রবীন্দ্র কিশোর সিনহা
“স্বরাজ আমাদের জন্মগত অধিকার এবং আমি এটি নিয়েই ছাড়ব।” এমন অনুপ্রেরণামূলক উক্তি লোকমান্য বালগঙ্গাধর তিলককে কি দেশ ভুলে গিয়েছে? তাঁকে যদি দেশ ভুলে না যায় তবে কমপক্ষে তাঁর শততম মৃত্যুবার্ষিকীতে সঠিক উপায়ে স্মরণ করা উচিত ছিল। তেমনটা হয়নি। ১৯২০ সালের পয়লা আগস্ট তৎকালীন বোম্বে শহরে বালগঙ্গাধর তিলক শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
কয়েকটি মুষ্টিমেয় সরকারী কর্মসূচি বাদ দিলে মনেই হচ্ছে না তিলককে তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে কেউ স্মরণ করেছেন। দেশের প্রতি তাদের অবদান এবং ত্যাগকে এক প্রকার উপেক্ষা করা হয়েছে। এটি সত্য যে বিশ্বব্যাপী মহামারী কোভিড -১৯ এর কারণে অনেক কিছু বদলেছে, তার মানে কি দেশ মহাপুরুষদের স্মরণ করবে না। বিভিন্ন প্রসঙ্গে যে সামাজিক মাধ্যম সরব হয়ে ওঠে তারাও লোকমান্য বালগঙ্গাধর তিলককে অবজ্ঞা করেছে।লোকমান্য বালগঙ্গাধর তিলক একজন প্রখ্যাত সাংবাদিক, সুপরিচিত গণিতবিদ, দার্শনিক এবং চরমপন্থী জাতীয়তাবাদী নেতা ছিলেন। যিনি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ভিত্তি স্থাপনে সহায়তা করেছিলেন। তিনি ১৯১৪ সালে ‘ইন্ডিয়ান হোম রুল লীগ’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিলকের নামে আপনি প্রতিটি দেশের মহানগরীতে একটি এলাকা, রাস্তা, কলেজ ইত্যাদি পাবেন।দেশটির রাজধানী দিল্লির ব্যস্ততম চৌরাস্তা তিলক ব্রিজের উপরে তার বৃহদাকার আয়তনের মূর্তির দিকে তাকালে মনে হয় যেন তিনি রাজধানীতে নজর রাখছেন। এই মূর্তিটি খুব প্রাণবন্ত।দিল্লিতেই, তাঁর একটি মূর্তি কাস্তুরবা গান্ধী মার্গে অবস্থিত মহারাষ্ট্র সদনেও স্থাপন করা হয়েছে। যদি আমরা সংসদ ভবনের কথা বলি, তবে ১৯৫৬ সালের ২৮ জুলাই সংসদ ভবনের কেন্দ্রীয় হলে তিলকের একটি ছবি স্থাপন করা হয়েছিল। এটি আঁকেন বিখ্যাত চিত্রশিল্পী গোপাল দেশুকার। প্রতি বছর, তিলকের জন্মদিন এবং মৃত্যুবার্ষিকী এই ছবিটিতে মাল্যদান করে বর্তমান রাজনেতারা স্মরণ করেন।
লোকমান্য তিলক স্বাধীনতা আন্দোলনে অসামান্য অবদান রেখেছিলেন, তিনি ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনকে সজীব করেছিলেন। লোকমান্য তিলকের স্বরাজের স্লোগানটি ভারতীয় সমাজকে জাগ্রত করতে এবং কাগজের স্বাধীনতা আন্দোলনকে একটি গণ আন্দোলনে রূপান্তরিত করতে সাহায্য করেছিল। মৃত্যু এবং স্মরণে কেবল অর্ধ অক্ষরের পার্থক্য রয়েছে, তবে এই অর্ধেকটি অক্ষর যোগ করার জন্য একজনকে পুরো জীবন উৎসর্গ করতে হবে এবং তিলক এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ ছিলেন।সম্ভবত খুব কম লোকই জানে যে তিলকই প্রথম বীর সাভারকরকে অনুপ্রাণিত করে ১৯০৭ সালে পুনের কাঠের সেতুর উপরে ইংরেজী পোশাক এবং জিনিসপত্রের সলিল সমাধি ঘটিয়েছিলেন। এই আন্দোলনটি যাতে কংগ্রেস অফিস থেকে বেরিয়ে এসে গ্রাম-রাস্তায় আন্দোলনে পরিণত হতে পারে সেই পথ দেখিয়েছিলেন তিনি।
