কলকাতা, ৯ জুলাই (হি.স.): বিধাননগরের মেয়র সব্যসাচী দত্তর বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব জমা পড়ল মঙ্গলবার । ৩৫ জন কাউন্সিলর সেই প্রস্তাবে সই করেছেন বলে জানিয়েছেন বিধাননগর পুরসভার চেয়ারপার্সন কৃষ্ণা চক্রবর্তী । বিধাননগরের ডেপুটি মেয়র তাপস চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছেন, ‘দল বিরোধী কার্যকলাপের পাশাপাশি প্রশাসনিক ব্যর্থতার অভিযোগ রয়েছে মেয়রের বিরুদ্ধে । উনি ব্যক্তিগত আক্রমণ করা শুরু করেছেন । ওর জন্য দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে বিব্রত হতে হচ্ছে’।
কাউন্সিলরদের অনাস্থা পত্রে সই প্রসঙ্গে সব্যসাচী দত্ত বলেন, ‘৩৫ জন সই করেছে, বাকিরাও করবে । আমি তো ভেবেছিলাম ৪০ জনই করবে’। এই প্রসঙ্গে মঙ্গলবার দিল্লিতে মুকুল রায় বলেন, ‘ভাটপাড়া পুরসভায় অনাস্থা এনেছিল তৃণমূল । সেক্ষেত্রে হেরে ছিল । এক্ষেত্রেও তাই হবে ।১৮ জুলাই অনাস্থার ভোটাভুটির দিন ধার্য হয়েছে বলে জানা গেছে ।
মঙ্গলবার ৩৫ জন কাউন্সিলরের সই করা অনাস্থা প্রস্তাব কৃষ্ণা চক্রবর্তী জমা দেন পুরসভার যুগ্ম কমিশনারকে । অনাস্থা প্রস্তাবের চিঠি সিল করে ডকেট নাম্বার দিয়ে যুগ্ম কমিশনারের কাছে জমা দেওয়া হয় । অনাস্থা প্রস্তাব পেশ প্রসঙ্গে চেয়ারপার্সন কৃষ্ণা চক্রবর্তী বলেন, ‘অনাস্থায় যাচ্ছি আমরা । অনাস্থা প্রস্তাব পেশ করেছেন ডেপুটি মেয়র । অনাস্থা পত্র জয়েন্ট কমিশনারকে পাঠাব, যেহেতু কমিশনার এই মুহূর্তে নেই । আগামীকাল বিধাননগরের বোর্ড মিটিং রয়েছে । কিন্তু সেখানে এই অনাস্থা প্রস্তাব আনা হবে না বলেই জানিয়েছেন কৃষ্ণা চক্রবর্তী । পুর আইন ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘চিঠি জমা দেওয়ার পর অন্তত সাত দিন বাদে বোর্ড মিটিং করতে হয় । পরবর্তী যে প্রক্রিয়া তা কমিশনার এবং যুগ্ম কমিশনার করবেন’। এদিন তিনি বলেন, দল যাঁকে মেয়রের প্রার্থী করবেন, তিনি ভোটে লড়বেন । যাঁকে প্রার্থী করা হবে, তাঁকে নির্বাচিত করব আমরা । আমরা দলের সৈনিক’। আরও ২-৩ জন কাউন্সিলর এখনও অনাস্থা পত্রে সই করেননি বলে জানিয়েছেন বিধাননগর পুরসভার চেয়ারপার্সন কৃষ্ণা চক্রবর্তী । ১৮ জুলাই অনাস্থার ভোটাভুটির দিন ধার্য হয়েছে বলে জানা গেছে ।
বিধাননগর পুরসভায় মোট কাউন্সিলর ৪১ জন । এঁদের মধ্যে রয়েছেন ১ জন সিপিএম কাউন্সিলর ও ১ জন কংগ্রেস কাউন্সিলর । ৩৯ জন তৃণমূল কাউন্সিলরের মধ্যে একজন সব্যসাচী দত্ত নিজেই । অর্থাৎ সব্যসাচী দত্ত বাদে বিধাননগর পুরসভায় রয়েছেন ৩৮ জন তৃণমূল কাউন্সিলর । গত রবিবার তৃণমূল ভবনে পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের ডাকা বৈঠকে যোগ দিয়েছিলেন বিধাননগর পুরসভার ৩৬ জন কাউন্সিলর । ২ জন কাউন্সিলর সেই বৈঠক এড়িয়ে গিয়ে ছিলেন । রবিবার দুপুরে তৃণমূলের ৩৬ জন কাউন্সিলর সব্যসাচী দত্তর বিরুদ্ধে সর্বসম্মত প্রস্তাব গ্রহণ করেছিল । সেই বৈঠকে সব্যসাচী দত্তকে ডাকা হয়নি । তা ছাড়া বৈঠকের পর ফিরহাদ হাকিম বলেছিলেন, দল বিরোধী কাজের জন্য সব্যসাচীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে দলের শৃঙ্খলা রক্ষা কমিটি । সেই সঙ্গে তৃণমূলের তরফে জানানো হয়, বিধাননগর পুরসভার কাজও আপাতত ডেপুটি মেয়র তাপস চট্টোপাধ্যায় দেখবেন ।
এদিকে, গত কয়েকদিন ধরে বিধাননগর পুরসভার বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আজ পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম জানান, দল অনেক আগেই সব্যসাচীকে নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে চেয়েছিল । আক্ষেপের সুরে বলেন, ‘আমার স্নেহের বশে সব্যসাচীকে নিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়নি । দল আগেই তাঁর বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নিতে চেয়েছিল । এর জন্য আমি দায়ী । আমি অনেক পরে বুঝতে পারি দলের শৃঙ্খলার কাছে স্নেহের কোনও জায়গা নেই । আমি দলের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী’ ।
এদিন নির্দিষ্ট সময়ের বেশ কিছুক্ষণ পরই বিধাননগর পুর সভায় পৌঁছন সব্যসাচী দত্ত । সাংবাদিক বৈঠকে তিনি বলেন, ‘দায়িত্বে যতদিন থাকব, পুরসভায় আসব । তবে এখনই এবিষয়ে কিছু বলব না । আমার সঙ্গে কারোর কথা হয়নি’। একদিকে যখন চেয়ার পার্সনের ঘরে বসে অনাস্থা চিঠি জমা দেওয়ার তোড়জোড় চলছে, তখন মেয়রের চেম্বারে বসে সাংবাদিক সম্মেলন করে সব্যসাচী দত্ত বলেন, ‘আগে চিঠি আসুক তারপর দেখা যাবে । যা হবে পুর আইন অনুযায়ী । তার একটুও এদিক ওদিক হবে না । পুর আইন অনুযায়ী, অনাস্থা আনতেই পারে । অনাস্থা আনতে হলে এজেন্ডা অনুযায়ী মিটিং ডাকতে হবে । সেই চিঠি পেলে পরবর্তী পদক্ষেপ করব’ । সব্যসাচী দত্ত যে মেয়র পদ ছাড়তে নারাজ, সে ব্যাপারে এদিনও স্পষ্ট করেন তিনি । বিধাননগরের মেয়র বলেন, ‘যতদিন দায়িত্বে থাকব, ততদিন দায়িত্ব পালন করব’ । কাউন্সিলরদের অনাস্থা পত্রে সই প্রসঙ্গে সব্যসাচী বলেন, ‘৩৫ জন সই করেছে, বাকিরাও করবে । আমি তো ভেবেছিলাম ৪০ জনই করবে’। যদিও এই বিষয়ে আত্মবিশ্বাস দেখিয়েছেন মেয়র সব্যসাচী দত্ত ৷ তিনি জানান, ‘গোপন ব্যালটে ভোট হবে তো, দেখা যাক না কি হয় ৷ পাশাপাশি তিনি আরও বলেন, ‘যতদিন আমি দায়িত্বে থাকব কাজ করে যাব ৷ যদি অনাস্থায় হেরে যাই তবে কাউন্সিলর হয়ে কাজ করব’৷ তিনি বলেন, ‘এত তাড়াহুড়ার কী আছে, আগে আগে দেখুন না কী হয় ৷
