গুয়াহাটি, ২৪ জুলাই, (হি.স.) : ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে অসমের বন্যা পরিস্থিতি। ব্রহ্মপুত্র-সহ তার উপনদী লোহিত, কুণ্ডিল, ডিব্রু, ডিরাক, গুঁইজান প্রভৃতি নদীর জলস্তর ভয়াবহভাবে বেড়ে চলায় ডিব্রুগড় ও তিনসুকিয়া জেলা-সহ শিবসাগর, গোলাঘাট, ধেমাজি, শিবসাগর, যোরহাট, লখিমপুর, নগাঁও, মরিগাঁও, ধুবড়ি, কোকরাঝাড়, বঙাইগাঁও এবং চিরাং-এর বিস্তীর্ণ অঞ্চল জলমগ্ন হয়ে গেছে। বন্যার তাণ্ডবের হাত থেকে নিস্তার পেতে বাড়িঘর, পালিত গবাদি পশুকে ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটে চলেছেন বন্যা দুর্গত মানুষ। উদ্ধারে নামানো হয়েছে সেনাবাহিনী, এনডিআরএফ, এসডিআরএফ, অগ্নিনির্বাপণ বাহিনী এবং আপৎকালীন বিভাগের প্রশিক্ষিত কর্মীদের। ইতিমধ্যে রাজ্যের বন্যার কবলে পড়ে লখিমপুর এবং মরিগাঁও জেলায় একজন করে দুজনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে এসডিআরএফ। তবে বেসরকারি হিসাবে মৃত্যুর সংখ্যা আরও বেশি বলে দাবি করা হচ্ছে। একই অবস্থা জীবজন্তু বা পশুকুলেরও। হাজার হাজার হেক্টর কৃষিজমি প্লাবিত। এসডিআরএফ-এর সূত্র জানিয়েছে, রাজ্যের মোট ১৪টি জেলার ৩৩টি রাজস্বচক্রের ১,০৩৯টি গ্রাম জলপ্লাবণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই জেলাগুলির মোট ৫,০২,৮৩১ জন মানুষ বন্যা-প্রভাবিত। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৪৬,৬৮০.২৪ হেক্টর কৃষিখেত। সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যোরহাট জেলা। বেশ কয়েকটি জায়গায় নদীবাঁধ ভেঙে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটেছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে যে অরুণাচল প্রদেশ-অসম সংযোগী ৫২ নম্বর জাতীয় সড়কের চার থেকে পাঁচ ফুট ওপর দিয়ে বন্যার জল চলাচল করছে। জলের তোড়ে ভেঙে গেছে অসংখ্য কালভার্ট, ছোটছোট কাঠের সেতু। বন্যার জলে ভেসে গেছে তিন হাজারের বেশি ছোটবড় পশু।
তিনসুকিয়া জেলার সীমান্তবর্তী অরুণাচল প্রদেশে গত কয়েকদিন ধরে মুষলধারে বৃষ্টিপাতের ফলে পাহাড়ি ওই রাজ্যের নদীগুলিও জলে টইটুম্বুর। বহন ক্ষমতার বেশি জল প্রবাহিত হওয়ায় অসমেরও বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্লাবিত হয়ে গেছে। তিনসুকিয়া জেলার ডুমডুমা রাজস্বচক্রের ডিরাক-সোমনি এলাকায় প্রায় ৪৫টি পরিবারকে অপেক্ষাকৃত উঁচু জায়গায় স্থানান্তরিত করার পাশাপাশি তাঁদের জন্য অত্যাবশ্যক সামগ্রী চাল, ডাল, নুন, সরষে তেল ইত্যাদি পাঠিয়েছে প্রশাসন।
এদিকে তিনসুকিয়া সদর থানার অন্তর্গত গুঁইজান পুলিশ ফাঁড়ি, বন্যপ্রাণী বিভাগের গুঁইজান, ডিএফও অফিস, রঙাগড়া চা বাগান, নতুনগাঁও, খামতি-গোয়ালি-সহ ডিব্রু-সৈখোয়া জাতীয় উদ্যানও জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে সৈখোয়া-শদিয়া ফেরিসেবা।
মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সনোয়ালের নির্বাচন কেন্দ্র বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম নদীদ্বীপ সত্রনগরী মাজুলির পরিস্থিতি বর্ণনাতীত। ব্রহ্মপুত্র-সহ সুবনশিরি লোহিত এবং খেরকটা নদীতে তীব্রগতিতে জল বাড়ছে। বিপদসীমার ওপর দিয়ে বইছে সবকয়টি নদী। মাজুলির সঙ্গে যোগাযোগকারী নিমাতিঘাট, কমলবাড়ি ফেরিসেবাও বন্ধ করে দিয়েছে জেলা প্রশাসন। মাজুলি রাজস্বচক্রের প্রায় একশো গ্রামের আনুমানিক ৫২ হাজার বন্যা-প্রবাবিত। সেখানকার বাসিন্দারা এখন দিবারাত্রি ঈশ্বরের শরণাপন্ন হয়ে সামূহিক নামকীর্তন করে চলেছেন। রুদ্র রূপ ধারণকারী ব্রহ্মপুত্রকে শান্ত হতে নদের পারে চলছে পূজার্চনা, নামকীর্তন।
তিনসুকিয়া জেলার মার্ঘেরিটা মহকুমার লেখাপানি থানার প্রায় ৩০টি গ্রাম জলের নীচে। ওখানকার ১ নম্বর টকলংগাঁওয়ের বস্কর ভুমিজ (৩২) নামের এক যুবকের জলে ডুবে মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে। মহকুমায় এসডিআরএফ এবং স্থানীয় জনতার সহযোগিতায় উদ্ধার অভিযানের পাশাপাশি খাদ্য ও প্রয়োজনীয় সামগ্রী বিলি করা হচ্ছে বলে খবর।
শিবসাগরের পরিস্থিতিও ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে। জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত দিসাং, ডিখৌ, দিহিং,দরিকা, মিটং নদী সংহারী হয়ে ওঠেছে। জেলার ৪০০ হেক্টরের বেশি কৃষিজমি প্রভাবিত হয়েছেন প্রায় দশ হাজারের বেশি মানুষ।
গোলাঘাটের মাউতগাঁও, রজনাখাত, মক্রং, ঘিলাধারী ইত্যাদি নদীও বিপদসীমার ওপর দিয়ে বইছে। জেলার কৃষিজীবী থেকে সাধারণ মানুষের মধ্যে শুরু হয়েছে হাহাকার।
এদিকে কাজিরঙা জাতীয় উদ্যান, পবিতরা অভয়ারণ্যের বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত। মায়ং রাজস্বচক্রের মায়ং, মনহা, পকরিয়া এবং ঘগুয়া মৌজার প্রায় ৫০টি গ্রাম জলমগ্ন। নিম্ন অসমের চিরাং, বরপেটা, বঙাইগাঁও, কোকরাঝাড় জেলায় বন্যার তাণ্ডব অব্যাহত। তাছাড়া টিয়কের জাঁজিমুখও বন্যার কবলে। টিয়কের প্রায় ২৫টি গ্রাম প্লাবিত। প্রভাবিত প্রায় ২৫ হাজার মানুষ।