নয়াদিল্লি, ২০ মার্চ (হি.স.): দীর্ঘ সাত বছরের প্রতীক্ষার অবসান। প্রতীক্ষায় ছিলেন নির্ভয়ার বাবা-মা, দিন গুনছিল গোটা দেশ। অবশেষে এল প্রতীক্ষিত সেই দিন, ফাঁসি হয়ে গেল ২০১২ দিল্লি গণধর্ষণ মামলার চার অপরাধীর। গত ৫ মার্চের মৃত্যু পরোয়ানা অনুযায়ী, শুক্রবার সকাল ৫.৩০ মিনিট নাগাদ ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে নির্ভয়ার চার অপরাধী-মুকেশ কুমার সিং (৩২), পবন গুপ্তা (২৫), বিনয় কুমার শর্মা (২৬) এবং অক্ষয় কুমারকে (৩১)। তিহাড় জেল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, শুক্রবার সকাল ৫.৩০ মিনিট নাগাদ ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে ২০১২ দিল্লি গণধর্ষণ মামলার চার অপরাধীকে। তিহাড় জেলের ডিরেক্টর জেনারেল সন্দীপ গোয়েল জানিয়েছেন, ফাঁসিতে ঝোলানোর পর আধঘন্টা ঝুলিয়ে রাখা হয় চার অপরাধীকে। পরে চিকিৎসক চার অপরাধীকে মৃত বলে ঘোষণা করেন।
২০১২ সালের ১৬ ডিসেম্বর রাতে, রাজধানী দিল্লির রাস্তায় চলন্ত বাসের মধ্যে গণধর্ষণ এবং ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হন প্যারামেডিক্যালের ছাত্রী, বছর ২৩-এর তরুণী ‘নির্ভয়া’। বাধা দিতে গিয়ে প্রচণ্ড মারধর খেতে হয় তাঁর পুরুষ সঙ্গীকেও। পাশবিক অত্যাচারে শিউরে উঠেছিল গোটা দেশ। শেষ পর্যন্ত বাঁচানো যায়নি নির্ভয়াকে। নির্মম অত্যাচারের ১৩ দিন পর, ২৯ ডিসেম্বর তাঁর মৃত্যু হয়। ঘটনার কয়েক দিনের মধ্যেই, দিল্লি পুলিশের হাতে একে একে ধরা পড়ে বাস চালক রাম সিং, মুকেশ সিং (রাম সিংয়ের ভাই), বিনয় শর্মা, পবন গুপ্তা, অক্ষয় কুমার এবং এক নাবালক। শুরু হয় জিজ্ঞাসাবাদ।
নির্ভয়া মামলায় দ্রুত বিচারের জন্য তৈরি হয় ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট। ২০১৩ সালের, ১০ সেপ্টেম্বর ধৃত ছ’জনকে দোষী সাব্যস্ত করেন ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টের বিচারক যোগেশ খন্না। তার আগেই, ১১ মার্চ জেলে আত্মহত্যা করে অন্যতম আসামী রাম সিং আর আগস্টে জুভেনাইল কোর্ট তিন বছরের সাজা দেয় নাবালক অপরাধীকে। নাবালক হওয়ায়, তিন বছর হোমে থেকেই সাজার মেয়াদ শেষ করে, ২০১৫ সালে মুক্তি মেলে ওই অভিযুক্তের। ২০১৩ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর চার সাবালক অপরাধীকে ফাঁসিতে ঝোলানোর নির্দেশ দেন ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টের বিচারক। অপরাধীরা ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টের রায়কে চ্যালেঞ্জ করে দিল্লি হাইকোর্টে সাজা কমানোর আর্জি জানায়। ২০১৪ সালের ১৩ মার্চ দিল্লি হাইকোর্ট অপরাধীদের আর্জি খারিজ করে মৃত্যুদণ্ডের আদেশই বহাল রাখে।
এর পর, দোষীদের মধ্যে তিন জন— মুকেশ সিং, বিনয় শর্মা ও পবন গুপ্তা— ফাঁসির সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন করার আর্জি জানিয়েছিল সুপ্রিম কোর্টেও। কিন্তু ২০১৮ সালের ৯ জুলাই তৎকালীন প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বেঞ্চ সেই আর্জি খারিজ করে দেয়। বিনয় রাষ্ট্রপতির কাছেও প্রাণভিক্ষার আবেদন জানিয়েছিল। দীর্ঘ কৌশলের পর, চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি দিল্লির পাটিয়ালা হাউজ কোর্ট রায় দেয়, ২২ জানুয়ারি সকাল ৭টায় ফাঁসি দেওয়া হবে চার জনকে। এর পর ক্ষমাভিক্ষা চায় বিনয় এবং মুকেশ। সে আবেদনও খারিজ হয়ে যায়। এর পর ফের রায় সংশোধনের আর্জি জানায় দু’জন। বিনয় দাবি করে, ঘটনার সময় সে নাবালক ছিল। কিন্তু সেই আবেদনও খারিজ হয় শীর্ষ আদালতে।
এর পর দিল্লির পাটিয়ালা হাউজ কোর্ট জানিয়ে দেয়, চার জনের ফাঁসি হবে ১ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু, ফাঁসি পিছতে এর পরেও আইনি কৌশল থামায়নি অপরাধীরা। শেষ পর্যন্ত ফাঁসির দিন ধার্য হয় ৩ মার্চ। এর মাঝে রায় সংশোধনের আর্জি জানায় পবন। ২ মার্চ তা খারিজ করে সুপ্রিম কোর্ট। ওই দিনই রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আর্জি করে পবন। এর জেরে ফের স্থগিত হয়ে যায় ফাঁসি। রাষ্ট্রপতি পবনের প্রাণ ভিক্ষার আর্জি খারিজ করে দেওয়ার পর, চতুর্থ বারের জন্য মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে আদালত।
দিল্লির পটিয়ালা কোর্ট জানিয়ে দেয়, ২০ মার্চ ফাঁসি দেওয়া হবে চার জনকে। এর পরও ফাঁসি রদ বা পিছনোর চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন অপরাধীদের আইনজীবীরা। সুপ্রিম কোর্টে যেমন নতুন আবেদন করা হয়েছে, তেমনই আবেদন করা হয়েছে আন্তর্জাতিক ন্যায় আদালতেও। অবশেষে কোনও আইনি কৌশলই কাজে লাগেনি। দীর্ঘ সাত বছর পর ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে নির্ভয়ার চার অপরাধীকে। এদিন সকালেই এম্বুলেন্স করে নির্ভয়ার অপরাধীদের দেহ ময়নাতদন্তের জন্য ডি ডি ইউ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ময়নাতদন্তের পর দেহগুলি তাঁদের পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হবে।

