BRAKING NEWS

লকডাউনে সামগ্রিক এই ব্যর্থতার দায় কেন্দ্রীয় সরকারের, সর্বদল প্রস্তাবের আর্জি সিপিএমের

কলকাতা, ২৪ জুন (হি. স.) : “চার ঘণ্টার নোটিশে বিশ্বের সবচেয়ে কড়া লকডাউন – এককথায় গরিব মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা। অপরিকল্পিত লকডাউন এবং পরিকল্পনাহীন আনলক মানুষের বিপদ বাড়িয়েছে। সামগ্রিক এই ব্যর্থতার দায় কেন্দ্রীয় সরকারকে নিতে হবে।“ এই মন্তব্য করে সার্বিকভাবে এবিষয়ে একটি প্রস্তাব সর্বদলীয় সভা থেকে গ্রহণ করে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে পাঠাতে আবেদন করল সিপিএম। বুধবার এই  মর্মে আবেদন করে একটি স্মারলিপি দলের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র দেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে।

স্মারকলিপিতে আটটি ভাগে মোট ২৭টি বিষয়ের উল্লেখ করা হয়েছে।  সূর্যবাবু লিখেছেন, “করোনা সংক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে আহুত ২৩ মার্চ, ২০২০ এর সর্বনদলীয় সভার তিন মাস পর এটি দ্বিতীয় সভা। বিগত সর্বদলীয় সভার পর আজও পর্যন্ত জেলা, ব্লক বা পৌরসভা ভিত্তিতে সর্বদলীয় সভা আহূত হয়নি – এটা গণতন্ত্রসম্মত মনোভাবের পরিচায়ক নয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রতিটি স্তরে সর্বদলীয় সভা আহ্বানের জন্য আমরা আবারও দাবি জানাচ্ছি।

উদ্ভুত পরিস্থিতিতে আমরা বরাবরের মতই সদর্থক মনোভাব নিয়ে চলতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। একই সাথে আমরা দাবি করি, সরকারের প্রতিটি পদক্ষেপে গণতান্ত্রিক বোধ এবং স্বচ্ছতা স্পষ্ট করতে হবে।

১. ২৩  মার্চ ২০২০ আহুত সর্বদলীয় সভায় চিকিৎসা, মানুষের খাদ্য ও অর্থের যোগান, দেশ ও রাজ্যের বিভিন্ন  এলাকায়  আটকে  থাকা মানুষ, রাজ্যের  জন্য  অর্থসংস্থান  ইত্যাদি বিষয়ে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব-পরামর্শ  আমরা  উত্থাপন করেছি। তা কতটা কার্যকরী  হয়েছে সে বিষয়ে রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রকাশ করা জরুরী।  

ক) করোনা পরিস্থিতিতে রাজ্যের চিকিৎসাব্যবস্থা কার্যত বিপর্যস্ত হয়েছে। এ সংক্রান্ত বহু অভিযোগ জনসমক্ষে প্রকাশিত হয়েছে। বিগত সভায় আলোচিত ‘ফিভার ক্লিনিক’, সাধারণ চিকিৎসার সাথে করোনা চিকিৎসার ব্যবস্থাপনার পৃথকীকরণ, পরিসংখ্যান এবং সঠিক তথ্যের আদান-প্রদান, বেসরকারি চিকিৎসা কেন্দ্রের খরচ ইত্যাদি বিষয়ক প্রস্তাব কার্যকরী না হওয়ায় মানুষের বিপদ বেড়েছে। করোনা আক্রান্ত মানুষ যেমন ঠিকমতো চিকিৎসা পায়নি, তেমনি মা ও শিশু, ডায়ালিসিস, কর্কট-সহ নানা রোগাক্রান্ত  মানুষের  বহু সাধারণ চিকিৎসা কার্যক্রম  ব্যাহত হয়েছে। জেলাগুলিতে এবং বিশেষত উত্তরবঙ্গের জেলাগুলির চিকিৎসা পরিষেবার হাল খুবই খারাপ থেকেছে। চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ সহ অন্যান্যদের নিরাপত্তার বিষয়টি খুবই অবহেলিত থেকেছে। ‘কোয়ারান্টাইন কেন্দ্রের’ নামে চূড়ান্ত অব্যবস্থা, তাতে বিপদ আরও বেড়েছে। এছাড়াও তথ্য বিভ্রান্তি, তথ্য গোপনের নানা অভিযোগ, যা মানুষের ভরসাকে ক্রমশ দুর্বল করেছে।

খ) খাদ্য সুরক্ষা আইনের মূল মর্মবস্তুকেই রাজ্যে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। খাদ্যের অধিকারকে অস্বীকার করা হয়েছে। কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের ঘোষণা মোতাবেক মাসিক মাথাপিছু ৫+৫=১০ কেজি চাল এবং পরিবারপিছু ১+১=২ কেজি ডাল এ’রাজ্যের একজন মানুষও পাননি। ইতিমধ্যে তিন মাস অতিক্রান্ত। অসংখ্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, সংস্থা, ক্লাব কিংবা সংবেদনশীল ছাত্র-যুবরাই বস্তুতপক্ষে বিপর্যস্ত মানুষের ভরসা যুগিয়েছে। শাসকদলের চোখরাঙানি অথবা নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেই এরা ত্রাণের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।

