ভারতকে উপেক্ষা করতে পারে না ইরান

আর কে সিনহা

ভারতের সবথেকে পুরানো ও বিশ্বস্ত বন্ধু ইরান আমাদের একটা জোরালো ধাক্কা দিয়েছে। এটা হয়তো কেউ কখনও ভাবেননি, ইরান ভারতকে চাহবহার-জাহেদান রেল প্রকল্প থেকে পৃথক করবে। এই প্রকল্পে ভারতের অংশীদারিত্ব শেষ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইরান। এছাড়াও সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাদের উচ্চভিলাষী প্রকল্প চিনের সহায়তায় সমাপ্ত করবে। ইরান কার্যত ভারতের কাঁটা ঘায়ে নুনের ছেঁটা দিচ্ছে। সবারই জানা এই মুহূর্তে ভারত-চিন সম্পর্ক রীতিমতো তলানিতে ঠেকেছে। ভারত-চিনের মধ্যে সীমান্তে সংঘর্ষও হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে ভারতের বন্ধু ইরানের এই চিন্তাভাবনা যথেষ্ট উদ্বেগজনক। এবিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে ভারতকে সঙ্গে সঙ্গে ইরানের সঙ্গে কথা বলতে হবে। আমরা ইরানকে দূরে যেতে দিতে পারি না। আমাদের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ালে ইরানেরও খুব ভালো হবে না। আসলে ২০১৬ সালে ভারত ও ইরানের মধ্যে একটি চুক্তি হয়েছিল, ওই চুক্তি অনুযায়ী ইরানে ৬০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করার কথা ভারতের। এখন চিন আগামী ২০ বছরে ইরানে ৩০ লক্ষ কোটি টাকা বিনিয়োগ করার পরিকল্পনা করেছে। এখন এই রেল প্রকল্প চিনের সহায়তায় সম্পন্ন হবে।

আর কে সিনহা

এখন প্রশ্ন উঠছে চিন কী কারণে ভারতের সঙ্গে অংশীদারিত্ব শেষ করেছে? ইরানের মতে, ভারত থেকে অর্থায়নে বিলম্ব হচ্ছে। তাই বাধ্য হয়েই এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এবার ভারতকে তো জবাব দিতেই হবে। তবে মনে করা হচ্ছে সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব অমিরশাহীর ভারতে প্রস্তাবিত ৩ লক্ষ কোটি টাকার বিনিয়োগের কারণেই ভারতের থেকে দূরে সরেছে ইরান। ইরানের চরম শত্রু হল সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব অমিরশাহী। যদিও তিনটি দেশই ইসলামিক রাষ্ট্র। প্রত্যেকের স্বার্থ তো ভিন্ন হয়। ভারত ও ইরানের মধ্যে ৪ বছর আগে চাবহার বন্দর থেকে আফগানিস্তান সীমান্তে জাহেদান পর্যন্ত রেললাইন বসানো সংক্রান্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি হয়েছিল। এখন ইরান নিজেই এই রেল প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, বলা হচ্ছে ৬২৮ কিলোমিটার লম্বা রেলপথে রেললাইন বসানোর কাজও শুরু হয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ ভারতের প্রতি ক্ষুব্ধ মনে হচ্ছে। নাহলে এত বড় সিদ্ধান্ত তাঁরা কীভাবে নিয়ে ফেলল। ২০২২ সালের মধ্যেই এই রেল প্রকল্পকে সম্পন্ন করতে চাইছে ইরান। ভারতের কাছে এই প্রকল্প বিশেষ কারণ, এই প্রকল্পের মাধ্যমে ইরান এবং আফগানিস্তানের সঙ্গে মিলিত হয়ে একটি আন্তর্জাতিক যাতায়াত পথ তৈরি করতে চাইছে ভারত। ভারতের এই উদ্দেশ্যে নিয়ে পাকিস্তান উদ্বিগ্ন। এক্ষেত্রে ভারতকে অবশ্যই সচেষ্ট হতে হবে, এর সঙ্গে ভারতের খ্যাতি জড়িত রয়েছে। ইরান সর্বদাই ভারতের অত্যন্ত ভালো বন্ধু দেশ ছিল। ইরান শুধুমাত্র তেলের একটি বড় বাণিজ্যিক কেন্দ্রই নয়, বরং সমগ্র এশিয়া, রাশিয়া তথা পূর্ব ইউরোপ আসা-যাওয়ার অন্যতম যাতায়াত পথ। ভারত এ সব বিষয়ে অবগত। কিন্তু দুর্বল বিদেশ নীতির কারণে গত কয়েক দশকে কোনও অর্থবহ উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও উদ্বিগ্ন, তিনি নিজেও ইরান সফরে গিয়েছেন।

