ডায়মন্ড হারবারে কোন হালদার হাল ধরবেন, উত্তর দেবে সময়

অশোক সেনগুপ্ত

কলকাতা, ২ এপ্রিল (হি.স.): দুই হালদারের বিরোধে দীর্ঘদিন ধরে অশান্তির বাতাবরন তৈরি হয়েছিল ডায়মন্ড হারবারে। যার সমাধান করতে রীতিমত ল্যাজেগোবরে হতে হয়েছিল খোদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে। দুই হালদারের একজন, দীপক ভোটের মুখে দলত্যাগ করে যোগ দিয়েছেন বিজেপিতে। প্রার্থীও হয়েছেন। তাঁর প্রধান লক্ষ্য অপর হালদার, পান্নালালকে হারানো। আর, এই দুরূহ লড়াইয়ে পান্নালালের প্রধান অস্ত্র খোদ অভিষেক। ডায়মন্ড হারবারের ‘ঘরের ছেলে’ দীপকের রাজনীতির হাতেখড়ি ফিকরচাঁদ কলেজের ছাত্র হিসাবে, ৩৮ বছর আগে। ’৮৫-তে বানিজ্যে স্নাতক হন। ব্লক যুব কংগ্রেস সাধারণ সম্পাদক থেকে ধাপে ধাপে জেলা সভাপতি, ’৯৩ ও ’৯৮-এ গ্রাম পঞ্চায়েতে বিরোধী (কংগ্রেস) দলনেতা, ২০০৮ থেকে ’১১ পর্যন্ত ছিলেন পঞ্চায়েত সমিতির সহকারী সভাপতি। এর পর বিধায়ক হলেও বিতর্ক জড়িয়ে থাকে ছায়ার মত।
এলাকার রাজনীতিকে হাতের তালুর মত জানেন শুভাশিস ঘটক। তাঁর কথায়, “পরিবর্তনে’র বছরে বিধায়ক হওয়ার পরে সিপিএমের হাত থেকে ডায়মন্ড হারবার বন্দরে শ্রমিক সংগঠনের দখল নেন দীপক। বিধায়কের রাজনৈতিক জীবনে কালো ছায়া নেমে আসার পিছনে ওই শ্রমিক সংগঠনই বড় ভূমিকা নেয় বলে মনে করেন জেলা তৃণমূলের একাংশ। দলের অন্দরের খবর, ডায়মন্ড হারবার বন্দর-এলাকা দখল নেওয়ার পর থেকেই বিধায়কের বিরোধী গোষ্ঠী দলে ভারী হতে শুরু করে। তখন ডায়মন্ড হারবারের পুরপ্রধান পান্নালাল হালদারের গোষ্ঠীর সঙ্গে নানা বিষয়ে বিবাদে জড়িয়ে পড়তে থাকেন দীপক। কিন্তু দক্ষ সংগঠক দীপকের সঙ্গে লড়াইয়ে হালে পানি পাচ্ছিল না পান্নালাল গোষ্ঠী। ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনের পর থেকেই দলীয় গোষ্ঠী রাজনীতিতে সমীকরণ বদল শুরু হয়। ডায়মন্ড হারবার কেন্দ্রে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় সাংসদ নির্বাচিত হওয়ার পরে পান্নালাল গোষ্ঠী দীপকের বিরুদ্ধে একের পরে এক অভিযোগ জানাতে শুরু করে। বন্দরের শ্রমিক সংগঠনের ‘একচ্ছত্র’ দখলদারির বিষয়টিও সাংসদকে জানানো হয়।
দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা তৃণমূল সূত্রের বক্তব্য, ডায়মন্ড হারবার বন্দরে জাহাজ থেকে মাল খালাসের জন্য দিনে শ’পাঁচেক শ্রমিক সরবরাহ করা হয়। মজুরির একটি অংশ শ্রমিক সংগঠনের তহবিলে জমা পড়ে। সব মিলিয়ে সে বাবদ শ্রমিক সংগঠনের আয় বছরে কোটির অঙ্ক ছাড়িয়ে যায়। লোকসভা নির্বাচনের পরে দীপককে কোণঠাসা করে ওই বন্দরের দেখভালের দায়িত্ব সাংসদ-ঘনিষ্ঠ সোনারপুর এলাকার বাসিন্দা তৃণমূল নেতাকে দেওয়া হয়। দীপক-ঘনিষ্ঠদের অভিযোগ, বন্দরের দখল কেড়ে নেওয়ার পরেই বিধায়ককে বিপাকে ফেলার চিত্রনাট্য তৈরি করা হয়। সরিষায় দলীয় কার্যালয়ে এক বৈঠকে ডায়মন্ড হারবার ১ ও ২ পঞ্চায়েত সমিতির কয়েক জন এবং ১৬টি পঞ্চায়েতের তৃণমূল সদস্যেরা দীপকের বিরুদ্ধে নানা বিষয়ে লিখিত অভিযোগ জমা দেন। ওই সব অভিযোগ তৃণমূল ভবনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। জেলা তৃণমূলের এক নেতা ঘনিষ্ঠ মহলে মানছেন, ‘‘দীপকের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ মুখ্যমন্ত্রীর কানেও দেওয়া হয়েছিল। তার পরেই ছক তৈরি ছিল।’’ কলেজে গিয়ে পুলিশের সঙ্গে বচসায় জড়িয়ে পড়া মাত্রই মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে দীপক গ্রেফতার হন।”
২০১৫-র জুলাই মাস নাগাদ তৈরি হয়ে গিয়েছিল চিত্রনাট্য। দলে তাঁর ঘনিষ্ঠদের দাবি, প্রায় সেই ছকমাফিকই ডায়মন্ড হারবারের ফকিরচাঁদ কলেজে গোলমালের ঘটনায় গ্রেফতারের পরে দল থেকে সাসপেন্ড হন স্থানীয় তৃণমূল বিধায়ক দীপক হালদার। তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘দল-বিরোধী কাজের অভিযোগে বিধায়ককে দল থেকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত সাসপেনশন বহাল থাকবে।’’ শাসক দলে দীপকবাবু ছিলেন সেই মুহূর্তে চতুর্থ বিধায়ক, যাঁর উপরে সাসপেনশনের খাঁড়া নামে।”
এই ভাবেই টিঁকেছিলেন দীপকবাবু। তাই হালে বিজেপি-র পালে হাওয়া আসতেই দেরি করেননি দলবদলে। ‘হিন্দুস্থান সমাচার’-এর কাছে দাবি করলেন, এবারেও জিতে হ্যাটট্রিক করবেন। কিন্তু ২০১১-র ভোটে তৃণমূলের প্রার্থী হিসাবে দীপকবাবু পান ৫৩.৩৭ শতাংশ ভোট। সিপিএম ও বিজেপি পেয়েছিল যথাক্রমে ৪০.৭২ এবং ৩.০১ শতাংশ ভোট। ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনে দীপকবাবু পান ৯৬,৮৩৩ ভোট। সিপিএম ও বিজেপি পেয়েছিল যথাক্রমে ৮১,৭৯৬ ও ১৪,৬১৪ ভোট। সিপিএম হারানো জমি অনেকটাই ফিরে পেয়েছে। তাহলে কিসের ভিত্তিতে জয়ের আশা করছেন? দীপকবাবুর জবাব, “পরিবর্তনর হাওয়া। ডায়মন্ড হারবারের মানুষের ওপর গভীর আস্থা আছে আমার। আমি বিশ্বাস করি ওঁরা আমাকে জেতাবেন।” দীপকবাবুর বিশ্বাস সঠিক হয়, না চিড় খায় সেই বিশ্বাসের ভিত, সময়ই তার উত্তর দেবে। দক্ষিণ ২৪ পরগণার ডায়মন্ড হারবারের ভোট ৬ এপ্রিল।