আপনি যদি ভারত ও ভারতের গৌরবময় ইতিহাসকে জানতে চান তবে বাল গঙ্গাধর তিলককে বারবার পড়তে হবে। দেশের মানুষকে স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে যুক্ত করতে, লোকমান্য তিলক শিবাজী জয়ন্তী ও গণেশ উৎসবকে একটি লোক উৎসব হিসাবে উদযাপন শুরু করেছিলেন যা ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের দিকনির্দেশনা এবং অবস্থা উভয়ই পরিবর্তিত করেছিল।লোকমান্য তিলক ছিলেন অস্পৃশ্যতার শক্তিশালী প্রতিপক্ষ। তিনি বর্ণ ও সম্প্রদায়গুলিতে বিভক্ত সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য একটি বিশাল আন্দোলন শুরু করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে ঈশ্বর যদি অস্পৃশ্যতার মনোভাবকে গ্রহণ করেন তবে আমি সেই ঈশ্বরকে গ্রহণ করব না।
দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে লোকমান্য তিলকের অবদানের বিষয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ যথাযথভাবে বলেছেন যে তিনি তাঁর জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত জাতির জন্য ত্যাগ করে গিয়েছেন। সেই ত্যাগের মধ্যে যে আদর্শ তৈরি হয়েছিল তাতে অনুপ্রাণিত হয়েছিল বিপ্লবীদের পরবর্তী প্রজন্ম।ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে তিলক যে স্লোগানটি উত্থাপন করেছিলেন, “স্বরাজ আমার জন্মগত অধিকার এবং আমি এটি নিয়েই ছাড়ব।” সর্বদা সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসের সেরা প্রেরণামূলক স্লোগান হিসাবে।বাল গঙ্গাধর তিলক ভারতীয় সংস্কৃতির গর্বের ভিত্তিতে দেশবাসীর মধ্যে একটি শক্তিশালী জাতীয় ভালবাসা জাগাতে চেয়েছিলেন। এর সুদূর প্রসারী লক্ষ্য নিয়ে তিনি সারাদেশে জিমনাসিয়াম, কুস্তির আখড়া, গরু নিধন বিরোধী প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছিলেন। আজ এটি খুব সহজ বলে মনে হচ্ছে তবে উনিশ শতকে খুব কম লোকই তা বাস্তবায়িত করার জন্য তাদের সারা জীবন উৎসর্গ কৃত করতে পারতো।লোকমান্য তিলকের এই বাক্যটি ভারতীয় সমাজকে সচেতন করার এবং স্বাধীনতা আন্দোলনকে একটি গণ আন্দোলনে রূপান্তরিত করতে সাহায্য করেছিল. যার কারণে লোকমান্য উপাধিটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে তার নামের আগে জুরে গিয়েছিল।
তিলকের আগে লোকেরা ‘গীতা’ র সন্ন্যাস ভাব জানত। কিন্তু কারাগারে থাকাকালীন তিলক জি ‘গীতা রহস্য’ লিখেছিলেন এবং গীতার ভিতরে কর্মযোগকে লোকের কাছে নিয়ে এসেছিলেন।তার গীতা রহস্য আজও মানুষকে প্রদর্শকের মত পথ দেখিয়ে চলেছেন। তিলক প্রায় ৬০০ পৃষ্ঠা জুড়ে গীতা রহস্যের ভূমিকা রচনা করেছিলেন। যাকে ব্যাখ্যা করতে দর্শন পড়ুয়াদের ঘাম ছুটে যেত।
নিজের ভাষা এবং সংস্কৃতির প্রতি লোকমান্য বাল গঙ্গাধর তিলকের যে আগ্রহ ছিল সেগুলিকে মোদী সরকারের নতুন শিক্ষানীতিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তিনি বিশ্বাস করতেন যে প্রতিটি শিশুর প্রাথমিক শিক্ষা তার মাতৃভাষায় হওয়া উচিত।এখন তা দেশে হতে চলেছে। লোকমান্য তিলক ছিলেন বহুমুখী ব্যক্তিত্বের অধিকারী। চিন্তাবিদ, দার্শনিক, সফল সাংবাদিক এবং সমাজ সংস্কারক সহ বহুমুখী ব্যক্তিত্বের প্রতীক। ভারত, ভারতীয় সংস্কৃতি এবং ভারতীয় জনগণকে বুঝে চলা লোকমান্য তিলক আজও সমান ভাবে প্রাসঙ্গিক। দেশের প্রতিটি নাগরিককে বুঝতে হবে যে তিলকের ধারণাগুলি থেকে সরে এসে দেশের ভবিষ্যত কখনই উজ্জ্বল হতে পারে না। আপনি যদি ভারত ও ভারতের গৌরবময় ইতিহাস জানতে চান, তবে বাল গঙ্গাধর তিলককে বারবার পড়তে হবে। তিলেক জির দুর্দান্ত ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে যখনই কিছু নতুন জ্ঞান পাওয়া যাবে এবং তাঁর কাছ থেকে অনুপ্রেরণা গ্রহণ করবে তরুণ প্রজন্ম। তখনই তারা নতুন উচ্চতায় পৌঁছতে সক্ষম হবে। লোকমান্য তিলকও ছিলেন নির্ভীক সাংবাদিক।”কেসারি” পত্রিকায় তিনি “দেশের দুর্ভাগ্য” শীর্ষক একটি প্রেরণামূলক নিবন্ধ লিখেছিলেন যাতে তিনি ব্রিটিশ সরকারের নীতিগুলির তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। ১৮৯৭ সালের ২৭ জুলাই তাকে ভারতীয় দণ্ডবিধির ধারা ১২৪-এ এর অধীনে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তিনি মন্ডলে (বার্মা) ৬ বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদন্ডে বন্দী ছিলেন। আমি নিজেকে ধন্য মনে করি যে আমি ১৯৮৬ সালে সেই কারাগারটি পরিদর্শন করেছি, তবে কারাগারে কঠোর জীবন যাপন করার পরেও তার দৃষ্টিভঙ্গি বিভ্রান্ত হয়নি। কারাগারে লোকমান্য তিলক কয়েকটি বইয়ের দাবি করেছিলেন, কিন্তু ব্রিটিশ সরকার তাকে রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপযুক্ত এমন কোনও চিঠি লিখতে নিষেধ করেছিল।লোকমান্য তিলকও কারাগারে একটি বই লিখেছিলেন।কারাবাসের মেয়াদ শেষ হওয়ার অল্প সময়ের আগেই বালগঙ্গাধর তিলকের স্ত্রী মারা যান। কারাগারে পাওয়া একটি চিঠি থেকে তিনি এই দুঃখজনক সংবাদটি জানতে পেরেছিলেন।লোকমান্য তিলক স্ত্রীর শেষ মুখ দেখতে পেল না।তিলকের জীবন সর্বদা দেশকে পথ দেখায়।তার দেখানো চিন্তাভাবনা থেকে বিচ্যুত হওয়ার অর্থ এই হবে যে দেশটিকে তার নিজের পথ থেকে সরে এসেছে। হিন্দুস্থান সমাচার
(লেখক রাজ্যসভার প্রাক্তন সাংসদ)