কাশী বিশ্বনাথ ধামঃ আমাদের জীবন্ত ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য

অনুরাগ সিং ঠাকুর

১৩ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদী কাশী বিশ্বনাথ ধাম উদ্বোধন করেছেন। এটা এক সভ্যতাময় নগরী, যা হল কাশী ও ঐতিহাসিক কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরের সঙ্গে সাযুজ্য বিশিষ্ট অভূতপূর্ব প্রকল্প। কাশীর তাৎপর্য ও প্রাচীনত্বের উপর আলকপাত করে মার্ক টেয়েন লিখেছিলেন, “বারানসী হল ইতিহসের চেয়েও প্রাচীন ঐতিহ্যের চেয়েও প্রাচীন, এমনকী কিংবদন্তির চাইতেও প্রাচীন এবং এর সব কিছু একত্রিত করলে যা হয় তার চেয়েও দ্বিগুন প্রাচীন বলে মনে হয়”।

এই প্রকল্পটি উদ্বোধন করার মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী মোদী আমাদের এই গ্রহের উপর এক অন্যতম প্রাচীন জীবন্ত শহর, হিন্দুত্ববাদের ও আমাদের যুগ-যুগান্তরের প্রাচীন সভ্যতার উপকেন্দ্র, সার্বজনীন বিশ্বের কাছে কাশি অথবা বারানসীকে পুনরায় উৎসর্গ করেছেন।

এটা বিশ্বে প্রাচীনতম ধারাবাহিক বসবাসেপূর্ন নগরীগুলির মধ্যে অন্যতম বলে বিবেচিত হয়। বিশ্ব জুড়ে অন্যান্য প্রাচীন শহরগুলি যথন সাম্রাজ্যবাদী ও ঔপনিবেশিক আক্রমনে বেঁচে থাকতে পারেনি, তখন কাশী তার চারিত্রিক উদ্দীপনা ঠিকই বহন করে রেখেছে। এর ধারাবাহীকতার মাধ্যমে এই শহর এমনকী বর্বর আক্রমন ও হানাদারীর মুখেও তার সাংস্কৃতিক, শৈল্পিক ও শিক্ষা সংক্রান্ত পরিচিতি রক্ষা করতে তার কঠোর সহনশীলিতার সংকেত দিয়েছে।

কাশী বিশ্বনাথ ধাম এই শহরের অত্যাচারীত অতীতের উর্ধে এক অভ্যুদিত গুরুগম্ভীর ব্রতের উত্থত্থানকে প্রতিফলিত করছে। ভিন্ন অর্থে এটা হল বহু বর্ষ প্রাচীন এই দেশের আধ্যাত্মিক, শিক্ষাগত ও সৃজনশীল ঐতিহ্যকে পুনরুজ্জীবিত করতে এক বিনম্র প্রয়াস। এই ধামের সূত্রে ইতিহাস এক নতুন বাঁক নিয়েছে। সম্ভবত এটাই ইতিহাসে প্রথম বারের মতো কোনো রকম বিনাশ, অবসাদ অথবা কোনো রকম প্রতিহিংসার ছাড়াই হাজার হাজার বছরের অবিচারের প্রেক্ষিতে অসমাপ্ত কাজ সাধিত হল। এটা অর্জিত হয়েছে একেবারেই নির্মান ও সৃজনের মাধ্যমে।

যুগ যুগান্তর ধরে কাশির পরিচিত হল এটা স্বাধীনতা অথবা মুক্তির নগরী। সব দিক থেকে মানুষ মুক্তির সন্ধানে কাশীতে ছুটে আসে। প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদী এই দিকদর্শন ও প্রয়াসকে শতাব্দী প্রাচীন গৌরব সহ কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরের প্রতি ফিরিয়ে নিয়ে এসেছেন।

কাশী বিশ্বনাথ ধাম হল সমগ্র মানবতার জন্য একটি প্রকল্প। কেননা এটা হল সভ্যতার নিজেরই ধারাবাহিকতার এক উদযাপন। তাই এটা হল সমগ্র বিশ্বের জন্য একটি প্রকল্প। হিন্দু সর্বদেবতার মন্দির ভবনা পবিত্র ত্রিদেবতা- ভগবান ব্রহ্মা, বিশ্বের স্রষ্টা-ভগবান বিষ্ণু, বিশ্বের রক্ষাকর্তা-ভগবান শিব, বিশ্বের মুক্তিত্রাতা বিষয়ক ধারনাকে স্বীকৃতি জানায়। কাশী পরম শ্রদ্ধাবোধকে বির্ভূত করে, কারন এ হল ভগবান শিবের এক অন্যতম বাসস্থান। এ হল কাশীর ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক গুরুত্বময় সারকথা।