গ) ভিন রাজ্যে কর্মরত শ্রমিকদের জন্য কিংবা রাজ্যে অসংগঠিত ক্ষেত্রের মানুষদের জন্য সরকার প্রকল্প ঘোষণা করলেও, বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে প্রকল্পের সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।

ঘ) করোনা পরিস্থিতিতে মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়েছে। কৃষক, খেতমজুর, গরীব মানুষ অসহায়তার শিকার। শ্রমজীবী জনগণ, ছোট দোকান, ব্যবসা, স্বনিযুক্তিতে যুক্ত মানুষ, অস্থায়ী-চুক্তিভিত্তিক কর্মী, নানা ধরনের হস্তশিল্পী ইত্যাদি বিভিন্ন অংশের মানুষের আর্থিক দুরবস্থা প্রবল। গরিব নিম্নবিত্ত তো বটেই, মধ্যবিত্ত মানুষের একটা বিশাল অংশ বিপর্যস্ত হয়েছেন। তার উপর সীমাহীন মূল্য বৃদ্ধি, পরিবহনের অব্যবস্থা এবং খরচ ইত্যাদি অসম্ভব বেড়েছে। অসহায় সাধারণ মানুষ। সরকারের ভ্রূক্ষেপ নেই।

ঙ) এমত অবস্থায় অন্য নানাবিধ বিষয়ের সাথে মানুষ দাবি করছেন গণবণ্টন ব্যবস্থার মাধ্যমে বিনামূল্যে মাস্ক, সাবান এবং স্যানিটাইজার সরবরাহের। দাবি করেছেন লকডাউনের সময়কালে ২০০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুতের দাম ছাড় দেওয়ার। সরকারের এ বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা জরুরি।  

২.  করোনা সংক্রমণের মধ্যে রাজ্যে বাড়তি সংকট তৈরি করেছে আমফান বিপর্যয়।

ক) আমরা প্রথমেই আমফানকে জাতীয় বিপর্যয় হিসাবে ঘোষণার দাবি করেছি যা কেন্দ্রীয় সরকার এখনো পর্যন্ত মান্যতা দেয়নি।

খ) রাজ্য সরকারের চূড়ান্ত ব্যর্থতা সত্ত্বেও রাজ্যের বিভিন্ন সংগঠন, সংস্থাসহ সাধারণ মানুষ যেভাবে দুর্গত মানুষের পাশে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন – তা যথেষ্ট অভিনন্দনযোগ্য।

গ) বিপর্যয় মোকাবিলায় এবং পুনর্গঠনের কাজে সরকারের চূড়ান্ত গাফিলতি এবং ব্যর্থতায় মানুষ স্বাভাবিকভাবেই ক্ষুব্ধ।  

ঘ) বিপর্যস্ত মানুষের গৃহনির্মাণ এবং মেরামতি, চাষের ক্ষতিপূরণ, ত্রাণ সহ প্রতিটি ক্ষেত্রেই নজিরবিহীন লুঠ এবং দলবাজি স্পষ্ট হয়েছে। শেষমেষ পুলিশ, প্রশাসনের কাছে অভিযোগ জানানোর ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু এক্ষেত্রেও অভিযোগ অথবা দাবি ঠিকমতো লিপিবদ্ধ করা হচ্ছে না।

ঙ) ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা এবং ক্ষতিপূরণের পরিমাণ এলাকাগতভাবে প্রকাশ করার দাবি যুক্তিসঙ্গত। এই তালিকা প্রকাশ্যে টাঙাতে হবে এবং ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে হবে।

চ) সরকারী আবাস প্রকল্পগুলিতে পাকা ছাদের বাড়ির সঠিক দাবি কার্যকর করতে হবে।

ছ) আয়লা বাঁধ সহ সুন্দরবনের নদী এলাকায় পাকা বাঁধের ব্যবস্থা করতে হবে।  

জ) আমফানে ক্ষতির পরিমাণ নিয়ে রাজ্য সরকার বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরনের তথ্য প্রকাশ করে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। বাস্তবসম্মতভাবে ক্ষতির প্রকৃত তথ্য স্থির করা একান্ত জরুরি।

ঝ) প্রধানমন্ত্রী এবং কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি দল রাজ্যে ঘুরে যাওয়ার পরে এখনো পর্যন্ত আর কোন অর্থ বরাদ্দ হলো না – এ বিষয়ে রাজ্যবাসীর ক্ষোভ সঙ্গত। জাতীয় বিপর্যয় ঘোষণা করে দ্রুত অর্থসংস্থানের দাবি রাজ্যের সার্বিক দাবি হিসেবে বিবেচিত হওয়া দরকার।

৩. করোনা পরিস্থিতির মধ্যেই ডেঙ্গু সম্ভাবনা বাড়ছে বলেই বিশেষজ্ঞদের অভিমত। অবিলম্বে এ বিষয়ে সর্তকতা জরুরী। আমফান পরবর্তী সময়ে কলকাতা সহ বিভিন্ন জায়গায় রাস্তাঘাট, গাছপালা, জমাজল এখনও পরিষ্কার করা হয়নি। এতে বিপদের সমূহ সম্ভাবনা। তথ্য গোপন না করে, বরং মানুষকে সচেতন করা ও চিকিৎসা পরিকাঠামোকে শক্তিশালী করেই ডেঙ্গু মোকাবিলায় আমাদের দ্রুত প্রস্তুত হতে হবে।

৪. করোনা আবহে শিক্ষার পরিবেশ খুবই ব্যাহত হয়েছে। পরীক্ষার অনিশ্চয়তা, অনলাইন শিক্ষার সীমাবদ্ধতা, বিভিন্ন বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ফি বৃদ্ধি সহ নানাবিধ চাপে পড়ুয়া, শিক্ষক এবং অভিভাবকেরা জেরবার। মুখ্যমন্ত্রীর পূর্বঘোষণা অনুযায়ী সরকারকে এক্ষেত্রে স্পষ্ট ভূমিকা নিতে হবে।

৫. করোনা আবহে কর্মসংস্থান সংক্রান্ত নানাবিধ সমস্যা ক্রমশই বাড়ছে। প্যানেল থাকা সত্ত্বেও নিয়োগ হচ্ছে না। বরং কোন কোন ক্ষেত্রে কর্মচ্যুতি ঘটছে। বহু ক্ষেত্রেই অস্থায়ী চুক্তিভিত্তিক কর্মীদের প্রাপ্য দেওয়া হচ্ছে না। যুবকের কর্মসংস্থান, জীবিকা, কাজ এসব বিষয়ে রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে অবশ্যই  ইতিবাচক ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে।  

৬. করোনা পরিস্থিতিতে, আন্তর্জাতিক বাজারে পেট্রোপণ্যের দাম কম থাকা সত্ত্বেও, দেশে এবং রাজ্যে পেট্রোল-ডিজেলের দাম বেড়েই চলেছে। এক্সাইজ ডিউটি এবং শুল্ক ক্রমশ: বৃদ্ধি করার মধ্য দিয়ে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার উভয়েই লাভের পরিমাণ যেভাবে বাড়াচ্ছে এবং তার বোঝা মানুষের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে, তা কখনো মেনে নেওয়া যায় না।

৭. একইভাবে প্রধানমন্ত্রী গরীব কল্যাণ যোজনা প্রকল্পে যেভাবে এরাজ্যে ফিরে আসা শ্রমিকদের বিরুদ্ধে বঞ্চণা করা হচ্ছে, রাজ্যের পক্ষ থেকে সার্বিকভাবেই তার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করা জরুরি। রাজ্যকেও এবিষয়ে তথ্য-পরিসংখ্যান স্পষ্ট করতে হবে।  

৮. সমগ্রভাবে করোনা পরিপ্রেক্ষিতে সারাদেশ এক ঐক্যবদ্ধ মনোভাব নিয়ে চলেছে। এটাই স্বাভাবিক। সার্বিক বিবেচনায় মূলগত বিষয়ে – কেন্দ্রীয় স্তরেই সিদ্ধান্ত ঘোষিত হচ্ছে। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে কতগুলো গুরুতর যে গাফিলতি দেখা যাচ্ছে, তার বিরুদ্ধে রাজ্যের সার্বিক প্রতিবাদ ধ্বনিত করতে হবে।

ক) করোনা মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় সরকার কুড়ি লক্ষ কোটি টাকার প্রকল্প ঘোষণা করলেও তা বস্তুতপক্ষে তথ্যের কারসাজি।

খ) যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর বিবেচনায় করোনা মোকাবিলায় রাজ্যগুলিকে আর্থিক সহায়তার কোনো সুস্পষ্ট নীতি কেন্দ্রীয় সরকার এখনও গ্রহণ করেনি।

গ) আয়করের আওতার বাইরে যাঁরা আছেন তাঁদের মাসিক সাড়ে সাত হাজার টাকা করে অর্থ সাহায্য করা এবং তার মধ্য দিয়ে চাহিদা বৃদ্ধি ও দেশের অর্থনৈতিক বাজার এবং কর্মকান্ডকে শক্তিশালী করার কোনো পরিকল্পনা এখনো দেখা যাচ্ছে না।

ঘ) জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা আইনের বস্তুগত উপাদানকে কার্যকরী করা এবং মাথাপিছু ১০ কেজি খাদ্যের সংস্থান – এরকম কোন লক্ষণ এখনো দেখা যাচ্ছে না।

ঙ) করোনা আবহের সুযোগ নিয়ে বিলগ্নীকরণ, বেসরকারিকরণ সহ উদার অর্থনৈতিক নানাবিধ কর্মকান্ড দ্রুততর করে সরকার ক্রমশ: জনবিরোধী এবং স্বেচ্ছাচারী অবস্থানকে শক্তিশালী করছে। এটা বিপদজনক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *