগ্রাধিকার দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নারীদের আর্থ সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন সহ সব বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে নারীদের কল্যাণে বিভিন্ন স্কিম চালু করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। ত্রিপুরা সরকারও নারীদের শক্তিশালী করতে বিভিন্ন স্কিম চালু করেছে। সমাজের মধ্যে নারীরা হচ্ছেন একটা অন্যতম চালিকাশক্তি। আগে তারা ঘরের মধ্যে বন্দী হয়ে থাকতেন। এখন ঘরের বাইরে বেরিয়ে সমাজেরও চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছেন। আগের সরকার দিল্লিতে থাকুক বা ত্রিপুরায় থাকুক, নারীদের মূল্যায়ন করে নি তারা। প্রাচীনকালে মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় মহিলাদের অবস্থান অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ ছিল। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠার কারণে মাতৃশক্তি পেছনে পড়ে যায়। কিন্তু বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকার নারীদের প্রকৃত সম্মান দেওয়ার চেষ্টা করছে। যে সমাজে নারীদের স্থান উঁচুতে হবে সেই সমাজ অনেক বেশি সমৃদ্ধ ও উন্নত হবে। রাজ্য সরকার মহিলাদের স্বশক্তিকরণের উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। নারীদের সুরক্ষা ও আর্থিক অবস্থার উন্নয়নে অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করছে সরকার। প্রধানমন্ত্রীর মার্গদর্শনে নারীদের কল্যাণে কাজ করে চলছে রাজ্য সরকার।

বক্তব্যে মুখ্যমন্ত্রী আরো বলেন, মহিলারা স্বনির্ভর হলেই তাদের উপর নির্যাতনের মাত্রা অনেকটা হ্রাস পাবে। সমাজে তারা মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার সাহস পায়। কারণ জনসংখ্যার অর্ধেকই মহিলা। কাজেই মহিলাদের পেছনে ঠেলে দিলে এই সমাজ এগিয়ে যাবে না। তাদের ছাড়া দেশ ও রাজ্যের উন্নয়ন সম্ভব নয়। নারীদের সার্বিক উন্নয়নে সবদিক দিয়ে চেষ্টা করছে রাজ্যের বর্তমান সরকার। কিছুদিন আগে গত ৯ মার্চ কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জে পি নাড্ডা আগরতলায় রাজ্য সরকারের দুটি গুরুত্বপূর্ণ স্কিমের ঘোষণা করেছেন। এরমধ্যে একটি মুখ্যমন্ত্রী বালিকা সমৃদ্ধি যোজনা এবং অপরটি মুখ্যমন্ত্রী কন্যা আত্মনির্ভর যোজনা। সমাজ কল্যাণ ও সমাজ শিক্ষা দপ্তর থেকে ৫০ জন মহিলাকে খাদ্য সামগ্রী তৈরি করার প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। সরকারি স্টল বণ্টনে মহিলাদের জন্য ৫০ শতাংশ সংরক্ষণের ব্যবস্থা হয়েছে। ২৪x৭ একটি টোল ফ্রি নম্বর চালু করা হয়েছে। ১৮১ নম্বরে মহিলাদের যেকোন সমস্যা নিয়ে ফোন করলে সমস্যা সমাধানের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হয়। গত এক বছরে ১৪,৫০১টি কল করা হয় এই টোল ফ্রি নম্বরে এবং অনেক মহিলা সহায়তা পেয়েছেন। নারীদের ক্ষমতায়ন সংক্রান্ত প্রকল্প ও কর্মসূচির তথ্য পাওয়ার জন্য হাব অফ এমপাওয়ারমেন্ট অফ উইমেন অফিস চালু করা হয়েছে। প্রতিটি জেলাতেও এই অফিস চালু করা হয়েছে। বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও প্রকল্প রাজ্যে বাস্তবায়িত হচ্ছে। ভ্রূণ হত্যা রোধে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশিকা অনুসারে রাজ্যেও আইন প্রণয়ন করা হয়েছে।

মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ত্রিপুরা একমাত্র রাজ্য যেখানে মহিলাদের সুরক্ষায় আটটি জেলাতে মহিলা পরিচালিত থানা চালু করা হয়েছে। পশ্চিম জেলায় দুটি সহ বাকি সব জেলায় একটি করে মহিলা থানা খোলা হয়েছে। কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের যৌন হয়রানি প্রতিরোধে সমস্ত সরকারি ও বেসরকারি অফিসে ইন্টারনাল কমপ্লেইন কমিটি গঠন করা হয়েছে। ৮টি জেলায় জেলাশাসকের অফিসে লোক্যাল কমিটিও গঠন করা হয়েছে। কারণ মা বোনেদের সুরক্ষা দেওয়া না গেলে কাজের কাজ হবে না। জিবি হাসপাতালে এমসিএস ক্লিনিক গড়ে তোলার জন্য ডোনার মন্ত্রক থেকে ১০০ কোটি টাকার অধিক বরাদ্দ পাওয়া গেছে। সেখানে ১০০ শয্যা বিশিষ্ট মা ও শিশু ইউনিট গড়ে তোলা হচ্ছে। দুঃস্থ ও বয়স্ক মহিলাদের জন্য আরো তিনটি বৃদ্ধাশ্রম নির্মাণের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী মাত্রু বন্দনা যোজনার অধীনে গর্ভবতী ও প্রসূতী মায়েদের স্বাস্থ্য ও পুষ্টির মান উন্নয়নের লক্ষ্যে আর্থিকভাবে সহায়তা করা হয়। মুখ্যমন্ত্রী মাতৃ পুষ্টি উপহার প্রকল্পেও প্রতি তিন মাসে একবার করে পৌষ্টিক আহার যেমন আয়রন সমৃদ্ধ খাবারের জন্য গর্ভবতী মহিলাদের ব্যাংক একাউন্টে চারবারে মোট ৫০০ টাকা করে মোট ২,০০০ টাকা দেওয়া হয়। গত ২৮ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ পর্যন্ত ২১হাজার ৫৫১জন গর্ভবতী মহিলাকে এই প্রকল্পে অর্থ প্রদান করা হয়েছে। রাজ্যের অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী ও হেল্পারদের মাসিক সাম্মানিক পরিমাণ বাড়িয়ে ন্যূনতম ৮,০০০ ও ৫,০০০ করা হয়েছে। আর্থিকভাবে দুর্বল পরিবারের ১৮ বছরের কম বয়সী প্রায় ২ হাজারের অধিক ছেলেমেয়েকে চলতি অর্থ বছরে স্পনসরশিপ অনুদান হিসেবে প্রতি মাসে প্রায় ৪,০০০ টাকা করে এখন পর্যন্ত প্রায় ৩ কোটি ২৯ লক্ষ টাকা প্রদান করা হয়। এছাড়া মহিলা ও কন্যা সন্তানদের জন্য রাজ্য সরকার বিভিন্ন সামাজিক সুরক্ষা ভাতা প্রদান করছে।

তথ্য দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী জানান, এপিএলের অধীনে স্বামী পরিত্যক্তা ভাতার সুবিধা পাচ্ছেন ৩,৮৮৫ জন। অবিবাহিত মহিলা ভাতা পাচ্ছেন প্রায় ১,৯৬৪ জন। রাজ্য বিধবা ভাতা দেওয়া হচ্ছে ৯২ জনকে। গৃহ সহায়িকা ভাতা পাচ্ছেন ২৩,৬৩২ জন। বিধবা ও পরিত্যক্ত মহিলা ভাতা পাচ্ছেন ৫৮,৫৫৮ জন। ত্রিপুরা শিশু কন্যা উৎসাহ ভাতা পাচ্ছে প্রায় ৬৪,৬০৩ জন, মুখ্যমন্ত্রী সামাজিক সহায়তা প্রকল্প দুস্থ মহিলা ভাতা পাচ্ছেন ৭ হাজার ৫০০ এর অধিক জন। জাতীয় স্তরে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য মেয়েদের ৩% সুদের হারে ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমাদের সরকার মহিলাদের ক্ষমতায়নে সবসময় সজাগ রয়েছে। নারী সংক্রান্ত অপরাধের ক্ষেত্রে দেশের ২৮টি রাজ্যের মধ্যে নিচের দিক থেকে অষ্টম স্থানে রয়েছে ত্রিপুরা। নারীরা শক্তিশালী হলে এই রাজ্যও শক্তিশালী হবে এবং এক ত্রিপুরা শ্রেষ্ঠ ত্রিপুরা ও এক ভারত শ্রেষ্ঠ ভারত গড়ে তোলার স্বপ্ন পূরণ হবে।

অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সমাজ কল্যাণ ও সমাজ শিক্ষা মন্ত্রী টিংকু রায়, ত্রিপুরা মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন ঝর্ণা দেববর্মা, ত্রিপুরা শিশু অধিকার সুরক্ষা কমিশনের চেয়ারপার্সন জয়ন্তী দেববর্মা, সমাজ কল্যাণ ও সমাজ শিক্ষা দপ্তরের সচিব তাপস রায় ও অধিকর্তা তপন কুমার দাস, পশ্চিম ত্রিপুরা জেলাশাসক ড. বিশাল কুমার, পুলিশ সুপার কিরণ কুমার কে সহ অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *