আপডেট : মরণোত্তর পদ্মশ্রী পেলেন ত্রিপুরার প্রাক্তন মন্ত্রী নরেন্দ্র চন্দ্র দেববর্মা, সমাজ সেবায় পদ্মশ্রী পেলেন বিক্রম বাহাদুর জমাতিয়া

আগরতলা, ২২ মার্চ (হি. স.) : মরণোত্তর পদ্মশ্রী পেলেন ত্রিপুরার প্রাক্তন মন্ত্রী তথা বিজেপি জোট শরিক আইপিএফটি-র প্রাক্তন সভাপতি নরেন্দ্র চন্দ্র দেববর্মা। আজ তাঁর ছেলে সুব্রত দেববর্মা রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর কাছ থেকে পদ্মশ্রী গ্রহণ করেছেন। এছাড়াও  ত্রিপুরায় বিশিষ্ট সমাজসেবী বিক্রম বাহাদুর জমাতিয়া পদ্মশ্রী গ্রহণ করেছেন।  

প্রসঙ্গত, নরেন্দ্র চন্দ্র দেববর্মা (মরণোত্তর) পাবলিক অ্যাফেয়ার্স এর ক্ষেত্রে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। ইন্ডিজেনাস পিপলস ফ্রন্ট অব ত্রিপুরার সভাপতি নরেন্দ্র চন্দ্র দেববর্মা ছিলেন একজন সুপরিচিত রাজনীতিবিদ। ১৯৪২ সালের ২৮ আগস্ট ত্রিপুরার খোয়াই জেলায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি৷ ১৯৬২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন। তিনি খাদ্য ও জনসংভরণ বিভাগে এবং অল ইন্ডিয়া রেডিওতে সরকারি চাকরি করেছিলেন। ২০০২ সালের ৩১ আগস্ট তিনি অল ইন্ডিয়া রেডিও, আগরতলার স্টেশন ডিরেক্টর হিসাবে অবসর গ্রহণ করেন। সরকারি চাকরি জীবনে তিনি ত্রিপুরা ট্রাইবেল এমপ্লয়িজ অ্যাসোসিয়েশনের সাথে যুক্ত ছিলেন, যা “ত্রিপুরা উপজাতি কর্মচারী সমিতি” নামেও পরিচিত, যা অল ইন্ডিয়া ফেডারেশন অফ এসসি অ্যান্ড এসটি, ব্যাকওয়ার্ডস অ্যান্ড মাইনরিটিস এমপ্লয়িজ ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন অফ নয়াদিল্লির একটি অনুমোদিত সংগঠন। তিনি “ত্রিপুরা উপজাতি কর্মচারী সমিতি”র সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন এবং আদিবাসী কর্মীদের কল্যাণে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন।

শ্রী দেববর্মা একজন লেখকও ছিলেন এবং সংবিধানের ২৪৪ (এ) অনুচ্ছেদ অনুসারে অবৈধ জমি অধিগ্রহণের বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্বেগ এবং বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসনের অভিমুখে ত্রিপুরা সরকারকে তাঁর দিকনির্দেশনা এবং কেন এটি প্রয়োজনীয় তা নিয়ে বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন৷ তিনি তাখুমসাবোদোল (বলাকা) – ককবরক ভাষায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বলাকা কবিতার অনুবাদ, কোক্লাম (কথ্য ককবরকের একটি হ্যান্ডবুক) করেছিলেন যা ত্রিপুরা সরকারের তপশিলী জাতি ও উপজাতি কল্যাণ দপ্তরের অধীনস্থ গবেষণা অধিদপ্তর কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছিল। ২০০০ সালের ২২ শে ডিসেম্বর থেকে ২৪ শে ডিসেম্বর পর্যন্ত অনুষ্ঠিত ত্রিপুরার ককবরক ভাষার শতবর্ষ উদযাপনের জন্য লেখার অবদান হিসাবে মানব সভ্যতায় লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতির ভূমিকা নিয়ে একটি লেখা লিখেছিলেন। তিনি ত্রিপুরার ত্রিপুরী, জমাতিয়া, মগ এবং রিয়াংদের প্রথাগত আইন সম্পর্কিত বই প্রকাশের ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছিলেন এবং গবেষণা কর্মকর্তা হিসাবে তাদের জমি রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থার বিশেষ উল্লেখ করেছিলেন।

অবসর গ্রহণের পরে তিনি ত্রিপুরা উপজাতি এলাকা স্বশাসিত জেলা পরিষদের (টিটিএএডিসি) অতিরিক্ত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ২০০৮ সালে তিনি ইন্ডিজেনাস ন্যাশনালিস্ট পার্টি অব ত্রিপুরা (আইএনপিটি) দলের হয়ে ১৮- চড়িলাম (এসটি) বিধানসভা কেন্দ্র থেকে ত্রিপুরা বিধানসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। তবে ওই নির্বাচনে তিনি পরাজিত হয়েছিলেন। ২০০৯ সালে ত্রিপুরার আদিবাসীদের সুশাসন ও উন্নয়নের জন্য একটি পৃথক রাজ্যের দাবিতে টিটিএএডিসি অঞ্চলকে কেন্দ্র করে “তিপরাল্যান্ড” এর নতুন দৃষ্টিভঙ্গি এবং মতাদর্শকে সামনে রেখে ইনডিজেনাস পিপলস ফ্রন্ট অফ ত্রিপুরা (আইপিএফটি) নামে একটি নতুন জনজাতীয় দল গঠন করেন তিনি। ২০১৮ সালে তাঁর নেতৃত্বে ত্রিপুরায় বিজেপি ও আইপিএফটি জোট সরকার গঠিত হয়েছিল। নতুন সরকারে তিনি ত্রিপুরার রাজস্ব মন্ত্রী হিসাবে শপথ গ্রহণ করেছিলেন এবং পরে বনমন্ত্রীর দায়িত্বভারও তাঁকে দেওয়া হয়েছিল। ২০১৮ সালের ৯ মার্চ থেকে ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি পর্যন্ত তিনি মন্ত্রী ছিলেন। তিনি জনসাধারণের কাছে সহজেই উপলদ্ধ ছিলেন এবং সমাজের প্রতিটি অংশ এবং ত্রিপুরার জনগণের উন্নতির জন্য কাজ করেছিলেন। গত ১ জানুয়ারি তিনি প্রয়াত হয়েছেন।

এদিকে, ত্রিপুরার বিক্রম বাহাদুর জমাতিয়াকে সামাজিক অবদানের ক্ষেত্রে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত করা হয়েছে। তিনি ত্রিপুরা সরকারের অবসরপ্রাপ্ত অবর সচিব, জমাতিয়া হদার প্রাক্তন অক্রা(জমাতিয়া সম্প্রদায়ের সম্প্রদায় প্রধান) এবং জনজাতি ফেইথ অ্যান্ড কালচার প্রোটেকশন ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি৷ শ্রী জমাতিয়া উত্তর-পূর্ব ভারতের জনজাতি সম্প্রদায়ের কাছে তাঁর কাজের জন্য পরিচিত।

১৯৩৯ সালের ১ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন বিক্রম বাহাদূর জমাতিয়া৷ জনজাতি কলোনির সুপারভাইজার হিসাবে সরকারি চাকরিতে যোগদান করেন তিনি। পরে ১৯৬৭ সালে সিভিল সেক্রেটারিয়েট সার্ভিসে যোগদান করেন। সেখানে তিনি টিইউকেএস (ত্রিপুরা উপজাতি কর্মচারী সমিতি) নামে পরিচিত আদিবাসী কর্মচারী সংগঠন গঠন করেন। তিনি ১৯৯৭ সালে অবর সচিব হিসেবে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ঠিক এক মাস পরে তিনি জমাতিয়া হদা (সম্প্রদায়)র অক্রা (কমিউনিটি প্রধান) হিসাবে নির্বাচিত হন।

শ্রী জমাতিয়া দেখতে পান যে এই অঞ্চলে চরমপন্থীরা শান্তিপূর্ণ সম্প্রদায় ব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছে। তিনি সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় হাজার হাজার কমিউনিটি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করেছেন। সরকার তাঁকে ব্যক্তিগত নিরাপত্তা প্রদান করেছে। অগত্যা দীর্ঘমেয়াদে চরমপন্থীরা ত্রিপুরা ছেড়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে এবং সরকারের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছে। কমিউনিটি চিফ হিসাবে তাঁর পাঁচ বছরের মেয়াদ একটি দুর্দান্ত অর্জন ছিল এবং সংশ্লিষ্ট সমস্ত মহল দ্বারা প্রশংসিত হয়েছিল।

এই কর্মকান্ডের ধারাবাহিকতায় উত্তর-পূর্বের সাত বোনের রাজ্যের সকল জনজাতি নেতৃবৃন্দ জনজাতিদের বিশ্বাস ও সংস্কৃতি পুনরুদ্ধারের জন্য একটি ঐক্যবদ্ধ সংগঠন গঠনের আহ্বান জানান তিনি। সে অনুযায়ী ২০০২ সালে ‘জনজাতি ফেইথ অ্যান্ড কালচারেল ফোরাম’ নামে একটি সংগঠন গঠন করা হয়। তিনি ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হন। ফোরামের কার্যক্রম উত্তর-পূর্ব রাজ্য নাগাল্যান্ড, অরুণাচল প্রদেশ, মণিপুর, মেঘালয়, মিজোরাম জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে এবং জনজাতি বিশ্বাস ও সংস্কৃতি পুনরুদ্ধারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে “জাগতা পূর্বাচল” স্লোগান তুলে। ২০০৬ সালে গুয়াহাটিতে নেহেরু স্টেডিয়ামে ২৪ থেকে ২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত ঐতিহাসিক আন্দোলনের সমাবেশে একটি ঘোষণা করা হয়েছিল যে জেলা পরিষদের সমস্ত ষষ্ঠ তফসিলভুক্ত এলাকায় জনজাতিদের প্রথাগত আইন প্রণয়ন করা হবে। সে অনুযায়ী জনজাতি ফোরামের কার্যক্রম চলছে।

শ্রী জমাতিয়া বিভিন্ন সামাজিক পুরস্কারেও সম্মানিত হয়েছেন৷ পুর্বাঞ্চল কল্যাণ আশ্রম কলকাতা ও হাওড়া মহানগর কর্তৃক প্রদত্ত জনজাতি ক্রান্তিকারি সম্মান (২০০১), আইসিসিএস, নাগপুর (২০০৩) কর্তৃক ওয়ার্ল্ড কাউন্সিল অব অ্যানসিয়েন্ট ট্র্যাডিশন অ্যান্ড কালচার পুরস্কার, মর্যাদাপূর্ণ ভিকেআইসি সম্মান (২০০৪), এ.বি.ভি.কে.এ গোল্ডেন জুবিলি অনুষ্ঠানে (২০০৪) এ এন আর ওয়ার্কস সম্মান, ১১তম বাউরাও দেওরাশ সম্মান (২০০৬), গুরুজী পুরস্কার (২০০৬), উত্তর পূর্ব ভারত জ্ঞান জ্ঞাপন গবেষণা কেন্দ্র (২০১৩), মাই হোম ইন্ডিয়া ওয়ান ইন্ডিয়া অ্যাওয়ার্ড (২০১৫), ন্যাশনাল ইন্টিগ্রেশন অ্যাওয়ার্ড (২০১৮) এবং ত্রিপুরা সরকার কর্তৃক পণ্ডিত দিনদয়াল উপাধ্যায় (২০১৮) পুরস্কার ইত্যাদি পেয়েছেন ৷

এদিন সামাজিক মাধ্যমে বার্তায় ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী বলেন, আজ রাষ্ট্রপতি ভবনে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মূর্মু রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী প্রয়াত নরেন্দ্র চন্দ্র দেববর্মাকে পদ্মশ্রী(মরণোত্তর) সম্মানে ভুষিত করেছেন। এই গৌরবময় মূহুর্তে আমি শ্রদ্ধাচিত্তে তাঁকে স্মরন করি এবং ত্রিপুরার জাতি-জনজাতির সার্বিক কল্যাণে তাঁর অবদানের প্রতি এই সম্মাননা প্রদানের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে অনেক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রতিমা ভৌমিক এই সন্মানের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে কৃতজ্ঞতা এবং ধন্যবাদ জানিয়েছেন।