প্রধানমন্ত্রী ওই সফরে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নত হয়েছিল।বলার অপেক্ষা রাখে না যে, শক্তিতে সমৃদ্ধ ইরানের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি নতুন অধ্যায় লেখার চেষ্টা করছে ভারত। প্রধানমন্ত্রীর সফরে এই বার্তাও পেয়েছিল ইরান। কিন্তু, আচমকা কী এমন হল যে ভারতকে কূটনৈতিক ভাবে ধাক্কা দিল ইরান। প্রতিটি কঠিন পরিস্থিতিতেই ভারতের পাশে ছিল ইরান। ইরানের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে বিচক্ষণতার সঙ্গে এগোতে হবে ভারতকে। ইরানকে কোনও ভাবেই উপেক্ষা করা উচিত নয় ভারতের। এটাও সঠিক যে আগেও ভারত ও ইরানের মধ্যে মতপার্থক্য ও ভ্রান্ত ধারণা তৈরি হয়েছিল। যাইহোক প্রধানমন্ত্রীর সফরের পর পুরানো মতপার্থক্য দূর হয়েছে। ইরান সফরে গিয়ে সেখানকার সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আল খোমেনির সঙ্গে দেখা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। সেই সময় মনে হয়েছিল ভারত-ইরান সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। ভারত ও আমেরিকার মধ্যে ২০০৮ সালে হওয়া পারমাণবিক চুক্তির পর ইরানের সঙ্গে অনেক প্রকল্প হয়েছিল, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং সরকার হয়তো সেগুলি বাতিল করে দিয়েছিলেন অথবা ঠাণ্ডা বস্তায় ভরে দিয়েছিলেন।

ইরানের উপর নিষেধাজ্ঞার কারণে ভারতীয় কোম্পানিও ইরানে বিনিয়োগ করা থেকে বিরত থাকে। প্রতিবন্ধকতা উঠে যাওয়ার পর ভারতীয় কোম্পানি সেখানে বিনিয়োগ করছে। ভারতকে ভাবতে হবে সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহীর সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি ইরানকে যেন উপেক্ষা না করে।শিয়া দেশ ইরান এটাও জানে না ভারতে শিয়া মুসলিমদের সঙ্গে কোনও বৈষম্য করা হয় না। ভারতে শিয়া মুসলিমদের তাঁদের যোগ্যতা এবং অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখা হয়। ইরান এটাও জানে পাকিস্তানে শিয়া মুসলিমদের সঙ্গে অকথ্য অত্যাচার করা হয়। ইরানও সম্ভবত ভারতকে এই কারণেই গুরুত্ব দেয়। ইরান তো দিল্লিতে একটি ইরানি স্কুলও চালায়। কিছু কিছু দেশেই ইরানি স্কুল রয়েছে। ইরানি স্কুলের ভিতরে গেলে দেখতে পারবেন ফার্সি ভাষাতেই উদ্ধৃতি লেখা রয়েছে। ওই স্কুলে দিল্লিতে বসবাসকারী ইরানি দূতাবাসের কর্মীদের সন্তানরাও ভর্তি হতে পারে। দিল্লিতে প্রায় ৬০০ ইরানি পরিবার রয়েছে। তাঁদের মধ্যে কূটনীতিক, অ-কূটনীতিক, পরিবার ও শিক্ষার্থী রয়েছে। দিল্লিতে ইরানি সংস্কৃতিক কেন্দ্রও রয়েছে। এটা পরিষ্কার যে এখনও পর্যন্ত ভারতের সঙ্গে নিজেদের সম্পর্কে গুরুত্ব দিয়েছে ইরান। তাহলে ইরানকে এখন অন্যরকম লাগছে কেন? কারণ খুঁজে বার করা দরকার এবং সমাধানও করতে হবে।

(লেখক প্রবীণ সম্পাদক, কলামিস্ট এবং প্রাক্তন সাংসদ)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *