গুয়াহাটি, ০১ সেপ্টেম্বর, (হি.স.) : কোনও সরকারের একশো দিনের কাজকর্মে তাদের মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়। তবে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের পথেই তাঁর সরকার এগোচ্ছে বলে জানিয়েছেন অসমে পরিবর্তনকামী নতুন মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সনোয়াল। রাজ্যে বিজেপি জোট সরকারের একশো দিনের কাজের খতিয়ান তোলে ধরতে আজ বিকেলে স্থানীয় খানাপাড়ায় অসম প্রশাসনিক মহাবিদ্যালয় প্রেক্ষাগৃহে আয়োজিত সাংবাদিক সম্মেলনে এই দাবি করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। গতকাল সন্ধ্যায়ও গুয়াহাটি দূরদর্শন কেন্দ্রে জনতার মুখোমুখি হয়ে অনুরূপ মন্তব্য করেছিলেন তিনি। বলেছেনে, বর্তমান সরকারের সকল মন্ত্রী-বিধায়কবর্গ আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে জনকল্যাণে ঝাঁপিয়েছেন।
আজকের সাংবাদিক সম্মেলনে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকারের প্রথম একশো দিনের কর্মসূচিতে রাজ্য প্রশাসনকে আমজনতার কাছাকাছি নিয়ে যাওয়ার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আগে যা কখনও ঘটেনি তা এখন হচ্ছে, দিশপুর থেকে পঞ্চায়েত স্তরে এক সুসম্পর্ক গড়ে তুলেছে রাজ্যের বর্তমান সরকার। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকার দুর্নীতি-ভ্রষ্টাচার প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা হাতে নিয়েছে, যার প্রমাণ রাজ্যবাসী ইতিমধ্যে পেয়েছেন। একশো দিনের কাজের খতিয়ান তোলে ধরে মুখ্যমন্ত্রী সনোয়াল জানান, মাত্র এই কদিনে রাজ্যে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় ও দুটি মেডিক্যাল কলেজ, এক ক্যানসার হাসপাতাল, অসমে রেল পরিষেবা উন্নত করার প্রয়াস, বিদেশীমুক্ত রাজ্য করতে নানা পদক্ষেপ, সবুজ অসম গড়ার ইতিবাচক প্রকল্পের চালু করা হয়েছে।
মুখ্যমন্ত্ৰী বলেন, সন্ত্ৰাসবাদ এবং দুর্নীতির ক্ষেত্ৰে রাজ্য সরকার জিরো টলারেন্স স্থিতি নিয়ে এগোবে। অসমকে একটি অবৈধ বিদেশী নাগরিকমুক্ত রাজ্য হিসেবে গড়ে তোলার পাশাপাশি অত্যাধুনিক পদ্ধতি প্রয়োগ করে আন্তর্জাতিক সীমান্ত পুরোপুরি সিল করাই তাঁর সরকার অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে গুরুত্ব দিচ্ছে। বলেন, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত পুরোপুরি সিল করা এবং সীমান্ত দিয়ে অনুপ্ৰবেশ রোধ করার পাশাপাশি চোরাকারবারিও যাতে সম্পূৰ্ণরূপে বন্ধ হয় তার জন্য সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া ভারত-পাকিস্তান সীমান্তের মতো শক্তিশালী করে তোলার ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। অসমের ভারত-বাংলা সীমান্তে প্রহরার দায়িত্ব সেনাবাহিনীর ওপর অৰ্পন করার ওপরও গুরুত্ব আরোপ করেন মুখ্যমন্ত্ৰী।
এদিকে রাজ্যে যাতে একটি নির্ভেজাল নাগরিকপঞ্জি হয় তার জন্য নাগরিকপঞ্জি নবায়নের কাজ আগামী ২০১৭ সালের মধ্যে সম্পূৰ্ণ করা হবে বলেও মুখ্যমন্ত্ৰী জানান। এই কাজ বিগত সরকারের আমলে স্থবির হয়ে পড়েছিল বলেও অভিযোগ করেন মুখ্যমন্ত্রী।
মুখ্যমন্ত্ৰী হিসেবে দায়িত্ব গ্ৰহণের পর একশো দিনের খতিয়ান তোলে ধরে মুখ্যমন্ত্ৰী সৰ্বানন্দ সোনোয়াল বলেন, গত ২৪ মে তাঁর সরকার দায়িত্ব গ্ৰহণ করার পর থেকেই নিষ্ক্ৰিয় রাজ্য প্ৰশাসন-যন্ত্ৰের প্রতি জনসাধারণের আস্থা ফিরিয়ে আনার আপ্রাণ চেষ্টা চলানো হচ্ছে। এক্ষেত্ৰে ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ’ নীতি গ্ৰহণ করে বরাক, ব্ৰহ্মপুত্ৰ এবং পাহাড়-সমতলের সকল জনসাধারণকে সমগুরুত্ব দিয়ে জনতার স্বাৰ্থে কাজ করে চলেছে তাঁর সরকার। সরকারের একশো দিনের কৰ্মসূচিতে জনসাধারণের স্বাৰ্থে প্রশাসন-যন্ত্ৰকে কর্মক্ষম করে তোলার পাশাপাশি এর প্ৰতি আস্থা ফিরিয়ে আনা এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে কড়া অবস্থানও নেওয়া হয়েছে, যার প্রতিফলন ইতিমধ্যে রাজ্যের মানুষ দেখেছেন, বলেন মুখ্যমন্ত্রী। দারিদ্র্যসীমারেখার নীচের কোনও ব্যক্তিও যাতে সরকারি দফতরে এসে সমমৰ্যদা পান তার জন্য আধিকারিক-কৰ্মচারীদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
তাঁর সরকার জনসাধারণের প্ৰতি সম্পূৰ্ণ দায়বদ্ধ বলে মন্তব্য করে মুখ্যমন্ত্ৰী বলেন, জনসাধারণ যাতে কোনও ক্ষেত্রেই দুৰ্ভোগে না পড়েন তার জন্যও প্ৰচেষ্টা হাতে নেওয়া হয়েছে। তাছাড়া, মুখ্যমন্ত্ৰীর কনভয়ও যাতে জনসাধারণের কোনও অসুবিধার সৃষ্টি না করে তার প্ৰতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, যা এতদিনে রাজ্যের মানুষ দেখেছেন বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এদিকে নতুন সরকার দায়িত্ব গ্ৰহণের পর এবং তৃণমূল পৰ্যায়ে উন্নয়নমুখী ব্যবস্থা গ্ৰহণ করার সময় রাজ্যে সংঘটিত প্রয়ঙ্করী বন্যা ও ভাঙন প্ৰসঙ্গে মুখ্যমন্ত্ৰী বলেন, এ-ধরনের দুৰ্যোগের সময় বিপর্যস্ত জনসাধারণের কাছে দাঁড়াতে প্ৰশাসনকে তৎপর করা হয়েছিল। এমন-কি সে সময় চলমান বিধানসভার অধিবেশনও স্থগিত রেখে দুর্গত মানুষজনের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন জনপ্ৰতিনিধিরা। তাঁরা দুর্গতদের ক্ষয়ক্ষতির খতিয়ানও সংগ্রহ করেছেন বলে জানান সর্বানন্দ। এবারের বন্যায় ক্ষতিগ্ৰস্তরা যাতে সময়মতো ত্রাণসাহায্য পান তার জন্যও রাজ্য সরকার বিহীত ব্যবস্থা হাতে নিয়েছে।
কেবল তা-ই নয়, জনসাধারণের সমস্যাবলি সম্পর্কে অবগত হওযায় সঙ্গে সঙ্গে জনপ্ৰতিনিধিরা ঘটনাস্থলে দৌড়ে যাওয়ার ঘটনাও এই একশো দিনের কার্যকালের মধ্যে পড়ে মনে করেন মুখ্যমন্ত্ৰী। জনসাধারণের কল্যাণের ব্যাপারে দায়িত্ব পালন করার ক্ষেত্ৰেও কোনও ধরনের বিলম্ব তাঁর সরকার করেনি বলে মুখ্যমন্ত্ৰী জানান, জনসাধারণের স্বাৰ্থের প্ৰতি লক্ষ রেখেই পণ্য ও পরিষেবা কর (জিএসটি) বিলের মতো বিলকে দেশের মধ্যে সর্বপ্ৰথম অসম বিধানসভাই অনুমোদন দিয়েছে।
মাত্র একশো দিনে এই পরিবর্তন চোখে দেখার মতো পর্যাপ্ত নয় বলে মন্তব্য করে মুখ্যমন্ত্ৰী সৰ্বানন্দ সোনোয়াল বলেন, তাঁর সরকার যখন দায়িত্ব নেয়, তখন রাজ্যে ১৭ হাজার কোটি টাকা ঋণের বোঝা ছিল। এক্ষেত্ৰে শ্বেতপত্ৰও প্ৰকাশ করা হয়েছে। পূর্ববর্তী সরকার কর্তৃক প্রদত্ত বহু প্ৰতিশ্ৰুতি পালন করতে পারেনি সেই সরকার। কিন্তু তাঁর বর্তমান সরকার এই একশো দিনের মধ্যে রাজ্যের উন্নয়নের লক্ষে বহু পদক্ষেপ গ্ৰহণ করেছে। বিগত সরকারের আমলে প্ৰশাসন-যন্ত্ৰের প্ৰতি মানুষের আস্থা হারিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বিজেপি সরকারের সুশাসনে প্রশাসন-যন্ত্ৰ সৎ ও নিষ্ঠাবানের পথে এগোচ্ছে। মুখ্যমন্ত্ৰী বলেন, সুশাসনের পাশাপাশি দুর্নীতি থেকে জনসাধারণকে মুক্তি দিতে সরকারি তৃতীয় ও চতুৰ্থ শ্ৰেণির কর্মচারীদের মৌখিক সাক্ষাৎকার প্ৰত্যাহার করেছে বর্তমান রাজ্য সরকার।
রাজ্যের কৰ্মচারীদের আর্থিক সংকট থেকে মুক্তি দিতে তাঁদের মহার্ঘ ভাতা বাড়ানোর অনুমোদন জানানো হয়েছে। একশো দিনের খতিয়ান দিতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্ৰী জানান, বিভিন্ন কলেজে ৬০ হাজার ছাত্ৰছাত্ৰীকে বিনামূল্যে ভরতির ব্যবস্থা করা, সৰ্বশিক্ষার অধীনে সাত হাজার টেট শিক্ষক নিয়োগ তথা খুব শিগগির ফের সৰ্বশিক্ষায় ১১,৭৮৫ জন টেট শিক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা করা হবে। তাছাড়া, হোজাই, বরপেটা ও বিহপুরিয়ায় একটি করে মোট তিনটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সিদ্ধান্ত রাজ্য সরকার নিয়েছে এবং তা ইতিমধ্যে বিধানসভায় বাজেট অধিবেশনে ঘোষণা করা হয়েছে বলে জানান মুখ্যমন্ত্রী। একইভাবে স্বাস্থ্যক্ষেত্রেও রাজ্যর লখিমপুর ও ধুবুড়িতে একটি করে দুটি মেডিক্যাল কলেজ স্থাপন, গুয়াহাটি মেডিক্যেল কলেজ হাসপাতালে দুশো আসন বিশিষ্ট ক্যানসার হাসপাতাল এবং পেট স্ক্যান মেশিন স্থাপন-সহ আগামী দিনে এই দুই বিভাগে আমূল পরিবৰ্তন আনা হবে বলেও মুখ্যমন্ত্ৰী জানান আজ।
পাশাপাশি রাজ্যের বিভিন্ন ট্রেজারিতে দির্ঘদিন ধরে আবদ্ধ গন্ডারের খড়গ পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা যে চলছে তা-ও মনে করিয়ে দেন তিনি। বলেন, রাজ্যের ১২৬টি বিধানসভা কেন্দ্রের পঞ্চায়তগুলিতে ডিজিটাল লিটারেসির ব্যবস্থা করা, সত্ৰনগরী মাজুলিকে জেলা ঘোষণা করা এবং কৃষ্টি-সংস্কৃতি রক্ষার জন্য মাজুলিতে একটি সাংস্কৃতিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সিদ্ধান্তও রাজ্য সরকারের এক উল্লেখযোগ্য নিদর্শন বলেও মুখ্যমন্ত্ৰী জানান।
অসমে বসবাসকারী বিভিন্ন জাতি-জনগোষ্ঠীকে আস্থায় নিয়ে একটি উন্নত-বিকশিত অসম গড়ে তোলাই তাঁর সরকারের অন্যতম লক্ষ্য বলে নিজের তিন মাসের কার্যকালের খতিয়ান তোলে ধরেন মুখ্যমন্ত্ৰী সৰ্বানন্দ সোনোয়াল।