এ বছরের সংবিধান দিবসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছেন, “ভারত এবং বিশ্বের বহু দেশের জন্য বহু প্রজন্ম ধরে ঔপনিবেশিকতার শৃঙ্খলে বাস করাটা ছিল একটা বাধ্যবাধকতা। ভারতের স্বাধীনতার পর থেকে সমগ্র বিশ্ব জুড়ে শুরু হল এক ঔপনিবেশিকোত্তর যুগ এবং বহু দেশ স্বাধীনতা অর্জন করল। আজ বিশ্বে এমন কোনো দেশ নেই যা দৃশ্যত অন্য কোনো দেশের উপনিবেশ হয়ে আছে। কিন্তু এ কথার অর্থ এই নয় যে ঔপনিবেশিক মানসিকতার একেবারে অবসান হয়ে গেছে”।

তাই মানবতার জন্য এটাই বাধ্যতামূলক, বহু প্রজন্মের জন্য যারা ঔপনিবেশিকতাবাদের মধ্যে বেঁচে ছিল, তাদের আগে নিজেদেরকেই ঔপনিবেশিকতার হাত থেকে মুক্ত করতে হবে, স্বাধীনতা অর্জন করতে ও পুনরায় উপস্থাপক হতে এটা আবশ্যক।

ঐতিহাসিকভাবে অন্যান্য আরো অনেক কিছুর পাশাপাশি ঔপনিবেশিকতার মূল অস্ত্র ও লক্ষ্য, উপায় ও পদ্ধতিগুলি হয়ে উঠেছিল লুন্ঠন ও ধ্বংস। স্বাভাবিকভাবেই এই ধরনের বর্বর ঘাতকদের কাছে সভ্যতার সম্পদ, জ্ঞান ও প্রত্নতাত্ত্বিক ভান্ডার গুলি ছিল প্রধানতম আক্রমনের লক্ষ্যবস্তু।

কাশীতে ফিরে আসছি। এই কিংবদন্তি নগরীও ক্রমাগতভাবে লুন্ঠন ও অনাচার, ধংস ও বিনাশের শিকার হয়েছে যার বহু চিহ্ন রয়ে গেছে এবং বলে দিচ্ছে কল্পনায় এ শহর কেমন হতে পারত। এটা বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন প্রদর্শশালা ও ব্যক্তিগত সংগ্রহে কাশী থেক প্রাপ্ত গৌরবময় প্রাচীন সামগ্রীর নমুনা হিসেবে স্বাক্ষ্য-প্রমাণ বহন করছে।

সাধারনভাবে কাশী নগরী, এবং বিশেষভাবে শ্রী কাশী বিশ্বনাথ মন্দির, অতীতে বহু বার ধ্বংস করা হয়েছে এবং নির্মানও করা হয়েছে বহুবার। প্রাথমিকভাবে শ্রী কাশী বিশ্বনাথ মন্দির ধ্বংস করেছিল ঘুরিদ তুর্কি সুলতান কুতুব-উদ-দিন আইবক এবং তা পুনর্নির্মান করেন একজন গুজরাটি ব্যবসায়ী। এই ধংস 3 পুনর্নির্মানের কাহিনি চলছিল ১৭৮০ পর্যন্ত, তারপর যখন মহান মারাঠা রানী আহিল্যাবাই হোলকর স্বপ্নে দেখতে পেলেন ভগবান শিব এসেছেন এবং তিনি ভগবান শিবের ভক্ত হলেন ও নির্মান করলেন এই মন্দির তখন তা থামল। একটি কিংবদন্তি এই রকম। অন্য একটি কিংবদন্তি অনুযায়ী, এই নগরীর উপর আক্রমনের পর শিবাজি মহারাজ তৎক্ষনাৎ হাতে তুলে নেন তরবারি। বলা হয়ে থাকে, ঔরঙ্গজের যখন কাশী বিশ্বনাথ মন্দির ধ্বংস করল, তখন শিবাজি মহারাজের মতো জিজাবাই এতটাই ক্ষীপ্ত হয়ে উঠলেন যে তিনি মুঘলের নিয়ন্ত্রানাধীন সিংহগড় দুর্গ দখল করতে এক বিন্দু দ্বিধা করেননি। বাকিটা ইতিহাস।

এই মন্দির প্রাঙ্গনের পুনরুজ্জীবন শুধু ঔপনিবেশিক অবসাদ থেকে বেরিয়ে আসার একটি পদক্ষেপ মাত্র নয়, উপরুক্ত বর্বরতার উপর সভ্যতার প্রাধান্যকেও এটা প্রতীকায়িত করছে, আদিম নৃশংসটার উপর জ্ঞান ও শ্রদ্ধার এক আসনের পুনসতিষ্ঠা। এই প্রকল্প হল গঠনমূলক আবেদনের মাধ্যমে সাশাপাশি সম্পূর্ন সংহতিকে সুনিশ্চিত করে এইসব প্রশংসনীয় লক্ষ্য অর্জন করতে একটি উদাহরনকে উপস্থাপনা করছে এবং একে অনুসরন করার এক নিদর্শন। আমাদের কাশী বিকশিত ও সমৃদ্ধতর হয়ে উঠুক। ভগবান শিব তাঁর স্বর্গীয় মহিমা দিয়ে আশীর্বাদধন্য করুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *