BRAKING NEWS

ত্রিপুরায় উপজাতি দলগুলি বুদ্বুদের মত হারিয়ে যায়

৷৷ পরিতোষ বিশ্বাস৷৷

রাজ্য বিধানসভা নির্বাচন দরজায় কড়া নাড়ছে৷ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল প্রচার শুরু করেছে৷ এবারের নির্বাচন অন্যান্য অনেক নির্বাচন থেকে একটু ব্যতিক্রমী৷ ব্যতিক্রমী এই কারণে যে, এবার পাহাড়ে আছে তিপ্রা মথা৷ এই তিপ্রা মথাকে নিয়ে রাজনৈতিক মহলে নানাভাবে হিসাব নিকাশ চলছে৷ তিপ্রা মথা এমন একটা জায়গায় পৌঁছেছে যে, পাহাড় যেন তাঁরাই দখল করবে৷ যদি এটাকে ধরে নেয়া যায় তাহলে তিপ্রা মথার সাথে অবিজেপি দলগুলির সমঝোতা নতুন সমীকরণের পথ হতে পারে৷ গ্রেটার তিপ্রাল্যান্ডের দাবী বিজেপি এখনও সমর্থন করেনি৷ অথচ সিপিএম এবং কংগ্রেস প্রকারান্তরে এই দাবীকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে৷ বলছে, গ্রেটার তিপ্রাল্যান্ডের দাবী অসাংবিধানিক নয়৷ এই অবস্থায় প্রদ্যোত কিশোরের তিপ্রা মথা কি ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে সেটা অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ণ৷ বিজেপি একটি সুসংগঠিত দল৷ সহজে হাল ছেড়ে দেওয়ার মত নয়৷ আঠার এর নির্বাচনে বিপুল জয়ের পর তেইশের নির্বাচন বিজেপির কাছে অতি বেশী চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে এটা মানতে হবে৷ বিজেপির ক্ষমতাসীন শরিক এখন পাহাড়ে প্রায় ছিন্নভিন্ন৷ দল ভেঙ্গে গিয়েছে৷ দলের সুপ্রিমো এন সি দেববর্মা গুরুতর অসুস্থ৷ সুতরাং খুব স্বাভাবিকভাবেই বিজেপি আইপিএফটিকে নির্ভর করবে না৷ এই যখন পরিস্থিতি তখন এরাজ্যের উপজাতিদের রাজনৈতিক ইতিহাস নিয়ে আলোকপাত করার সার্থকতা কতখানি আছে অনেকের প্রশ্ণ উঠতে পারে৷ ত্রিপুরায় উপজাতি রাজনীতির ইতিহাস আজকের সময়ে আলোচনা করলে অনেক বিষয় স্পষ্ট হয়ে যেতে পারে৷


ত্রিপুরায় উপজাতিদের মধ্যে একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল কমিউনিস্টদের৷  রাজন্য আমল থেকে এরাজ্যে কমিউনিস্ট আন্দোলনের বীজ রোপিত হয়েছিল৷ দশরথ দেবের নেতৃত্বে ত্রিপুরায় উপজাতিদের মধ্যে যে ঐক্যবদ্ধতা দেখা গিয়েছিল তাকে অবলম্বন করেই নৃপেন চক্রবর্তী, বীরেন দত্ত প্রমুখরা এরাজ্যে কমিউনিস্ট পার্টির পত্তন করেন৷ এই কমিউনিস্ট পার্টির শক্তি ছিল উপজাতিরা৷ সেই সময় বাঙালীদের মধ্যে কমিউনিস্ট দলে যোগদান ছিল বিরল ঘটনা৷ ষাটের দশকে এরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হন কংগ্রেসের শচীন্দ্র লাল সিংহ৷ শচীন্দ্র লাল কমিউনিস্ট শক্তিকে প্রতিহত করার যথেষ্ট চেষ্টা করেছেন৷ উপজাতিদের মধ্যে কংগ্রেসের প্রভাব প্রতিপত্তি বজায় রাখার লক্ষ্যে উপজাতি মন্ত্রী তাঁর মন্ত্রিসভায় ঠাঁই দেন৷ উপজাতি কল্যাণমন্ত্রী ছিলেন রাজেন্দ্র প্রসাদ রিয়াং (তসলামপা)৷ যিনি নিজের নামটাও লিখতে পারতেন না৷ মন্ত্রীর কাছে কেউ যদি কিছু চাইতে যেতেন তিনি স্পষ্ট বলে দিতেন আমি জানি না এটা শচীন যানে৷ কমিউনিস্ট পার্টির উপজাতিদের মধ্যে  আধিপত্যের মধ্যেও দীর্ঘ বছর কংগ্রেস ক্ষমতায় ছিল৷ ১৯৬২ সালে চীন ভারত যুদ্ধকে কেন্দ্র করেই কমিউনিস্ট পার্টিতে ভাঙন দেখা দেয়৷ মূল কমিউনিস্ট পার্টি সিপিআইয়ে থেকে যান ডাঙ্গে পন্থীরা৷ কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া (মার্কসবাদী) গড়েন জ্যোতি বসুরা৷ ত্রিপুরার কমিউনিস্ট পার্টির জাঁদরেল নেতারা সিপিআইএমে যোগ দেন৷ চারু মজুমদার, কানু সান্যালরা সিপিআই(এমএল) গঠন করে৷ তাঁরা উগ্রবাদী৷ তাঁদের বক্তব্য সংসদীয় গণতন্ত্রের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসা যাবে না৷ বন্দুকের নলই শক্তির উৎস৷ তাঁরা নকশালপন্থী হিসাবে পরিচিতি লাভ করে এবং ব্যর্থ সশস্ত্র আন্দোলনের মাধ্যমে এই দলটি এখন প্রায় ইতিহাসের পাতাতেই ঠাঁই নিয়েছে৷ এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্র শাসিত এই ত্রিপুরায় মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্র লাল সিংহ কংগ্রেসের জয়যাত্রা অব্যাহত রেখেছিলেন৷ ১৯৬২ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত শচীন্দ্র লালের কংগ্রেস ত্রিপুরায় রাজত্ব করেছে৷ ইতিমধ্যে বাঙালীদের একটা অংশ সিপিআইএমের পতাকা তলে শামিল হয় এবং বিধানসভায় সিপিআইএমের প্রতিনিধিত্ব বাড়তে থাকে৷ ১৯৭১ সালে মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্র লাল সিংহের সাথে প্রধানমন্ত্রী তথা কংগ্রেস সভানেত্রী ইন্দিরা গান্ধীর দূরত্ব বেড়ে চলে৷ রাজনীতির ইতিহাসে এটাও বিরল ঘটনা যে ত্রিপুরায় কংগ্রেস সংখ্যাগরিষ্ঠ দল থাকা সত্বেও রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করে কেন্দ্রের কংগ্রেস৷ ১৯৭২ সালে রাজ্যে কংগ্রেস বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে৷ এই বছরই ২১শে জানুয়ারী ত্রিপুরাকে পূর্ণরাজ্যের মর্যাদা দেয় কেন্দ্র৷ ত্রিপুরায় কংগ্রেসের গোষ্ঠী লড়াই থাকলেও প্রবল প্রতাপে রাজত্ব করেন সুখময় সেনগুপ্ত৷ এরাজ্যে উপজাতি রাজনীতির ক্ষেত্রে নতুন পদক্ষেপ সূচিত হয়৷ গড়ে উঠে ত্রিপুরা উপজাতি যুব সমিতি নামে আঞ্চলিক দল৷ সিপিএমের উপজাতি এলাকায় থাবা বসায় উপজাতি যুব সমিতি৷ উপজাতি যুব সমিতির আবির্ভাবের পিছনে মুখ্যমন্ত্রী সুখময় সেনগুপের মদত ছিল বলে তখন রাজনৈতিক প্রচার ছিল৷ সুখময় সেনগুপ্ত বুঝতে পেরেছিলেন সিপিএমই কংগ্রেসের মূল প্রতিপক্ষ৷ সিপিএমকে দূর্বল করতে হলে পাহাড়ে আরেক শক্তির আবির্ভাব ঘটাতে হবে৷ সেই লক্ষ্যেই উপজাতি যুব সমিতির আবির্ভাব৷ ১৯৭৫ সালে ইন্দিরা গান্ধী দেশে জরুরী অবস্থা জারী করেন৷ প্রবল জনপ্রিয়তার চূড়া থেকে ইন্দিরার এই ঘটনা ইতিহাসে নতুন ভাবনার জন্ম দিয়েছিল৷ এই পরিস্থিতিতেও ত্রিপুরায় উপজাতি যুব সমিতি পাহাড়ে যথেষ্ট শক্তি সঞ্চয় করে৷ ১৯৭৭ সালে ইন্দিরা গান্ধীর পতন হয় এবং রাজ্যে শচীন সিংয়ের প্রবল আধিপত্যের কারণে ও সিপিএমের সাথে সখ্যতার জন্য এরাজ্যে ১৯৭৮ সালে বামফ্রন্ট সিএফডি জোট ক্ষমতায় আসীন হয়৷ মুখ্যমন্ত্রী হন নৃপেন চক্রবর্তী৷ শচীন্দ্র লাল সিংহ যোগদান করেন সিএফডিতে৷ লোকসভার পশ্চিম আসনে দাঁড়িয়ে বিপুল ভোটে জয়ী হন৷ এরাজ্যে কংগ্রেস বিধবস্ত হয়৷ অশোক ভট্টাচার্য জয়নগরের বাড়িতে মোমবাতি জ্বালিয়ে কংগ্রেসের অস্তিত্ব রাখেন৷ উপজাতি যুব সমিতির আন্দোলন তেজি হয়৷ শ্যামাচরণ ত্রিপুরা, নগেন্দ্র জমাতিয়া প্রমুখরা উপজাতি আন্দোলনের লক্ষ্যে ঝাপিয়ে পড়েন৷ দাবী তুলেন এডিসি গঠন করতে হবে৷ উপজাতিদের জন্য আন্দোলন করে যে দল এরাজ্যে ক্ষমতায়ও বসেছিল সেই দলের অস্তিত্ব আজ আর নেই৷ ইতিহাস হয়ে গিয়েছে৷ ত্রিপুরায় উপজাতি রাজনীতির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় এরাজ্যে উপজাতি দলগুলি বুদ্বুদের মতো হারিয়ে যায়৷ (চলবে)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *