এনআরসি ঃ ফের অশান্তির আশংকা ত্রিপুরায়

৷৷ সন্দীপ বিশ্বাস৷৷ এনআরসি বা জাতীয় নাগরিক পঞ্জীকরণ ত্রিপুরাকে এক অশান্ত আগ্ণেয়গিরির দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, মনে করা ভুল হবে না বোধহয়৷ সাম্প্রদায়িকতার বিষবাস্প ছড়িয়ে পড়লে, জাতি-উপজাতির মধ্যে অবিশ্বাস আরো গাঢ় হবে৷ কারণ, এনআরসি’র মাধ্যমে যে অস্তিত্বকে প্রতিষ্ঠা করার প্রাণপণ লড়াই হবে৷ ভূমিপুত্র হিসেবে নিজেকে প্রমাণ দিতে গিয়ে আবারও ত্রিপুরা অশান্ত হবে না, সেই কথা জোর গলায় বলা সম্ভব হবে না বলেই মনে হচ্ছে৷

স্বাধীন ত্রিপুরা কিংবা ইনার লাইন পারমিট এখন অতীতের পাতায় ঠাঁই পেয়েছে৷ উপজাতি ভাবাবেগে প্রবল আঘাত করার মতো শ্লোগান ‘পৃথক তিপ্রাল্যান্ড’ও প্রত্যাখ্যাত হয়েছে৷ কিন্তু, এনআরসি জাতি-উপাজাতির ভাবাবেগে প্রবল ঢেউ তুলেছে৷ উপজাতি দরদের নামে সংকীর্ণ রাজনীতির নাগপাশ থেকে ত্রিপুরাকে মুক্ত করা কখনোই সম্ভব নয়৷ ভারতের এক প্রান্তে অবস্থিত এই পার্বতী রাজ্যে ১৯৮০ সালে জুনের দাঙ্গার ইতিহাস এখনো মানুষের স্মৃতি থেকে মুছে যায়নি৷  সেই ক্ষতে আজও মলম লাগানো সম্ভব হয়নি৷ তখন, লেম্বুছড়ায় আনারস বিক্রি নিয়ে জাতি-উপজাতির মধ্যে সংঘর্ষ মুহুর্তের মধ্যে ভয়াবহ রূপ নিয়ে নেয় গোটা রাজ্যে৷ শান্তির নিবিড় পরিবেশ মুহুর্তেই অশান্ত হয়ে পড়ে৷ পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌছেছিল, সেনা বাহিনীকে নামাতে হয়েছিল৷ রাজ্যের মানুষ আজও ভুলেনি, মান্দাইয়ে গণকবর দেওয়ার ঘটনা৷ জাতি-উপজাতি, আবাল বৃদ্ধ বনিতার সংহারের ঘটনা ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই পেলেও, ত্রিপুরায় আতংক ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, তা অস্বীকার করার হয়তো কোন উপায় নেই৷

সেদিন দরদ দেখাতে গিয়ে উপজাতিদের তাতানো হয়েছিল৷ অনুন্নয়নের তরজায় উগ্রপন্থা জন্ম নিয়েছিল৷ তবে, এর পেছনে সংকীর্ণ রাজনীতি ছিল৷ ত্রিপুরা বারে বারে অশান্ত হয়েছে৷ বৃটিশ ভারতকে নিংড়ে দিয়ে দেশ ছেড়েছে৷ ভারত স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৪৯ সালে ত্রিপুরার রিজেন্ট মহারাণী কাঞ্চনপ্রভা দেবী ভারতভুক্তিতে স্বাক্ষর করেন৷ দৈন্য দেশের ভাগিদার হওয়া ছাড়া ত্রিপুরার ঝুলিতে তেমন কিছুই মিলেনি তখন৷ ভৌগলিক দিক দিয়ে দেশের প্রান্তিক অংশে অবস্থিত হওয়ায় স্বাধীনতার ৭০ বছরেরও বেশী সময়ে মূলস্রোতে ফেরা সম্ভব হয়নি ত্রিপুরার৷ এর জন্য রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক ব্যর্থতাকে দায়ী করা হয়ে থাকে৷ কিন্তু, দীর্ঘ সময় ধরে অশান্তির কোলে বসবাসও যে  এর অন্যতম কারণ, সেকথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই৷

১৯৮০ সালের দাঙ্গা বাদ দিলেও এরাজ্যের সবচেয়ে বড় দূর্ভাগ্যের প্রধান বিষয় ছিল উগ্রপন্থা৷ টিএনভি, এটিটিএফ, এনএলএফটি সহ বহু উগ্রপন্থী সংগঠন এরাজ্যে গজিয়ে ছিল৷ উপজাতি উন্নয়নের প্রশ্ণে স্বাধীন ত্রিপুরার শ্লোগান উঠেছিল৷ গণহত্যা, গৃহদাহ এরাজ্যকে তখন অশান্ত আগ্ণেয়গিরির উপর বসিয়েছিল৷ রাজ্যের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য উপদ্রুত অঞ্চল ঘোষণা কিংবা আফস্পা প্রয়োগ, চেষ্টার কোন ত্রুটি হয়নি কখনো৷ ১৯৮৮ সালে বিধানসভা নির্বাচনের আগে রাজ্যে উপদ্রুত আইন জারি করেছিল কেন্দ্রীয় সরকার৷ আবার ১৯৯৭ সালে আফস্পা প্রয়োগ করা হয়েছিল এরাজ্যে৷ সময়ের বিবর্তনের সাথে সাথে পরিস্থিতিরও পরিবর্তন হয়৷ ১৮ বছর বাদে ২০১৫ সালে আফস্পা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়৷ রাজ্যকে উগ্রপন্থার নাগপাশ থেকেও মুক্ত করা হয়৷ অবশ্য, এর জন্য প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশকে কুর্ণীশ জানাতেই হয়৷ উগ্রপন্থার বিরুদ্ধে হাসিনা সরকারের ভূমিকা এবং রাজ্য সরকারের ইতিবাচক চেষ্টা ও সীমান্তে কাটা তাঁরের বেড়া এরাজ্যে উগ্রপন্থা দমনে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিল৷ শান্তির নিবিড় ছায়া ধীরে ধীরে পরিলক্ষিত হচ্ছিল৷ কিন্তু, দীর্ঘ সময় ধরে অশান্তির হাওয়া রাজ্যকে অনেক পিছিয়ে দিয়েছিল, তা বলতে দ্বিধা নেই৷

রাজ্য এখন এক নতুন সম্ভাবনার দিকে এগিয়ে চলেছে৷ রেল এসেছে, যোগাযোগ ব্যবস্থায় উন্নতি হয়েছে৷ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাথে যুক্ত হওয়া এখন কেবলই সময়ের অপেক্ষা৷ নদীপথে বাংলাদেশের সাথে পণ্য পরিবহনে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে৷ আরো অনেক কিছুই ত্রিপুরাকে দেশের মূলস্রোতে নিয়ে যেতে চেষ্টা করছে৷

কিন্তু, উন্নয়নের প্রধান শর্ত যখন শান্তি, তখন আবারও ত্রিপুরার আকাশে অশান্তির মেঘ দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করা অমূলক হবে না৷ রাজ্যে এখন এনআরসি’র হাওয়া প্রবল বেগে বইছে৷ অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্ণিত করার জন্য মামলা সুপ্রিম কোর্টে গড়িয়েছে৷ সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈর নেতৃত্বে বিচারপতি  এস কে কৌল এবং বিচারপতি কে এম জোসেফকে নিয়ে গঠিত বেঞ্চে মামলার শুনানি শুরু হয়েছে৷ ইতিমধ্যে, সুপ্রিম কোর্ট বিদেশ মন্ত্রক, নির্বাচন কমিশন, রেজিস্টার জেনারেল সেনসাস, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক এবং ত্রিপুরা সরকারকে এই ইস্যুতে নোটিশ পাঠিয়েছে৷ ত্রিপুরা সরকার নোটিশের জবাব দিতে প্রস্তুতি নিচ্ছে৷ সম্ভবত, আগামী ২৯ অক্টোবর মন্ত্রিসভার বৈঠকে এবিষয়ে আলোচনাও হতে পারে৷ নীতিগতভাবে বিজেপি এনআরসি’র বিরোধীতা করবে না৷ জোট শরিক আইপিএফটিও চাইছে এনআরসি৷ ফলে, ত্রিপুরা সরকার সুপ্রিম কোর্টের নোটিশের জবাবে এনআরসি নিয়ে হয়তো আপত্তি জানাবে না৷ কিন্তু, এনআরসি বিজেপি’র জন্য গোঁদের উপর বিষফোঁড়ার মতোই অবস্থা হবে তাও তারা বুঝতে পারছে৷ এর জ্বলন্ত উদাহরণ অসমে এনআরসি নিয়ে অগ্ণিগর্ভ অবস্থা৷

এনআরসি’র মূল জটিলতা হল ভিত্তি বছর৷ অসমের শিলচরে নির্বাচনী জনসভায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ১৯৭১ সালকে ভিত্তি বছর ধরেই অসমে এনআরসি চালু হবে৷ কিন্তু, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ১৯৫১ সালকে ভিত্তি বছর ধরেই এনআরসি চালু হয়েছে অসমে৷ খসড়া তালিকা থেকে ৪৩ লক্ষ নাম বাদ গিয়েছে৷ ফলে, অস্থির হয়ে উঠেছে অসম৷

ত্রিপুরাকেও একই জটিলতার মুখোমুখি হতে হবে৷ বাংলাদেশ থেকে ছিন্নমূল উদ্বাস্তুরা ১৯৭১ সালের সময়সাময়িক কালে এরাজ্যে এসেছেন৷ ত্রিপুরার জনসংখ্যার একটা বিরাট অংশ এই উদ্বাস্তুরাই, তা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই৷ কিন্তু, যদি ১৯৫১ সালকে এনআরসি’র জন্য ভিত্তি বছর ধরা হয়, তাহলে ত্রিপুরাতে শুধুই উপজাতিরা থাকতে পারবেন৷ কিন্তু, এখানেও জটিলতা রয়েছে৷ কারণ, রাষ্ট্রীয় সাতকথা সমাজ সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানিয়েছে, এনআরসি’র আওতায় বাংলাদেশের খাগরাছড়ি থেকে এরাজ্যে আসা চাকমা এবং ত্রিপুরীদেরও চিহ্ণিত করা হোক৷ জনৈক প্রশাসনিক কর্তার কথায়, খাগরাছড়ি থেকে বিরাট সংখ্যায় চাকমা এবং ত্রিপুরী সম্প্রদায়ের লোক এরাজ্যে এসেছেন তা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই৷

এখানেই, এনআরসি সাম্প্রদায়িক বিভাজনে বিরাট ভূমিকা নেবে বলেই আশংকা করা হচ্ছে৷ আবারও জাতি-উপজাতির মধ্যে অবিশ্বাসের পরিবেশ কায়েম হতে পারে৷ কারণ, প্রশ্ণ যখন অস্তিত্বকে প্রমাণ করা, তখন বিভেদ সৃষ্টি অস্বাভাবিক নয়৷ তাতে, পরিবেশ আবারও অশান্ত হয়ে উঠবে না, দায়িত্ব নিয়ে সে কথা কে বলতে পারবে৷

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *