করিমগঞ্জ (অসম), ৫ এপ্রিল (হি.স.) : কথায় আছে দুর্দিনে সকল মতভেদ ও মতানৈক্য ভুলে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হয়। কারণ একমাত্র একতাই পুনরায় প্রতিষ্ঠা পেতে সহায়তা করে। কিন্তু শতাব্দি-প্রাচীন কংগ্রেস সমগ্র দেশের সঙ্গে বরাক উপত্যকায়ও বহুল প্রচলিত এই প্রবাদ থেকে কোনও শিক্ষা নিতে পারেনি। রাজ্যসভা নির্বাচন নিয়ে শতাব্দি-প্রাচীন কংগ্রেস অন্তর্কোন্দলে জর্জরিত। যে কোনও দলে মতান্তর থাকতেই পারে। কিন্তু মতান্তর মনান্তরে পরিণত হলে এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া দুষ্কর হয়ে দাঁড়ায়। শতাব্দি-প্রাচীন কংগ্রেস দল মনান্তরের ফলে অন্তর্জলি যাত্রার দিকে ধীরে ধীরে ধাবিত হচ্ছে। গতকাল দলের দুই গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘাতের দরুন শিলচরের জেলা কংগ্রেস ভবন উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল। এর রেশ কাটতে না-কাটতেই আজ মঙ্গলবার সকালে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে করিমগঞ্জের দলীয় জেলা সদর কার্যালয় ইন্দিরা ভবন।
প্রদেশ কংগ্রেসের কার্যনির্বাহী সভাপতি তথা উত্তর করিমগঞ্জের বিধায়ক কমলাক্ষ দে পুরকায়স্থ এবং জেলা সভাপতি সতু রায়ের উপস্থিতিতেই রণক্ষেত্রের রূপ নেয় ইন্দিরা ভবন। পরিস্থিতি এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, দলীয় দুই কর্মকর্তার মধ্যে সৃষ্ট সংঘাত আটকাতে গিয়ে বিধায়ক কমলাক্ষ দে পুরকায়স্থকে মাথায় অল্পবিস্তর আঘাতপ্রাপ্ত হতে হয়। জেলা কংগ্রেস সভাপতি সতু রায় কর্তৃক জারিকৃত দলীয় একটি চিঠিই এই ঘটনার মূল কারণ।
রাজ্যসভা নির্বাচনে দলীয় বিধায়ক সিদ্দেক আহমেদ ব্যালট পেপারে সংখ্যায় ১ (এক)-এর পরিবর্তে ইংরেজি বর্ণাক্ষরে ‘ওয়ান’ লিখেছিলেন। এতে তাঁর ভোটটি বাতিল বলে বিবেচিত হয়। সিদ্দেক ইচ্ছাকৃতভাবেই এমনটা করে বিজেপি প্রার্থীর পক্ষে নিজের সমর্থন জানিয়েছেন। এই অভিযোগে দলীয় কর্মী সমর্থকরা জেলার বিভিন্ন স্থানে সিদ্দেক আহমেদের কুশপুতুল দাহও করছেন। এ ব্যাপারে জেলা কংগ্রেস সভাপতি সতু রায় দলের পক্ষ থেকে একটি চিঠি ইস্যু করেন। দলীয় কর্মী সমর্থকদের উদ্দেশ্য করে এই চিঠিতে সতু রায় নির্দেশ দেন, দক্ষিণ করিমগঞ্জ ব্লকে সিদ্দেকের কুশপুতুল দাহ করে এর ছবি সদর কার্যালয়ে জমা দিতে হবে। সতু রায় কর্তৃক ইস্যু করা এই চিঠির সূত্র ধরেই মঙ্গলবার সকালে ইন্দিরা ভবন উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।
ইন্দিরা ভবনের অফিস সুপারিনটেনডেন্ট ফয়েজ আহমেদ চৌধুরী চিঠির বিষয়বস্তু ঠিক হয়নি বলে জেলা সভাপতি সতু রায়কে বলেন। এভাবে চিঠি ইস্যু করাও উচিত হয়নি বলেও জেলা সভাপতিকে বলেন ফয়েজ আহমদ চৌধুরী। সে সময় বিধায়ক কমলাক্ষ দে পুরকায়স্থ, শহর ব্লক কংগ্রেস সভাপতি তাপস পুরকায়স্থ সহ জেলা কংগ্রেসের বিভিন্ন স্তরের পদাধিকারীগণও জেলা কার্যালয়ে উপস্থিত ছিলেন। জেলা কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক (অর্গানাইজেশন) পঙ্কজ নাগ এ নিয়ে ফয়েজ আহমদের বিরোধিতা করেন। জেলা সভাপতি নির্দিষ্ট কোনও ব্লককে এভাবে চিঠি লিখতে পারেন না।
এটা দলীয় অনুশাসনের মধ্যে পড়ে না। এই বিষয়গুলোই জেলা সভাপতিকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন অফিস সুপারিনটেনডেন্ট ফয়েজ আহমেদ চৌধুরী। কিন্তু পঙ্কজ নাগ জেলা সভাপতির পক্ষ নিয়ে ফয়েজ আহমেদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান এবং জেলা সভাপতি কর্তৃক ইস্যুকৃত চিঠিটি ঠিক আছে বলে জোর গলায় বলতে থাকেন পঙ্কজ। এ নিয়ে উভয়ের মধ্যে তর্কাতর্কি শুরু হয়ে যায়। কেউ কারও পক্ষ ছাড়তে রাজি নন। এক সময় উভয়ের মধ্যে তুমুল বাদানুবাদ শুরু হয়। বিধায়ক কমলাক্ষ দে পুরকায়স্থ এবং জেলা সভাপতি সতু রায়ের সামনে দলীয় দুই পদাধিকারীর মধ্যে তুমুল বচসা চলতে থাকলেও উভয়ে তখন পর্যন্ত নির্বাক দর্শকের ভূমিকা পালন করছিলেন। কিন্তু পরিস্থিতি একসময় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।
এতক্ষণ ধরে উভয়ের মধ্যে চলতে থাকে তুমুল বাদানুবাদ। তা পরে হাতাহাতির পর্যায়ে চলে আসে। বিধায়ক ও জেলা সভাপতি তখন পর্যন্ত বিষয়টি সমাধানে কোনও উদ্যোগ নেননি বলে সে সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুকদের কাছ থেকে জানা গিয়েছে। মুহূর্তের মধ্যে পরিস্থিতি অন্য মোড় নিয়ে নেয়। উত্তেজিত পঙ্কজ নাগ এবং ফয়েজ আহমদ চৌধুরী চেয়ার ও লাঠি হাতে নিয়ে একে অপরের দিকে তেড়ে আসেন। সঙ্গে চলে অশালীন গালিগালাজ। ঘটনা চূড়ান্ত পর্যায়ে যাওয়ার পর বিধায়ক ও জেলা সভাপতির সম্বিৎ ফিরে। চেয়ার হাতে নিয়ে তেড়ে আসা পঙ্কজ নাগকে আটকাতে গিয়ে বিধায়ক কমলাক্ষ সামান্য আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন বলে জানা গিয়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে একসময় বিধায়কের ব্যক্তিগত দেহরক্ষীকেও মাঠে নামতে হয়। দলীয় কার্যালয়ে উপস্থিত অন্যান্য কর্মী সমর্থকদের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হয়। পরবর্তীতে নিজেদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির বিষয়টি শীঘ্রই দলের ভিতরেই সমাধান করা হবে বলে উভয় পক্ষকে শান্ত করেন জেলা সভাপতি সতু রায়।
বিধায়ক কমলাক্ষ নিজের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, বিষয়টি পঙ্কজ এবং ফয়েজের মধ্যে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত। সামান্য ব্যাপার নিয়ে উভয়ের মধ্যে সাময়িক উত্তেজনার বহিঃপ্রকাশ মাত্র। ভুল বোঝাবুঝি খুব শীঘ্রই দূর হয়ে যাবে বলে দাবি করেছেন বিধায়ক কমলাক্ষ। দলের মিডিয়া সেলের চেয়ারম্যান শুভঙ্কর দাস দলীয় নেতা, কর্মী ও সমর্থকদের উদ্দেশ্যে এক বার্তায় দলের এই দুঃসময়ে সকলকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানান।