উন্নয়ন নিয়ে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে মুখ্যমন্ত্রীর গুচ্ছ অভিযোগ খন্ডন করলেন লোকসভার অধ্যক্ষা

নিজস্ব প্রতিনিধি, আগরতলা, ৩১ মে৷৷ বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরে উত্তরপূর্বাঞ্চলের উন্নয়নের প্রশ্ণে কেন্দ্রীয় সরকারের

মঙ্গলবার আগরতলায় বিধানসভা ভবনে এনইআরসিপিএ’র সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন লোকসভার অধ্যক্ষা সুমিত্রা মহাজন৷ ছবি নিজস্ব৷
মঙ্গলবার আগরতলায় বিধানসভা ভবনে এনইআরসিপিএ’র সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন লোকসভার অধ্যক্ষা সুমিত্রা মহাজন৷ ছবি নিজস্ব৷

দিশাহীনতার বিষয়গুলি নিয়ে জোর সওয়াল করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার৷ মুখ্যমন্ত্রীর এক গুচ্ছ অভিযোগের খন্ডন করে লোকসভার অধ্যক্ষা সুমিত্রা মহাজন ভারত সরকারের পূর্বোত্তরের উন্নয়নে সদিচ্ছার কোন ঘাটতি নেই সে কথা জানিয়েছেন৷ আগরতলায় অনুষ্ঠিত উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় কমনওয়েলথ সংসদীয় সমিতির সম্মেলনে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার এই অঞ্চলের যোগাযোগ, বেকারত্ব, শিল্প এবং আর্থসামাজিক উন্নয়নে কেন্দ্রের দিশাহীনতাকে দায়ী করেছেন৷ তাঁর দাবি, এই অঞ্চলে যোগাযোগ ক্ষেত্রে স্বাধীনতার ৬৯ বছরেও দেশের অন্যান্য অংশের তুলনায় অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে৷ কর্মসংস্থান এই অঞ্চলে নেই বললেই চলে৷ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিল্প সমস্ত ক্ষেত্রে দুর্বল হয়ে রয়েছে পূর্বোত্তর ভারত৷ ফলে, গোটা দেশের সাথে পাল্লা দিয়ে এই অঞ্চল এগিয়ে যেতে পারেনি৷ তাঁর জোরালো দাবি, [vsw id=”zk4q6LdDaRk” source=”youtube” width=”425″ height=”344″ autoplay=”yes”]পূর্বোত্তরের উন্নয়ন না হলে দেশ এগুতে পারবে না৷ মুখ্যমন্ত্রীর সমস্ত অভিযোগের খন্ডন করে লোকসভার অধ্যক্ষা বলেন, চলতি বাজেটে পূর্বোত্তরের উন্নয়নে ৩০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে৷ গুরুত্ব দেওয়া হেেয়ছ রেল, সড়ক ,পানীয় জলের উপর৷ যোগাযোগের ক্ষেত্রে ত্রিপুরার এক বিরাট সম্ভাবনা অপেক্ষা করছে৷ অদূর ভবিষ্যতে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার প্রবেশদ্বার হতে চলেছে ত্রিপুরা৷ পাশাপাশি এই অঞ্চলের যুবকযুবতীদের কর্মসংস্থানের প্রশ্ণে তিনি তাদের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ণ তুলেন৷ তাঁর বক্তব্য, দ্বাদশমান, অথবা স্নাতক, স্নাতকোত্তর ডিগ্রি ধারণ করলেই দক্ষতা অর্জন করা যায় না৷ কেন্দ্রীয় সরকার যুবকযুবতীদের দক্ষ করে তোলার এক প্রয়াস হাতে নিয়েছে৷ যাতে যুবক যুবতীদের সরকারি চাকুরির অপেক্ষায় বসে থাকতে না হয়৷ কেন্দ্রীয় সরকার চাইছে যুবক যুবতীদের স্বনির্ভর করে তুলতে৷ তার জন্য দক্ষতা বাড়ানো বিশেষভাবে প্রয়োজন৷
