গুয়াহাটি, ২ জুন (হি.স.) : কোভিডে আক্রান্ত জনৈক রোগীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে গতকাল মঙ্গলবার লংকার উদালিতে ফুলতলি মডেল হাসপাতালে কর্তব্যরত ডাক্তারকে গণপিটুনির সঙ্গে জড়িত ২৪ দুষ্কৃতীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে একজন মহিলাও রয়েছেন। টুইট করে এই খবর জানিয়েছেন গৃহ দফতরের দায়িত্বপ্রাপ্ত মুখ্যমন্ত্রী হিমন্তবিশ্ব শর্মা এবং অতিরিক্ত ডিজিপি (আইন-শৃঙ্খলা) তথা স্পেশাল ডিজিপি আইপিএস জিপি সিং। এদিকে অবাঞ্ছিত ওই ঘটনার প্রতিবাদে এবং ডাক্তার সহ সব স্বাস্থ্যকর্মীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবিতে আজ বুধবার অসমের সব সরকারি হাসপাতালের আউটডোর (ওপিডি) বন্ধ করে দিয়েছেন ‘আসাম মেডিক্যাল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন’ (আমসা)-এর সদস্য ও সর্বস্তরের চিকিৎসক। এছাড়া একজন কর্তব্যরত তথা কোভিড আক্রান্তদের জীবন রক্ষায় নিয়োজিত প্রথমসারির যোদ্ধার ওপর বর্বরোচিত গণহামলার ঘটনায় ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে। অপরাধীদের ফাস্টট্র্যাক আদালতে বিচার প্রক্রিয়া চালানোরও দাবি উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে।
কোভিডে আক্রান্ত জনৈক রোগীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে গতকাল মধ্য অসমের হোজাই জেলার অন্তর্গত লংকার উদালিতে ফুলতলি মডেল হাসপাতালে তুলকালাম কাণ্ড ঘটিয়েছিল উত্তেজিত জনতা। একাংশ উত্তেজিত জনতা কিল-ঘুঁষি, লাথি, স্টিলের থালা, বাঁশ দিয়ে বেধম মেরেছে কর্তব্যরত ডাক্তারকে। মেজেতে ফেলে প্রাণঘাতী গণপিটুনির শিকার হয়েছিলেন ডা. সেউজ কুমার সেনাপতি। তাঁকে উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রথমে নগাঁওয়ে ভোগননী ফুকননী অসামরিক হাসপাতালে পাঠানো হয়েছিল। পরবর্তীতে রাতেই নিয়ে আসা হয়েছে গুয়াহাটি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। এখানে তাঁর চিকিৎসা চলছে।
মূলত কোভিডে আক্রান্ত রোগী লংকার ২ নম্বর পিপলপুখুরি গ্রামের জনৈক গিয়াস উদ্দিনকে অত্যন্ত সংকটজনক অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল উদালির আদর্শ হাসপাতালে। সেখানে কর্তব্যরত ডাক্তার সেউজ কুমার সেনাপতি নার্স এবং অন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে তাঁর চিকিৎসা শুরু করেন। ইত্যবসরে বেলা দুটো নাগাদ রোগী গিয়াস উদ্দিন মৃত্যুবরণ করেন। এই ঘটনাকে কেন্দ্ৰ করে সংঘটিত হয়েছে অবাঞ্ছিত ঘটনাটি। রোগীর মৃত্যুর খবরে উত্তেজিত হয়ে পড়েন তাঁর আত্মীয়স্বজন এবং তাঁদের সঙ্গে আগত ব্যক্তিরা। তারা দলবদ্ধভাবে ডাক্তার সেনাপতির ওপর হামলা করে বসেন। প্রায় কুড়ি থেকে তিরিশ মিনিট তাঁর ওপর চলে বর্বর আক্রমণ। উন্মত্ত জনতা হাসপাতালের চিকিৎসা সরঞ্জাম এবং আসবাবপত্র ভেঙে চুরমার করে দিয়েছেন। বেশ কিছুক্ষণ পর ঘটনাস্থলে ছুটে আসে পুলিশের দল। পুলিশের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্ৰিত হয়। গুরুতর আহত ডা. সেউজ কুমার সেনাপতিকে উন্মত্তদের কবল থেকে উদ্ধার করে পাঠানো হয় নগাঁও সিভিল হাসপাতালে। নগাঁও থেকে পাঠানো হয় গুয়াহাটিতে।
এদিকে দিল্লিতে অবস্থানরত মুখ্যমন্ত্রী ড. শর্মা ঘটনার খবর পেয়ে অনতিবিলম্বে ডাক্তারের ওপর হামলাকারীদের গ্রেফতার করতে ডিজিপিকে নির্দেশ দেন। পাশাপাশি নৃশংস ঘটনার তীব্র নিন্দা করে তাঁর অফিশিয়াল টুইটার হ্যান্ডলে কালো রঙের ওপর রিভার্সে সাদা রং দিয়ে লিখেছেন, প্রথমসারির যোদ্ধাদের ওপর বর্বরোচিত হামলা কোনও অবস্থায় সহ্য করা যায় না। অপরাধীদের পাকড়াও করে যথোপযুক্ত শাস্তি দিয়ে নিগৃহীতকে ন্যায় পাইয়ে দেওয়ার অঙ্গীকার করছি। অনুরূপভাবে আজ সকালেও আবার টুইট করে অভিযুক্ত ২৪ জনকে গ্রেফতারের খবর দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী হিমন্তবিশ্ব শর্মা। তিনি এও লিখেছেন, ধৃতদের বিরুদ্ধে ফাস্টট্র্যাক আদালতে বিচার প্রক্রিয়া চালানোর সুপারিশ করা হয়েছে। গোটা ঘটনার তিনি স্বয়ং মনিটরিং করছেন বলেও জানান মুখ্যমন্ত্রী।
এদিকে অতিরিক্ত ডিজিপি (আইন-শৃঙ্খলা) তথা স্পেশাল ডিজিপি আইপিএস জিপি সিং জানান, গ্ৰেফতার ২৪ জনের বিরুদ্ধে খুব শীঘ্ৰই চার্জশিট দাখিল করা হবে। তিনি জানান, গতকাল সন্ধ্যায় প্রথমে একজন, পরে আরও তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তবে আজ ভোর চারটা পর্যন্ত এক মহিলা সহ ২৪ জনকে এই ঘটনার অভিযোগে গ্রেফতার করেছে হোজাই পুলিশ। আজই তাদের হোজাইয়ের শংকরদেব নগর বিচারবিভাগীয় আদালতে তোলা হয়েছে। এই খবর লেখা পর্যন্ত শুনানি চলছে বলে জানা গেছে।
অন্যদিকে, গতকাল রাতে নগাঁও সিভিল হাসপাতালে গিয়ে গুরুতর আহত ডা. সেউজ সেনাপতির শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর নিয়েছেন রাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী কেশব মহন্ত। তিনিও মুখ্যমন্রীজ্র মতো ভোরের আলো ফোটার আগে সব দুষ্কৃতীকে গ্রেফতার করতে পুলিশ সুপারকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। হাসপাতালে সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্ৰী মহন্ত বলেন, ‘যা ঘটেছে তা অত্যন্ত দুৰ্ভাগ্যজনক ঘটনা, আমি মৰ্মাহত। রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে ঘটনার তীব্র নিন্দা করে স্পষ্ট করে দিতে চাই, এ ধরনের ঘটনাকে আমরা কোনওভাবেই সহ্য করব না। ঘটনার সঙ্গে জড়িত কাউকেই রেহাই দেওয়া হবে না। কোভিডের এই জটিল সময়ে নিজদের জীবনকে বাজি রেখে দিবারাত্রি চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত আমাদের প্ৰতিটি চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকৰ্মীর গায়ে হাত দেওয়ার কথা দূর একটি লোমেও যদি কেউ স্পৰ্শ করে তাহলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোরতম ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ মন্ত্রীর ঘোষণা, রাজ্যের প্ৰতিটি চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকৰ্মীকে সম্পূৰ্ণ নিরাপত্তা প্ৰদান করবে সরকার। এছাড়া এখন থেকে রাজ্যের কোনও চিকিৎসক বা চিকিৎসাকৰ্মীর গায়ে হাত দিলেই কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেছিলেন, গুরুতর আহত ডা. সেউজ কুমার সেনাপতিকে উন্নত চিকিৎসার জন্য রাতেই গুয়াহাটি মেডিক্যাল কলেজ হাসাপাতালে স্থানান্তর করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
ইতিমধ্যে যে ২৪ জন অভিযুক্তকে গ্ৰেফতার করা হয়েছে তাদের তালিকা প্রকাশ করেছে পুলিশ। তালিকা অনুযায়ী ধৃত অভিযুক্তরা যথাক্রমে ১. মহম্মদ কামার উদ্দিন, ২. মহম্মদ জয়নাল উদ্দিন, ৩. মহম্মদ রাহান উদ্দিন, ৪. সাইফুল আলম, ৫. রহিম উদ্দিন, ৬. রিজুল ইসলাম, ৭. তৈয়বুর রহমান, ৮. রহিম উদ্দিন, ৯. আবদুল কালাম, ১০. নুরজুল ইসলাম, ১১. আবদুল গুমি, ১২. দিলওয়ার হুসেন, ১৩. আবদুল হুসেন, ১৪. আনোয়ার হুসেন, ১৫. এক্ৰামুল হুসেন, ১৬. নাসির উদ্দিন, ১৭. আলিম উদ্দিন, ১৮. জামিল আহমেদ, ১৯. সাহিল ইললাম, ২০. সরিফ উদ্দিন, ২১. শফিক উদ্দিন, ২২. মফিজুর রহমান, ২৩. মতিবুর রহমান এবং ২৪. মিসমিসবা বেগম।

