নিজস্ব প্রতিনিধি, আগরতলা, ২১ ডিসেম্বর৷৷ সংখ্যালঘুরা দেশের রাজনৈতিক দলগুলির হাতিয়ার৷ এনিয়ে আক্ষেপ করেন
রাজ্যপাল তথাগত রায়৷ তিনি স্পষ্ট বলেন, হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, জৈন ধর্মাবলম্বী মানুষ অন্যায় করলে তাদের সকলকে এক চোখে দেখা হবে, দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এটা সত্য নয়৷ তিনি মনে করেন, দেশের পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে যে একজন মুসলিমের অন্যায় কিছুতেই বলা যাবে না৷ সেটাকে চেপে রাখতে হয়৷ আর এবিষয়টি মানুষের অবচেতনের মধ্যে ঢুকে গেছে৷ কিন্তু প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশেই সংখ্যালঘুরা বিশেষ করে হিন্দুরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন৷ তাঁর মতে, ওপারে হিন্দু সহ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্তদের নিরাপত্তাবোধ দিতে হবে৷ না হলে খুব স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ওঁরা ভারতে চলে আসবে বলে তিনি চিন্তা ব্যক্ত করেন৷ বুধবার আগরতলায় সুকান্ত একাডেমি অডিটোরিয়ামে রাজ্যপাল তথাগত রায়ের লেখা ‘যা ছিল আমার দেশ’ বইটি আনুষ্ঠানিক প্রকাশ করে তিনি আলোচনায় এই বিষয়গুলি তুলে ধরেন৷ মূলত, দেশভাগের পর তদানীন্তন উদ্বাস্তুদের ওপর অত্যাচার, নিপীড়ন ও দুঃখ, দুর্দশার কাহিনী ও ইতিহাস এই বইতে তুলে ধরেছেন রাজ্যপাল৷
এদিন, এই বইয়ের বিভিন্ন দিক নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন রাজ্যপাল তথাগত রায়৷ তাতে এই বই লেখার নেপথ্যে সংখ্যালঘু তোষণ এদেশে যেভাবে হচ্ছে ঠিক তার উল্টো প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশে হিন্দুদের পাশাপাশি অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্তরা চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন সেই বিষয়কেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে৷ দেশভাগের পরবর্তী পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দুদের যেভাবে গণহত্যা করা হয়েছে সেই বিষয়গুলিও রাজ্যপাল তুলে ধরেছেন৷ এদিন তিনি অত্যন্ত উদ্বেগের সাথে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে চোকনগরের কাছে পাকিস্তানি সেনারা প্রায় দশ হাজার হিন্দুদের হত্যা করেছিল৷ তখন ওপারে নিরাপত্তাহীনতার কারণে বহু হিন্দু সহ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্তরা ওপার ছেড়ে এপারে চলে এসেছিলেন৷ তাঁর বক্তব্য, মূলত ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ হয়েছে৷ কিন্তু দেশভাগের পর বহু উদ্বাস্তু এপারে যেমন এসেছেন অনেকে ওপারেও গেছেন৷ কিন্তু পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রায় ১ কোটির ওপর হিন্দু ভারতে চলে এসেছিলেন৷ কিন্তু সমপরিমাণে মুসলিম ওপারে যাননি৷ অবশ্য, স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে জনসংখ্যার পরিসংখ্যান ঘাটলে দেখা যাবে ১৯৪৭ সালে পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন শতকরা ২০ শতাংশ৷ যা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০ শতাংশ৷ অথচ বাংলাদেশে যেখানে সংখ্যালঘুদের শতকরা হার ছিল ২৯ শতাংশ৷ এখন সেটা কমে দাঁড়িয়েছে শতকরা ৮ শতাংশ৷ এই পরিসংখ্যান অনেক কিছুই ইঙ্গিত করছে বলে তিনি মনে করেন৷
এদিন তিনি সাফ বলেন, নিরাপত্তা যেমন প্রয়োজন তেমনি নিরাপত্তাবোধেরও প্রয়োজন রয়েছে৷ কিন্তু নিরাপত্তাবোধ বাংলাদেশ সরকার সেদেশের সংখ্যালঘুদের মধ্যে জাগ্রত করতে পারছে না৷ সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার সংখ্যালঘুদের মধ্যে নিরাপত্তাবোধ জাগ্রত করার প্রয়াস হাতে নিয়েছে৷ কিন্তু সেটা যথেষ্ট নয় বলে মনে করেন রাজ্যপাল তথাগত রায়৷ তাই তিনি বলেন, ওপারের সংখ্যালঘুরা বাংলাদেশেরই নাগরিক৷ তাই, তাঁদের ওপারে থাকার পুরো অধিকার রয়েছে৷ এজন্য বাংলাদেশ সরকারকেই তাঁদের নিরাপত্তার পাশাপাশি নিরাপত্তাবোধ জাগ্রত করা সুনিশ্চিত করতে হবে৷
এদিন আলোচনায় উদ্বাস্তুদের ওপার থেকে এপারে চলে আসার পেছনে অর্থনৈতিক কারণ রয়েছে কিনা সেই প্রশ্ণও উঠেছে৷ কিন্তু রাজ্যপাল তথাগত রায়ের সাফ কথা, ওপার থেকে এপারে আসার পেছনে অর্থনীতি গৌণ কারণ৷ মূলত, নিরাপত্তাহীনতায় তাঁদেরকে এপারে আসতে বাধ্য করেছে৷ তিনি জোর গলায় বলেন, বেশিরভাগ হিন্দু বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে এসেছিলেন তার পেছনে অর্থনৈতিক দিক নেই৷ কারণ হিন্দু জমিদাররা মুসলিমদের উপর অত্যাচার করেছিলেন এজন্যই তাঁদের ওপর প্রতিশোধ মুসলিমরা নিয়েছেন তেমনটা মনে করার উপায় নেই৷ এদিন রাজ্যপাল যুক্তি দিয়ে বলেন, নোয়াখালিতে খুব বেশি হলে ১০০ জন হিন্দু জমিদার ছিলেন৷ পাশাপাশি মুসলিম জমিদারও ছিলেন৷ আর সব জমিদাররা অত্যাচারী ছিলেন না৷ তাই জমিদাররা অত্যাচার করেছেন বলে তাঁদের বিরুদ্ধে মুসলিমরা ক্ষেপেছেন, সেটাই যদি হয়ে থাকে তাহলে গরিব জেলে, ছোট দোকানদার, শিক্ষকদের উপর ওপারে অত্যাচার কেন হয়েছে৷ এই প্রশ্ণ তুলে রাজ্যপালের দাবি, তাঁরা হিন্দু বলেই তাঁদের ওপর অত্যাচার হয়েছে৷
এদিকে, পাকিস্তানের সাথে কোনভাবেই সমঝোতায় আসা সম্ভব নয় বলে স্পষ্ট জানান রাজ্যপাল৷ প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সাথে সৌভ্রাতৃত্বমূলক সম্পর্কের বিষয়ে এক প্রশ্ণের জবাব দিতে গিয়ে রাজ্যপাল উষ্মা প্রকাশ করে বলেন, পাকিস্তানের সুকলগুলির পাঠ্যবইগুলি ছত্রে ছত্রে ভারত বিদ্বেষী কথা রয়েছে৷ সেখানে নির্বাচিত সরকার নয়, সেনাবাহিনী দেশ পরিচালনা করছে৷ তাঁদের একটাই উদ্দেশ্য ভারতের সাথে শত্রুতা জাগ্রত করে রাখা৷ এমন একটা দেশের সাথে সমঝোতা কিভাবে করা যাবে সেই প্রশ্ণ তুলেন রাজ্যপাল৷ তাতে পাল্টা প্রশ্ণ উঠে আসে পরাজিত করার বদলে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মন জয় করা সম্ভব কিনা৷ তাতে রাজ্যপাল বলেন, পরাস্ত করতেই হবে৷ কারণ, চার্চিল বলেছিলেন আগে জয় পেতে হবে, তারপর উদার হতে হবে৷ না হলে উদার যে মূল্য পাওয়া যাবে না৷ তাই রাজ্যপাল মনে করেন, পাকিস্তানের রাজনৈতিক শক্তির সাথে সমঝোতায় আসা সম্ভব৷ কিন্তু সেনাবাহিনীর সাথে সমঝোতা কোনভাবেই সম্ভব নয়৷ ফলে, পাকিস্তানের আসল ক্ষমতা যতদিন অসামরিক সরকারের কাছে ফিরে না আসে ততদিন কোনরকম শান্তির আশা নেই বলে মন্তব্য করেন রাজ্যপাল৷