এদিকে, এদিন সম্মেলনে ভাষণের শুরুতেই লোকসভার অধ্যক্ষা সুমিত্রা মহাজন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকারের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন৷ তাঁর মতে, দেশে বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের মধ্যে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী সবার থেকে আলাদা৷ একজন স্বচ্ছ এবং বরণীয় মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তিনি মানিক সরকারের প্রশংসা করেন৷ তাঁর দাবি, দীর্ঘ অভিজ্ঞতা সম্পন্ন মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মানিক সরকারের পরিচালনায় এ রাজ্য আরো উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যাবে৷
এদিন, লোকসভার অধ্যক্ষা বলেন, প্রাকৃতিক সম্পদ ও মিশ্র সংসৃকতির ঐতিহ্যে সমৃদ্দি এক অপরূপ রাজ্য ত্রিপুরা৷ ত্রিপুরা সহ সমগ্র উত্তরপূর্ব হচ্ছে আমাদের দেশের একটি সম্পদশীল অঞ্চল৷ তাই উত্তরপূর্বের উন্নয়ন ছাড়া দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয় বলেই তিনি মনে করেন৷ শ্রীমতী মহাজন বলেন, উত্তরপূর্বাঞ্চল যেহেতু দেশের অন্যতম এক সম্পদশীল এলাকা৷ তাই এখান থেকে যতটুকু ইতিবাচক সম্পদ বের হয়ে আসবে দেশ তত বেশি সমৃদ্ধ হবে৷ তিনি বলেন, এই অঞ্চলের উন্নয়নে চাই শান্তি ও সম্প্রীতি৷ উত্তরপূর্বাঞ্চল পর্ষদ এ অঞ্চলের উন্নয়নে ক্রমাগত কাজ করছে৷ কেন্দ্রীয় সরকারও এই অঞ্চলের উন্নয়নে গুরুত্ব দিয়েছে৷ সে জন্যই উত্তরপূর্বের উন্নয়নে এবারের কেন্দ্রীয় বাজেটে ৩০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে৷ এই অঞ্চলের যোগাযোগ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকার আন্তরিকভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে বলে তিনি দাবি করেন৷ তাঁর মতে, পাহাড়ি অঞ্চলের সমস্যা একটু ভিন্নতর৷ যোগাযোগের ক্ষেত্রে অনেক প্রতিবন্ধকতা থাকে৷ আর এবিষয়টি তিনি অনুভব করেন কারণ, মহারাষ্ট্রের পাহাড়ি এলাকা কোঙ্কন অঞ্চলে তাঁর জন্ম৷ এজন্যই পাহাড়ি এলাকা সমস্যা সম্বন্ধে তিনি যথেষ্ট ওয়াকিবহাল৷ দাবি করে বলেন, পূর্বোত্তরের সমস্ত এলাকাকে জুড়ে দিতে হবে সড়ক পথে৷ তবে, রেলকে বাদ দিয়েও উন্নয়ন সম্ভব নয় সে কথাও স্বীকার করে নেন তিনি৷ শ্রীমতী মহাজন বলেন, ভারত সরকার গোটা পূর্বোত্তর দেশের রেলমানচিত্রে যুক্ত করার দৃঢ় সংকল্প নিয়েছে৷ রেলমন্ত্রক সে লক্ষ্যে কাজ করে চলেছে৷ অবশ্য এই অঞ্চলের যুবকযুবতীদের কর্মসংস্থানের প্রশ্ণে তিনি তাদের দক্ষ করে তোলার পক্ষেই সওয়াল করেছেন৷ তাঁর মতে, পঁুথিগত বিদ্যায় পারদর্শী হলেই চলবে না৷ দক্ষতা অর্জন করতে হবে৷ তাহলেই সরকারি চাকুরির উপর নির্ভরশীলতা কমবে৷ কেন্দ্রীয় সরকার দক্ষতা বিকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে৷ যাতে যুবক যুবতীদের স্বনির্ভর করে তোলা সম্ভব হয়৷ এই অঞ্চলের যুবকযুবতীদেরও দক্ষতা বিকাশ করে স্বনির্ভর করে তুলতে হবে৷
এদিন সম্মেলনে বক্তব্য রাখতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার বলেন, আমাদের দেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের যে ব্যবস্থা রয়েচে তাকে শক্তিশালী করতে হলে সাধারণ মানুষের আর্থ সামাজিক জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ঘটাতে হবে৷ সাধারণ মানুষের সার্বিক বিকাশ না ঘটলে সমৃদ্ধ দেশ গঠন সম্ভব হবে না৷ দেশের বৃহৎ অংশের মানুষ এখনো দারিদ্র্য সীমার নিচে৷ ৫৫ শতাংশ মহিলারা রক্তল্পতায় ভুগছেন৷ অধিকাংশ শিশুরা ভুগছে অপুষ্টিতে৷ দেশের ৫০ ভাগ গ্রামীণ এলাকায় যোগাযোগ বিদ্যুৎ নিরাপদ পানীয় জলের ব্যবস্থা নেই৷ নেই স্বাস্থ্য পরিষেবা ও শিক্ষার পরিকাঠামো৷ কোটি কোটি মানুষ এখনো গৃহহীন৷ মুখ্যমন্ত্রী বলেন, এটা সমৃদ্ধ মানব জীবন হতে পারে না৷ তিনি বলেন, তপশিলি জাতি, তপশিলি উপজাতি, সংখ্যালঘু ও অন্যান্য পশ্চাপদ শ্রেণীর মানুষেরাও পিছিয়ে পড়েছেন৷ এই অংশের মানুষদের পেছনে রেখে আমাদের সংসদীয় গণতন্ত্র শক্তিশালী হতে পারে না৷
মুখ্যমন্ত্রী বলেন, আমাদের অভিজ্ঞতা বলছে অর্থনৈতিক ক্ষমতা এখনো কেন্দ্রীভূত৷ সংবিধান সংশোধন হয়েছে অনেকবার৷ কিন্তু এই অবস্থার কোন পরিবর্তন হচ্ছে না৷ এই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের সংসদীয় ব্যবস্তা জাতীয় ও রাজ্যের ক্ষেত্রে অগ্রগতির পথ সুগম করতে একটা ভূমিকা নিতে পারে৷ মুখ্যমন্ত্রী বলেন, স্বাধীনতার এত বছর পরও উত্তর পূর্বাঞ্চলের উন্নয়ন অবহেলিত হচ্ছে৷ বিদ্যুৎ, কৃষি, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ শিক্ষার উন্নত পরিকাঠামো এখনো গড়ে উঠেনি৷ বেকারত্ব এক পাহাড় প্রমান সমস্যা৷ বিপথগামী হচ্ছে একাংশ যুবক৷ বিচ্ছিন্নতাবাদী মাঝে মাঝেই মাথা চাড়া দিচ্ছে৷ এটা ভুল পথ৷ আমাদের দেশ গণতান্ত্রিক দেশ৷ বিচ্ছিন্নতাবাদকে কিছুতেই সমর্থন করা যায় না৷ এই সমস্যা নিয়ে চিন্তাভাবনার প্রয়োজন রয়েছে৷ এই অঞ্চলের বিধানসভাগুলির অধ্যক্ষ উপাধ্যক্ষদের এই সম্মেলন এবিষয়ে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে বলে মুখ্যমন্ত্রী অভিমত ব্যক্ত করেন৷
সম্মেলনে মূল বক্তব্যের উপর আলোকপাত করেন উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় কমনওয়েলথ সংসদীয় সমিতির চেয়ারম্যান মেঘালয় বিধানসভার অধ্যক্ষ এ টি মন্ডল৷ তিনি বলেন, সংসদীয় ব্যবস্থায় উন্নয়নে এ ধরনের সম্মেলন অবদান রাখে৷ উত্তরপূর্বাঞ্চলের অন্যতম প্রতিবন্ধকতা হল অপ্রতুল যোগাযোগ ব্যবস্থা৷ তাছাড়া কর্মসংস্থানও এক বড় সমস্যা৷ এই সমস্যার সমাধানে কেন্দ্রকে এগিয়ে আসতে হবে৷ সম্মেলনে স্বাগত বক্তব্য রাখেন ত্রিপুরা বিধানসভার অধ্যক্ষ রমেন্দ্র চন্দ্র দেবনাথ৷ তিনি বলেন, াামাদের রাজ্যে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া খুবই শক্তিশালী৷ এখানে ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থা ও স্বশাসিত জেলা পরিষদ ব্যবস্থা কিভাবে কাজ করছে তা তিনি তুুলে ধরেন৷ অধ্যক্ষ বলেন, এ সমস্ত স্বশাসিত সংস্থাগুলিতে নিয়মিত নির্বাচন হয়৷ তিনি তার বক্তব্যে রাজন্য শাসিত ত্রিপুরা থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের প্রেক্ষাপটও তুলে ধরেন৷ বিধানসভার অধ্যক্ষ শ্রী দেবনাথ বলেন, কেন্দ্রীয় প্রকল্প রূপায়ণে অগ্রণী রাজ্য আমাদের ত্রিপুরা৷ এটা সম্ভব হয়েছে উন্নয়নে রাজ্যের জনগণের সক্রিয় সহযোগিতা ও অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে৷
এদিন সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় কমনওয়েলথ সংসদীয় সমিতির সম্মেলন উপলক্ষ্যে প্রকাশিত স্মরণিকার আনুষ্ঠানিক প্রকাশ করেন লোকসভার অধ্যক্ষা সুমিত্রা মহাজন৷ সম্মেলনে উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলির বিধানসভার অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ গণ ছাড়াও সাংসদ ঝর্ণা দাস বৈদ্য, সমাজকল্যাণ ও সমাজ শিক্ষামন্ত্রী বিজিতা নাথ সহ সাংসদ ও বিধায়কগণ অংশ নেন৷ উপস্থিত ছিলেন লোকসভার মহাসচিব অনুপ মিশ্র, সচিব ড ডি ভাল্লা, লোকসভা ও বিধানসভাগুলির আধিকারিক এবং অন্যান্য আধিকারিকগণ৷ সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর শুরু হয় বিষয় ভিত্তিক আলোচনা৷ বিষয় ভিত্তিক আলোচনার প্রথম বিষয়বস্তু ছিল উত্তর পূর্বাঞ্চলের অগ্রগতি ও উন্নয়নের জন্য উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় কমনওয়েলথ সমিতিকে শক্তিশালী করা৷ এবিষয়ে আলোচনার সূত্রপাত করেন ত্রিপুরা বিধানসভা উপাধ্যক্ষ পবিত্র কর৷ তাছাড়াও আলোচনায় অংশ নেন নাগাল্যান্ড, মণিপুর ও অরুণাচল প্রদেশের অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষগণ৷ সকালে সম্মেলনের উদ্বোধনের জন্য লোকসভার অধ্যক্ষ সুমিত্রা মহাজন বিধানসভায় এসে পৌঁছলে তাকে রাষ্ট্রীয় অভিবাদন জানায় টিএসআর জওয়ান৷
সম্মেলনে আলোচনার দ্বিতীয় বিষয় ছিল উত্তর পূর্ব ভারতে ভূমিক্ষয় ও জনগণের উপর তার প্রভাব৷ আলোচনার সূচনা করেন সিকিম বিধানসভার অধ্যক্ষ৷ অরুণাচল প্রদেশ, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড বিধানসভার অধ্যক্ষ, রাজ্য বিজ্ঞান প্রযুক্তি ও পরিবেশ দপ্তরের মন্ত্রী বিজিতা নাথ, ত্রিপুরা বিধানসভার উপাধ্যক্ষ পবিত্র কর আলোচনায় অংশ নেন৷
আলোচনায় বিজ্ঞান প্রযুক্তি মন্ত্রী বিজিতা নাধ বলেন, ভূমিক্ষয় রোধে বিজ্ঞান ভিত্তিক জল সম্পদ ব্যবস্থাপনা, ভূপৃষ্ঠস্থ জলসংরক্ষণ, বৃষ্টির জল সংরক্ষণ করা হলে ভূমিক্ষয় অনেকাংশে রোধ করা যেতে পারে৷