কলকাতা, ৩১ মে (হি. স.) : রাজ্যের তরফে ঘোষণা করা হয়েছিল এবার পশ্চিমবঙ্গে কলেজে ভর্তির জন্য স্বচ্ছ ‘পোর্টাল’-ব্যবস্থা করা হবে। এর ‘ম্যাট্রিক্স’ (গঠনপ্রক্রিয়া) নিয়ে ক’দিন আগেই রাজ্য সরকার বৈঠক করেছিল অধ্যক্ষদের সঙ্গে। শেষ পর্যন্ত পোর্টাল এবার চালু হচ্ছে না। অর্থাৎ, পড়ুয়াদের কলেজে ভর্তিতে স্বচ্ছতার যে নিশ্চয়তা দিচ্ছিল সরকার, তা চলে গেল বিশ বাঁও জলে। একটি নামী কলেজের অধ্যক্ষ এই প্রতিবেদককে জানান, “ছাত্রনেতাদের চাপের কাছে নতিস্বীকার করতে হল সরকারকে। কৌশলে করে খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়া হল। ”
পরীক্ষা শেষ হওয়ার ৫৭ দিনের মাথায় গত ২৪ মে প্রকাশিত হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের উচ্চ মাধ্যমিকের ফল। এর আগে ১৪ মে প্রকাশিত হয়েছে সিআইএসসিই বোর্ডের আইএসসি, আইসিএসই পরীক্ষার ফল। পাশের হার হল ৯৬.৯ শতাংশ। সিবিএসইর দ্বাদশ শ্রেণিতে পাশের হার হল ৮৭.৩ শতাংশ।
পশ্চিমবঙ্গে এই তিন পরীক্ষায় সফল বিপুল পরীক্ষার্থী ও তাঁদের অভিভাবকদের একটা বড় অংশ রীতিমত অনিশ্চয়তায়। কোথায়, কীভাবে, কবে ভর্তি হবে এই উত্তীর্ণরা? রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থার বিভিন্ন স্তরে দুর্নীতি নিয়ে যে আবহ তৈরি হয়েছে, তাতে অনেকেই শঙ্কিত। পড়াশোনার জন্য অনেকে তাঁদের সন্তানদের ভিন রাজ্যে পাঠিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু সবাই সে পথে হাঁটতে রাজি নন বা পারছেন না। তাহলে কী করবেন তাঁরা?
কলেজে ভর্তির জন্য আবেদনকারীদের কাছ থেকে বেআইনি টাকা নেওয়া হচ্ছিল পশ্চিমবঙ্গে। এ ব্যাপারে নিরন্তর অভিযোগ উঠছিল রাজ্যের শাসক দলের ছাত্র সংগঠনের বিরুদ্ধে। এই জটিলতায় দক্ষিণ কলকাতার একটি কলেজের এক ছাত্রী আত্মহত্যা করার পর তুমুল হইচই হয়। বিষয়টিতে হস্তক্ষেপ করেন খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বদল হন খোদ সংগঠন সভাপতি। সামগ্রিক বিষয়টা দিনের পর দিন প্রথম পৃষ্ঠার খবর হয়ে উঠেছিল।
কয়েক বছর ধরে কলেজে ভর্তিতে পোর্টাল চালু হয়েছে। কিছু মহলের আশা ছিল এতে স্বচ্ছতা আসবে। দুর্নীতি রোখা যাবে। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে অনলাইন ব্যবস্থা সেন্ট্রালাইজড হবে না
ডিসেন্ট্রালাইজড? দক্ষিণ কলকাতার একটি সুপরিচিত কলেজের অধ্যক্ষ ডঃ পঙ্কজ রায় এ কথা জানিয়ে বুধবার এই প্রতিবেদককে বলেন, “এ ব্যাপারে ছাত্রনেতাদের আয় যাতে বন্ধ না হয়ে যায়, সে কারণে ডিসেন্ট্রালাইজড ব্যবস্থা কায়েম করা হয়। যদিও এ বার ঠিক হয়েছে পোর্টাল হবে সেন্ট্রালাইজড। পোর্টালের কিছু রদবদলও হচ্ছে। গত ২৮ মে শিক্ষা আধিকারিকরা (ডিরেক্টর অফ পাবলিক ইন্সট্রাকশন-এর তরফে) আমাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছেন।”
ছাত্রনেতাদের আওতার বাইরে কীভাবে নিয়ন্ত্রিত হতে পারে এই পোর্টাল? পঙ্কজবাবু জানান, “বৈঠকে আলোচনা হয়েছে, উচ্চশিক্ষা পর্ষদ এটা নিয়ন্ত্রণ করবে। প্রতিটি আবেদনকারী পাঁচটি কলেজের নাম সুপারিশ করতে পারবে। পোর্টাল চালু হওয়ার মাসখানেক বাদে ওঁরা কলেজগুলোকে সংশ্লিষ্ট তথ্য পেশ করবেন। আর কতটা স্বচ্ছতা বজায় থাকে, সেটা সম্পর্কে এখনই নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না।”
উচ্চ শিক্ষা দফতরের তরফে জানানো হয়েছিল, রাজ্যের কোন কলেজে ক’টি আসন রয়েছে তা এবার দেখা যাবে একটি প্ল্যাটফর্মেই। প্রতিটি কলেজের ওয়েবসাইটে গিয়ে আর তথ্য খুঁজতে হবে না। শহরের এমনকী প্রত্যন্ত এলাকার মানুষও ঘরে বসেই একসঙ্গে একটি প্ল্যাটফর্মেই সমস্ত কলেজের প্রতি সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য জানতে পারবেন। ন্যূনতম নির্ণায়ক নম্বর দেখে, একটি কলেজের সঙ্গে অপর কলেজের তু্ল্যমূল্য বিচার করে তবেই ফর্ম ফিল আপ করতে পারবে পড়ুয়ারা। এই পোর্টালের মাধ্যমে টাকাও জমা করা হবে।
২০২২ সালেই কেন্দ্রীয়ভাবে একই পোর্টালের মাধ্যমে রাজ্যের সমস্ত সরকারি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করা সম্ভব হয়নি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি এই কেন্দ্রীয় পোর্টালের মাধ্যমে ভর্তি প্রক্রিয়া চলবে উত্তরবঙ্গ, বিদ্যাসাগর, বর্ধমান এবং কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীন কলেজগুলিতেও। তবে এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। তাদের নিজস্ব ওয়েবসাইটের মাধ্যমেই চলবে অ্যাডমিশন। পাশাপাশি স্বশাসিত কলেজ, সংখ্যালঘু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ট্রেনিং কলেজ, আইন কলেজ, ভোকেশনাল কোর্সের (ফাইন আর্টস, নৃত্য, সংগীত) কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়, ইঞ্জিনিয়ারিং, ফার্মেসি, নার্সিং, মেডিক্যাল কোর্সের কলেজ এবং সেলফ ফিনান্সিং বা বেসরকারি কলেজে কেন্দ্রীয় পোর্টালের মাধ্যমে ভর্তি চলবে না।
এর পর দুপুরে রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু জানান, অভিন্ন পোর্টালের মাধ্যমে কলেজে ভর্তির প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে না এ বারেও। এই প্রসঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী জানিয়েছেন, পড়ুয়াদের মধ্যে বিভ্রান্তি এড়াতেই কলেজগুলিকে আলাদা আলাদা ভাবে ভর্তিপ্রক্রিয়া শুরু করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এই মুহূর্তে আমরা কেন্দ্রীয় ভাবে অনলাইনে ভর্তি না করে কলেজগুলিকে আলাদা আলাদা ভর্তির কথা বলেছি, যাতে বিভ্রান্তি না ছড়ায়। কিন্তু একই সঙ্গে আমাদের যে কেন্দ্রীয় অনলাইন ভর্তি ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে, সেখানে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন এবং পরিমার্জনের কাজ আমরা জরুরি ভিত্তিতে চালাব, যাতে এই ব্যবস্থাটিকেও আমরা এই বছরই চালু করতে পারি।”
এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ২০২০-র নয়া শিক্ষানীতি (এনইপি) প্রসঙ্গ। এতে অনেক কিছুর সঙ্গে কলেজে পঠনপাঠনের কাঠামোর বদল হচ্ছে। এর রূপায়ণে বেশ কিছুদিন ধরে পশ্চিমবঙ্গ কড়া বিরোধী ভূমিকা নিয়েছিল। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রবীন শিক্ষাবিদ এই প্রতিবেদককে বলেন, “পশ্চিমবঙ্গে বাম আমলের শেষদিকে স্নাতকস্তরে অনার্স-পাসের কাঠামো বদল নিয়ে আপত্তি জানিয়েছিল রাজ্য। ইউজিসি-র কড়া নির্দেশে সুর নরম করতে হয় রাজ্যকে। এবারেও এনইপি নিয়ে ঢোঁক গিলতে হচ্ছে রাজ্যকে। শীঘ্রই এ ব্যাপারে তাঁদের সম্মতির কথা সরকার জানাবেন। লিংডো কমিশনের সুপারিশে এই পোর্টাল চালু হতে চলেছে। আগেই এই নিয়ে বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে রাজ্যের উচ্চ শিক্ষা দফতর।”
বুধবার শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু অবশ্য জানান, “পড়ুয়াদের সুবিধার কথা ভেবেই স্নাতক স্তরে চার বছরের পাঠক্রম চালু করছে রাজ্য।রাজ্যের প্রায় ৭ লক্ষ ছাত্রছাত্রী, যাঁরা এই বছর স্নাতক স্তরে ভর্তি হতে চলেছে, তাদের সুবিধের কথা ভেবে আমরা ৪ বছরের পঠনপাঠন চালু করতে চলেছি। এতে তাদের সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে সুবিধা হবে এবং একইসঙ্গে রাজ্যের বাইরে পড়তে চলে যাওয়ার প্রবণতা কমবে।”
দেশের অন্য গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যগুলো কিন্তু এ ব্যাপারে অনেকটা গুছিয়ে নিয়েছে। ডঃ পঙ্কজ রায় জানান, “গত বছরই দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় পোর্টালের মাধ্যমে ভর্তি এবং এনইপি রূপায়িত করেছে। কর্ণাটক, মধ্যপ্রদেশ— ওরাও এই পথ ধরেছে। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে সি ইউ ই টি (সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটিজ এন্ট্রান্স টেস্ট) হবে আগামী ৫ থেকে ১২ জুন। সুখের কথা, দেরিতে হলেও এ রাজ্যেও এটা এবার হবে। তবে নয়া ব্যবস্থা তো। প্রথম বছর কতটা, কী সমস্যা হয় বোঝা যাচ্ছে না।”
গত উচ্চ মাধ্যমিকে পরীক্ষার্থী ছিল আগের বারের তুলনায় এক লক্ষ ৭ হাজার বেশি। ৮ লক্ষ ৬০ হাজারেরও বেশি পড়ুয়া গত উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছেন। পাশের হার ৮৯.২৫ শতাংশ। এমনিতেই অতিমারীর সমস্যা ওঁদের বেশ কিছুকাল বিব্রত করেছিল। সেটা কাটিয়ে এবার কলেজে ভর্তির জন্য অপেক্ষা— “পথের ক্লান্তি ভুলে স্নেহভরা কোলে তব বলো কবে মাগো, কত দূর আর কত দূর বল মা।”