তবে অনাস্থায় হেরে গেলেও ফিরহাদ হাকিমের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক থাকবে বলে স্পষ্ট জানিয়ে দেন সব্যসাচী দত্ত । বলেন, ‘ববিদা আমার দাদার মতন । আমার সঙ্গে ওঁর সম্পর্ক আগে যেমন ছিল, তেমনই থাকবে । আমার বাড়ির দরজা সব সময়ই ববিদার জন্য খোলা । তাঁর প্রতি সৌজন্য বজায় থাকবে ৷
পাশাপাশি তাঁর বিজেপি যোগের জল্পনাও উড়িয়ে দেন বিধাননগরের মেয়র ৷ বিজেপির তরফে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়নি বলে জানান তিনি ৷ মুকুল রায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ প্রসঙ্গেও আগের অবস্থানেই অনড় থাকেন ৷ সব্যসাচী দত্ত জানান, মুকুল রায় দাদার মতো ৷ সমস্যায় পড়েছি দেখে পরামর্শ দিতে এসেছিলেন’৷ তিনি বলেন, ‘দলের বিভিন্ন বিধায়ক, সাংসদদের সঙ্গে কথা হয়েছে’ । নেত্রীর সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে কিনা, এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘উনি ডাকলে নিশ্চয়ই কথা বলব। উনি ব্যস্ত, সময় পেলে যদি ডাকেন নিশ্চয়ই কথা বলব । ওঁকে রাজ্য সামলাতে হয়’।
এদিকে, সব্যসাচী দত্তর বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রসঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ বিজেপি নেতা মুকুল রায় মঙ্গলবার দিল্লিতে বলেন, ‘ভাটপাড়া পুরসভায় অনাস্থা এনেছিল তৃণমূল । সেক্ষেত্রে হেরে ছিল । এক্ষেত্রেও তাই হবে । ভোটাভুটি হলে দেখা যাবে তৃণমূল হারছে । ইলেকশন প্রসেসে ওরা অনাস্থা এনেছে । দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তাপস চট্টোপাধ্যায়কে । তাপস চট্টোপাধ্যায় কে ? রাজারহাট পৌরসভায় সিপিএমের চেয়ারম্যান । বহু দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত । নিজের বৈভব, বাড়ি, ঘর, দোর, বাঁচাতে ক্ষমতার সঙ্গে থাকতে পছন্দ করেন । বিজেপি ক্ষমতায় এলে তখন বিজেপিতে আসতে চাইবে’ । সব্যসাচী দত্তের বিজেপিতে যোগদান প্রসঙ্গে মুকুল রায় বলেন, ‘কেবল সময়ই বলতে পারবে যে তিনি বিজেপিতে যোগ দেবেন কি না । কিন্তু বড় ভাই হিসেবে আমি অবশ্যই তাঁর মঙ্গল চাইব’।
সব্যসাচী কি বিজেপিতে যোগ দিচ্ছেন ? প্রশ্নের উত্তরে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির অন্যতম সাধারন সম্পাদক রাহুল সিনহা বলেন, ‘সব্যসাচী এখনো বিজেপিতে যোগদানের ইচ্ছা প্রকাশ করেননি । আবেদন করলে দল ভেবে দেখবে’ । তবে ফিরহাদ হাকিমের ‘মিরজাফর’ মন্তব্যে বিধাননগরের মেয়রের পাশেই দাঁড়িয়েছেন রাহুল সিনহা । তিনি বলেন, ‘কবে ফিরহাদ নিজে মিরজাফর হয়ে যান তার নেই ঠিক’।